সিপিডির সংবাদ সম্মেলন : নবায়নযোগ্য জ¦ালানি নীতি বাস্তবায়নে বড় বাধা দুর্নীতি

আগের সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্মার্ট বাংলাদেশ : মতিয়া চৌধুরী, সংসদ উপনেতা

পরের সংবাদ

একাত্তরের ২৫ মার্চের প্রত্যক্ষদর্শী সায়মন ড্রিং

প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২৫ মার্চ ১৯৭১ যখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কার্যত বন্দি এবং ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষায়, হোটেলের লবিতে সাংবাদিকদের জড়ো করা হলো- সায়মন তখন থেকে পালিয়ে যাওয়ার কৌশল খুঁজছেন। বিদেশি সাংবাদিকদের যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছে তিনি তখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ছাদে এয়ার কন্ডিশনার প্লান্টের নিচে লুকিয়ে। মাঝে মধ্যে ওপর থেকে উঁকি দিয়ে দেখছেন সাংবাদিকদের গাড়ি ছেড়ে গেল কি না।
গাড়িগুলো ছেড়ে যাওয়ার পরও আশঙ্কামুক্ত হলেন না। যখন গুনতিতে কম পড়বে কিংবা পত্রিকার নাম ধরে হাজিরা নেবে তার অনুপস্থিতির খবরটি ফাঁস হয়ে যাবে, তাকে ধরে নিতে সেনাবাহিনী আবার হাজির হবে।
গাড়ি ছাড়ার দেড় ঘণ্টা পর তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। রিসেপশনের বাঙালিরা তাকে দেখে বিস্মিত। তিনি সরেজমিন দেখে রিপোর্ট করবেন এবং তখনই বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছেন। তারাই তাকে জানায়, আরো একজন বিদেশি সাংবাদিক সেনাবাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে রয়ে গেছেন। সেই বিদেশি হচ্ছেন এসোসিয়েটেড প্রেসের ফটোগ্রাফার মিশেল লরেন্ট, (১৯৭২-এ পুলিৎজার বিজয়ী, ১৯৭৫-এর এপ্রিলে ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ প্রান্তে সায়গনে নিহত)।
দুজন একসঙ্গে বেরোলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ঘুরে ছবি তোলার সময় টহলরত সেনাবাহিনীর চোখে পড়ে যান। তারপর অবস্থান পরিবর্তন করে কোনোভাবে বেঁচে গিয়ে যখন হোটেলে ফিরে আসেন জানতে পারেন সেনাবাহিনী অনুসন্ধান করতে এসেছিল।
‘আল্লাহ এবং অখণ্ড পাকিস্তানের নামে।’
ঢাকার প্রত্যক্ষদর্শী সায়মন ড্রিংয়ের ব্যাংকক থেকে পাঠানো প্রতিবেদন, ৩০ মার্চ ১৯৭১ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত:
ঢাকা এখন বিধ্বস্ত ও আতঙ্কিত শহর। পাকিস্তানি সেনাবানিহীর টানা ২৪ ঘণ্টা শীতল মস্তিষ্কের নির্বিচার গোলাবর্ষণে ৭০০০ মানুষের হত্যাকাণ্ড ও বিশাল এলাকা গুঁড়িয়ে দেয়ার পর নির্মমভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার লড়াই স্তব্ধ করা হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দাবি, পরিস্থিতি এখন শান্ত, তা সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে, শহরের রাস্তাগুলো প্রায় পরিত্যক্ত এবং প্রদেশের অন্যান্য অংশে এখন হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই ট্যাঙ্কের সমর্থনপুষ্ট সেনাবাহিনীই এখন প্রধান শহর প্রধান লোকালয় নিয়ন্ত্রণ করছে এবং প্রতিরোধ যৎসামান্য এবং এখন পর্যন্ত সে প্রতিরোধ অকার্যকর। তার পরও নামমাত্র প্ররোচনাতেই জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে এবং কোনো বাছবিচার না করে ভবনগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।
পাকিস্তানের পূর্বাংশের ৭ কোটি ৩০ লাখ বাঙালির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনীকে প্রতিদিনই আরো বেশি প্রতিশ্রæতিবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। কত নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে ও ধ্বংসযজ্ঞে আসলে কত ক্ষতি হয়েছে তা নির্ধারণ করা অসম্ভব। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর থেকে যে মৃত্যুর প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে তাতে ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের মৃতের সংখ্যা ১৫ হাজার বলে অনুমান করা হচ্ছে।

সশস্ত্র আক্রমণ
নেতৃত্বস্থানীয় সক্রিয় রাজনীতিবিদদের জেলে ঢোকানো হয়েছে। অন্যদের হত্যা করা হয়েছে। শেখের আন্দোলনকে সমর্থনকারী দুটি সংবাদপত্র অফিস ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ২৫ তারিখ রাতে যখন ঢাকায় কামান নামানো হয় তখন সেনাবাহিনীর প্রথম টার্গেট ছিল ছাত্ররা। ঢাকায় আক্রমণের জন্য আনুমানিক তিন ব্যাটালিয়ন সৈন্য ব্যবহার করা হয়েছে : একটি সাঁজোয়া, একটি গোলন্দাজ এবং একটি পদাতিক।
রাত ১০টা বাজার একটু আগে তারা ব্যারাক ছাড়তে শুরু করে। রাত ১১টায় গুলিবর্ষণ শুরু হয়; জনগণ তখন তাড়াতাড়ি গাড়ি উল্টে, গাছের গুঁড়ি, আসবাব, কংক্রিটের পাইপ ইত্যাদি ফেলে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করছিল, তারাই গুলিতে বলি হয়।
শেখ মুজিবকে ফোন করে জানানো হয় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি বাড়ি ছাড়তে অস্বীকার করেন। গ্রেপ্তার এড়াতে সমর্থ হয়েছেন এমন একজন সহযোগীকে তিনি বলেছেন ‘আমি যদি লুকিয়ে যাই তাহলে আমার খোঁজে ঢাকার সব বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলবে।’

২০০ ছাত্র নিহত
ছাত্রদেরও সতর্ক করা হয়েছিল, কিন্তু তার পরও যারা ছিল তারা ভেবেছে বড়জোর তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। মারণাস্ত্রের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের জোগান দেয়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালের এম-২৪ কামান, মধ্যরাতের ঠিক পরপরই কামানের পেছনে সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগোয়। তারা ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখল করে নেয় এবং এখানেই ভিত্তি গেড়ে আশপাশের ডরমেটরিতে সেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে।
সম্পূর্ণ হতবাক ২০০ ছাত্র ইকবাল হলে নিহত হয়। ইকবাল হলেই সরকারবিরোধী জঙ্গি ছাত্রদের সদর দপ্তর। তাদের দেয়ালে গোলা আঘাত করেছে আর দরজায় মেশিনগানের গুলি। দরজার বাইরে দুটো পোড়া দেহ, বাইরে অনেক ছড়ানো-ছিটানো মৃতদেহ, অনেক লাশ নিকটবর্তী খালে ভাসমান।
ইজেলের ওপর উপুর হয়ে পড়ে আছে চিত্রকলার একজন ছাত্র। সাতজন শিক্ষককে তাদের বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে; বাইরের একটি বাড়িতে লুকিয়ে থাকা ১২ জনের সবাইকে হত্যা করেছে। সেনাবাহিনী অনেক মৃতদেহ সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ইকবাল হলের করিডোরে তখনো পড়ে থাকা ৩০টি মৃৃতদেহ হয়তো গোনায় ধরেনি। অন্য একটি হলে গণকবর খনন করে সৈন্যরা মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যাদের বসবাস আগুন থেকে তারা নিষ্কৃতি পায়নি। রেললাইনের গা-ঘেঁষা ২০০ বাড়ি তারা পুড়িয়ে ফেলেছে।
সেনা প্যাট্রোল তাদের কাছাকাছি বাজার এলাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে, দোকানের গলিপথ দুদিকে গুলি করে ঘুমন্ত দোকানদারদের হত্যা করেছে। দুদিন পর বেরিয়ে যখন এসব দৃশ্য দেখা সম্ভব হলো, মনে হলো কাঁধের ওপর কাঁথা টেনে কেউ কেউ তখনো ঘুমিয়ে আছে। একই এলাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে সরাসরি কামানের অগ্নিগোলা আঘাত করেছে, একটি মসজিদও বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর আক্রান্ত
যখন বিশ্ববিদ্যালয় আক্রান্ত হয় তখন সৈন্যের বহর পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদর দপ্তর রাজারবাগের দিকে এগিয়ে যায়। প্রথম ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়, তারপর সৈন্যরা ভেতরে ঢুকে পড়ে, ঘুমন্ত কোয়ার্টারগুলো গুঁড়িয়ে দেয়, ভবনগুলোর ভেতরে অগ্নিবোমা নিক্ষেপ করে। এমনকি উল্টোদিকে যারা থাকেন তারাও জানেন না ক’জন নিহত হয়েছে। তবে তা ছিল ১১০০ পুলিশের ঘাঁটি, সেখানে তেমন বেশি কেউ মৃত্যু এড়াতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

৩২ নম্বর
একজন প্রতিবেশী বললেন, রাত ১টা ১০ মিনিটে একটি ট্যাঙ্ক, কটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্রাকভর্তি সৈন্য বাড়িটিতে গোলাগুলি করতে করতে এগিয়ে এসেছে। বাড়ির সামনে নেমে একজন অফিসার ইংরেজিতে চেঁচিয়ে বলেছেন, ‘শেখ, আপনার নেমে আসা উচিত।’
ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘হ্যাঁ আমি প্রস্তুত আছি, গোলাগুলি করার প্রয়োজন ছিল না। তোমাদের উচিত ছিল টেলিফোনে আমাকে ডাকা, আমি এসে হাজির হতাম।’ অফিসার তখন হেঁটে বাড়ির বাগানের ভেতরে গেলেন এবং বললেন, ‘আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে তিনজন ভৃত্য, একজন সহযোগী এবং তার বডিগার্ড, বডিগার্ডকে ভীষণ মারধর করা হয়, কারণ তিনি অফিসারকে অপমান করতে শুরু করেছিলেন।
তাকে নিয়ে তারা রওনা হয়, সম্ভবত সেনা সদর দপ্তরের দিকে। সৈন্যরা তার ঘরে ঢুকে সব দলিল-দস্তাবেজ তুলে নেয়। সামনে যা পায় ভাঙচুর করে। বাগানের গেটে তালা দেয়, সবুজ লাল ও হলুদ রঙের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকায় গুলি চালায়, তারপর চলে যায়।
সে রাতের ২টায় (২৫ মার্চ দিবাগত, ২৬ মার্চ) গোটা শহর আগুনে জ্বলছে। সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ও সন্নিহিত এলাকার দখল নিয়ে ছাত্রদের গুলি করে, তারা স্বাধীন বাংলার পতাকা লুকিয়ে পাকিস্তানের পতাকা ওঠাচ্ছিল। তখনো কোনো কোনো এলাকায় সেনাবাহিনী সেল নিক্ষেপ করে চলেছে। যদিও লড়াইয়ের তীব্রতার লক্ষণীয় হ্রাস ঘটেছে।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উল্টোদিকে ঢাকার (ইংরেজি দৈনিক) পিপল-এর জনশূন্য অফিসে ঝটপট ঢুকে পড়ে সৈন্যরা তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আশপাশের বাড়িঘরেও আগুন লাগে, একজন নাইটগার্ডকে হত্যা করে। ভোরের সামান্য আগে গোলাগুলি থেমে আসে।
ভয়ংকর এক নীরবতার শহরের ওপর সূর্য উদিত হয়; শহরটি বিরান এবং সম্পূর্ণ মৃত, কেবল কাক এবং সৈন্যদের গাড়িবহরের আওয়াজ ভেসে আসে।
পরবর্তী ১১ ঘণ্টা তারা পদ্ধতিগতভাবে এই অঞ্চল ধ্বংস করে চলল। ঢাকার জনগণের মধ্যে এখানেই শেখ মুজিবের সমর্থন সবচেয়ে বেশি। ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোড, নাজিরা বাজার, সিটিবাজার অর্থহীন নাম, তারা সহস্র মানুষের নিবাস পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিল। …অগ্রগামী সৈন্যদের হাতে পেট্রোলের ক্যান। যারা পালাতে চেষ্টা করল, গুলিবিদ্ধ হলো। যারা ভেতরে রয়ে গেল আগুনে পুড়ে মরল। দুপুর ১২টা থেকে ২টার মধ্যে ৭০০ পুরুষ-নারী ও শিশু মৃত্যুবরণ করল। পুরনো শহরের থানাও আক্রান্ত হলো। শনিবার সকালে একটি বাজারের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বললেন, আমার জেলায় (এলাকায়) ২৪০ জন পুলিশ ছিল, মাত্র ৩০ জনকে পেয়েছি সবাই মৃত।

গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আক্রমণ
বৃহস্পতিবার শেষ রাতে যে গোলাবর্ষণ শুরু হয়েছে তা ঢাকা ও অন্যান্য শহরকে সাময়িকভাবে হলেও শুক্রবারের মধ্যে সেনা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এসেছে। মধ্যরাতে শহরের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়ার পর সেনাবাহিনী বিনা উসকানিতে তিন ঘণ্টা অবিরাম গোলাবর্ষণ করে চলেছে। তারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো আক্রমণ চালিয়েছে এবং বহুসংখ্যক বাড়িঘরে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
শুক্রবার রাস্তাগুলো জনশূন্য ছিল। তবে ছোট অস্ত্রের গুলি ও কামানের গোলার শব্দ শোনা গেছে। দিনভর যুদ্ধসাজে সৈন্যরা ট্যাঙ্ক ও ট্রাকে চড়ে শহরে টহল দিয়েছে। ঢাকার সংঘর্ষে বহুসংখ্যক বেসামরিক জনগণের নিহত ও আহত হওয়ার কথা। সে তুলনায় সেনাবাহিনীর ক্ষতি সামান্য। ঢাকার সঙ্গে প্রদেশের অন্যান্য অংশ এবং দেশের বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় সেনাবাহিনী কীভাবে দখলদারিত্ব বিস্তার করছে তা বলা অসম্ভব। ‘আমরা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছি’- বৃহস্পতিবার রাতে কী ঘটেছে এর বাইরে কিছু বলতে সেনা কমান্ডাররা অস্বীকৃতি জানান।
সাংবিধানিক সংকট সমাধানে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পরই সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
বৃহস্পতিবার রাত ৮টার পরই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি যে হোটেলে ছিলাম হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বাইরে মোতায়েন করা সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়। রাত ১১টায় পর্যন্ত সবই শান্ত ছিল; হঠাৎ এক পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন এসে আদেশ করল কেউ হোটেল থেকে বের হতে পারবে না।
ক্যাপ্টেন বলল, আমি হুকুম নিয়ে এসেছি। কী ঘটতে যাচ্ছে আমার জানা নেই। আমি কেবল জানি, তোমরা কেউ বাইরে এলে আমি তোমাদের গুলি করব। যদিও তখন রাস্তায় গাড়ি চলছিল, মানুষ দ্রুত যার যার বাড়ি ফিরছিল, বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির শব্দ শুনতে থাকলাম। হোটেলের বার ও রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেয়া হলো যেন কর্মচারীরা দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারে, কিন্তু কার্ফুর কারণে তারা বের হতে পারল না।
শুক্রবার ভোরের দিকে ঢাকায় গোলাগুলির মাত্রা যখন বেড়ে চলছিল, আওয়ামী লীগ সমর্থকরা রাস্তায় জমায়েত হয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। সকালের দিককার অধিকাংশ গোলাগুলি এয়ারপোর্টের দিক থেকে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা হতবুদ্ধি ও স্নায়ুপীড়িত জুলফিকার আলী ভুট্টো সদলবলে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে হোটেল অবস্থানের সময় নিবিড় পাহারায় ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান শুক্রবার রেডিওতে বলেন, প্রশাসন অগ্রাহ্য করার ঘটনা আতঙ্কিত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যা বেসামরিক পুলিশ ও সৈন্যদের স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’ এবং ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ পাকিস্তানি সরকারি রেডিও গতরাতে এই ভনিতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। রেডিও জানিয়েছে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ দমনে উড়োজাহাজে বাড়তি সৈন্য চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছে।

ট্যাঙ্ক যেভাবে একটি শহর গুঁড়িয়ে দিল
বৃহস্পতিবার রাতে কোনো ধরনের আগাম সতর্কতা ছাড়াই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সবাইকে বিস্মিত করে বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এম ২৪ ট্যাঙ্ক, গোলন্দাজ ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে প্রদেশের রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
সেনাবাহিনীর প্রধান নিশানা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, জনাকীর্ণ পুরান ঢাকা যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের সমর্থন সবচেয়ে বেশি এবং ১৫ লাখ মানুষের এই শহরের বাইরের শিল্পাঞ্চল। কেবল রাজধানীতেই সম্ভবত সাত হাজার লোক নিহত হয়েছে। শনি ও রবিবার যারা বের হয়েছেন তারা তখনো আগুন জ্বলছে এমন অনেক স্থান দেখতে পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের বিছানায় পাওয়া গেছে অগ্নিদগ্ধ ছাত্রের মৃতদেহ। ট্যাঙ্ক সরাসরি ছাত্রাবাসে আঘাত করে।
জগন্নাথ কলেজে (হলে) তড়িঘড়ি করে গণকবর দেয়া হয়েছে। ইকবাল হলে নিহত ২০০ ছাত্র। তখনো ছাত্রাবাসের সামনে প্রায় ২০টি মৃতদেহ পড়ে ছিল। সেনারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওপর বাজুকা নিক্ষেপ করেছে। সেখানে হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি।
(উৎস : আন্দালিব রাশদীর বিদেশির চোখে ১৯৭১ ও একাত্তরের দশ বিদেশি সাংবাদিক)

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়