প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তারা : রাখী দাশ পুরকায়স্থ ছিলেন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক

আগের সংবাদ

বধ্যভূমি দেখার দায়িত্ব কার : সারাদেশে ৫ হাজারের বেশি বধ্যভূমি, ২২ বছরে ২০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ হয়েছে

পরের সংবাদ

সড়কে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে : আইন ও বিধিমালার পরও সড়ক আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নেই

প্রকাশিত: মার্চ ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেব দুলাল মিত্র : সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর বিধি প্রণীত হওয়ার পরও সড়কে এই আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নেই। আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় সড়ক ব্যবস্থা আবারো ভেঙে পড়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে আগের মতোই নৈরাজ্য চলছে। রাজধানীতে চলন্ত অবস্থায় বাসের গেট খুলে রাখা হচ্ছে। চালকরা ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে। চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও যানবাহনের গতির নিয়ন্ত্রণ নেই, বাসে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও পরিচয়পত্রের ফটোকপিও টানানো নেই। কোনো বাসেই বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা খুঁজে পাওয়া যায় না। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশের অসততা, অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থাপনা, চালকদের অদক্ষতা, সরকারি সংস্থা বিআরটিএর উদাসীনতার কারণেও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না।
মাদারীপুরের শিবচরে গত রবিবার ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত ও কমপক্ষে ২০ জন গুরুতর আহত হয়। এই দুর্ঘটনার পর মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেছেন, ইমাদ পরিবহনের বাসটি হাইওয়েতে নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে চলার কারণে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং বাসটি পাশের খাদে ছিটকে পড়লে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। বাসচালকের বেপরোয়া গতিই এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
ইমাদ পরিবহনের বাসটির মতো রাজধানীসহ দেশের সব সড়ক-মহাসড়কে বাসচালকের বেপরোয়া গতি এখনো অব্যাহত রয়েছে। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে ৬২ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও অনিয়ন্ত্রিত গতি। সড়ক আইনে বেপরোয়া গতির জন্য যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে তা একেবারেই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সড়কে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা আইন অনুযায়ী মামলা করার ভয় দেখিয়ে উৎকোচ নিয়ে নিজের পকেট ভারি করছে। ফলে চালকরাও সড়ক আইন নিয়ে কোনো মাথা ঘামাচ্ছে না, আইন অমান্য করেই চলেছে। সড়ক আইন পাস হওয়ার পর প্রথমে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কিছু

ধারার বিষয়ে আপত্তির কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। প্রায় দুই বছর পর আইনটির আংশিক বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু আইনের বিধি না থাকায় পুলিশ সড়কে আইন বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হয়, তবে তখন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল। আইন পাসের ৪ বছর পর গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। পরে ২৭ ডিসেম্বর এটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। আইনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর বিস্তারিত বর্ণনা ১৯১ পৃষ্ঠার বিধিমালায় রয়েছে। এখন সড়ক পরিবহন আইন শতভাগ বাস্তবায়নে প্রক্রিয়াগতভাবে কোনো বাধা নেই। কিন্তু এখন আইন ও বিধি থাকার পরও সড়ক-মহাসড়কের সার্বিক পরিস্থিতি আবারো ভেঙে পড়েছে। বেড়েছে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০২২ সালে সারাদেশে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছে।
রাজধানীর সড়কগুলোতে দেখা যায় হেলমেট ছাড়াই মোটরসাইকেলচালকরা বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে। এক মোটরসাইকেলে তিনজন চলছে। হরহামেশা সিগন্যাল অমান্য করছে। বাসচালকরা এখনো বেপরোয়া, নিজেদের ইচ্ছেমতো বাস চালাচ্ছে এবং মাঝ রাস্তায় থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে। উল্টো পথেও মোটরসাইকেল, রিকশা, গাড়ি অবাধে চলাচল করছে। চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণেই বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। রাজধানীসহ দেশের কোনো সড়ক-মহাসড়কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেই। বাসে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও পরিচয়পত্রের ফটোকপিও টানানো নেই। অভিযোগ রয়েছে, এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মেট্রোপলিটন পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের যেন কোনো আগ্রহ নেই। পুলিশ সবকিছু দেখেও এমন ভাব করছে যেন এ বিষয়ে তাদের কোনো দায়িত্ব নেই। আইন অমান্য করলেও ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ চালকদের বিরুদ্ধে সড়ক আইনে মামলা দেয়ার ভয় দেখায়, কিন্তু মামলা দেয় না। তারা কিছু উৎকোচ নিয়ে চালকদের ছেড়ে দেয়। এ কারণে আইন মানার প্রতি চালকদেরও কোনো আগ্রহ নেই।
সড়ক পরিবহন বিধিমালার ১২টি অধ্যায়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স, মেয়াদ, নবায়ন প্রভৃতি; কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার লাইসেন্স; মোটরযান রেজিস্ট্রেশন, মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস প্রভৃতি; পরিবহন কমিটি, রুট পারমিট প্রভৃতি; মোটরযানের নির্মাণ, সরঞ্জাম বিন্যাস ও রক্ষণাবেক্ষণ; ট্রাফিক ও ওজনসীমা নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ দূষণ প্রভৃতি; দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা এবং বীমা; মোটরযান ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল, ইনস্ট্রাক্টর লাইসেন্স, মোটরযান মেরামত কারখানা প্রভৃতি; পুনর্বিবেচনা ও আপিল পদ্ধতি; জরিমানা আরোপ ও আদায় পদ্ধতি; বিবিধ (সেবা কার্যক্রম ডিজিটাইজেশন নিয়ে) বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। বিধিমালায় কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার লাইসেন্স মঞ্জুরের শর্তে বলা হয়েছে, বয়স কমপক্ষে ২০ বছর হতে হবে। কন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা পঞ্চম শ্রেণি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং সুপারভাইজারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি বা জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। বিধিমালা অনুযায়ী মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ছাড়া দক্ষতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কিন্তু দেখা গেছে এসব আইন সততার সঙ্গে শতভাগ প্রয়োগ হচ্ছে না।
বিধিমালায় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করা হলে দুর্ঘটনা অর্ধেকে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সড়ক পরিবহন আইন শতভাগ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আইন বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর সদস্যদের কঠোর অবস্থানে থেকে কাজ করতে হবে। এদের অবহেলার কারণে বাস ও অন্য পরিবহনের চালকরা আইন অমান্য করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, তা আমাদের নিজেদের তৈরি। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের দেয়া ১১১ সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ পাস হওয়ার পরও মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আইন ও বিধিমালা জারি হওয়ার পরও শতভাগ বাস্তবায়ন না হওয়া জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক। চালকদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস দেয়ার ক্ষেত্রে বিআরটিএর গুরুদায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু তাদের উদাসীনতার কারণে পুরো জাতিকে খেসারত দিতে হচ্ছে।
অন্যদিকে যাত্রী ও পথচারীদের সচেতনতা আগের চেয়ে একটুও বাড়েনি। পথচারীরা ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করে না। হাত তুলেই দ্রুতগামী গাড়ির সামনে দিয়ে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার হচ্ছে। রাস্তার মাঝখানেই বাসে ওঠানামা করছে। সব মিলিয়ে সড়কের নৈরাজ্য বন্ধ করা যায়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়