দুদক চেয়ারম্যান : দুর্নীতি নির্মূলে প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে দুদক

আগের সংবাদ

সড়কে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে : আইন ও বিধিমালার পরও সড়ক আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নেই

পরের সংবাদ

বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন

প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মাস্টারদা সূর্য কুমার সেন (সূর্য সেন), বিপ্লবী মহানায়ক খ্যাত ব্রিটিশ ভারত তথা অবিভক্ত ভারতের মুক্তির সংগ্রামে চির ভাস্বর এক ব্যক্তিত্ব। মাস্টারদা সূর্য সেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে, স্মৃতিতে, সংগ্রামে অনুকরণীয় ও শ্রদ্ধেয় এক চরিত্র। ব্রিটিশ শোষকদের বিতাড়নের লড়াই সংগ্রামে বীরের মতো পদচারিত ছিলেন মাস্টারদা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ইতিহাসে বাঙালি তথা বাংলার বিপ্লবীদের ত্যাগ দৃঢ়তা, সফলতার ক্ষেত্রে মাস্টারদা সূর্য সেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
২২ মার্চ ১৮৯৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মাস্টারদা সূর্য কুমার সেন (সূর্য সেন) ওরফে কালু। রাজমনি সেন ও শশীবালা দেবীর চতুর্থ সন্তান ছিলেন সূর্য সেন। ছোটবেলা থেকেই স্বামী বিবেকানন্দের জীবনাদর্শ ও বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে অধ্যয়ন অবস্থা কলেজের অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে বৈপ্লবিক আদর্শে দীক্ষিত হন। ১৯১৯ সালের পাঞ্জাবের জালিযানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের ছাত্ররা ক্লাস বর্জনসহ সভা-সমাবেশ করে। সভায় মাস্টারদা সূর্য সেন তার বক্তব্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। ব্রিটিশ মালিকানাধীন জাহাজের শ্রমিকদের সফল ধর্মঘট, ব্রিটিশ মালিকানাধীন সিলেট ও কাছাড়ের চা বাগান শ্রমিকদের ধর্মঘট ও চাঁদপুরে ধর্মঘটি শ্রমিকদের ওপর পুলিশ এবং গোর্খা সৈন্যদের গুলিবর্ষণে অনেকের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে আসাম-বেঙ্গল রেল ধর্মঘট শুরু হয়। মাস্টারদা সূর্য সেন অসহযোগ আন্দোলনে সর্বোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি কংগ্রেসের কাজ ও গোপনে বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। আন্দোলন পরিচালনার জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজন ছিল। অর্থের জোগানের জন্য তারা আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের বেতনের টাকা লুণ্ঠন করেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরই মাস্টারদা সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ১৯২৮ সালের শেষ দিকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। বিক্ষোভ মিছিল ও সভায় নেতা মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লবের পরবর্তী কার্যক্রমের পরিকল্পনা সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন। বিপ্লবীরা স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন। তারা ‘মৃত্যুর কর্মসূচি’ ঘোষণা করেন। প্রথমে ব্রিটিশদের ওপর হামলার জন্য ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাস নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পুলিশি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এর তারিখ পিছিয়ে যায়। মাস্টারদা গোপনে ইশতেহার প্রচার করেন। ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০, সন্ধ্যার অন্ধকারে ধুম রেলস্টেশনে লাইনচ্যুত করা হলো মালবাহী ট্রেন। বিপ্লবীরাই খুলে রেখেছিল লাইনের ফিশপ্লেট। অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহরের টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসের যন্ত্রাংশে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। ধ্বংস হয়ে গেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। নাঙ্গলকোট রেলস্টেশনের কাছেও রেললাইনে উড়িয়ে দেয়া হলো।
সেদিন গুড ফ্রাইডের জন্য ক্লাব বন্ধ থাকায় ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ সফল হলো না। ১৯ এপ্রিল, ১৯৩০, ভোরের আগেই সবকটা দল এসে পরিকল্পনামাফিক জড়ো হলো পুলিশ লাইনে। সবাই এরপর মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এবার শত্রæর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা গেরিলা পদ্ধতি গ্রহণ করবেন, আশ্রয় নেবেন পাহাড়ের কোলে। সেই মতো ভোর হবার পূর্বেই বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করেন এবং নিরাপদ ভেবে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। টেলিযোগাযোগ থাকায় জেলা প্রশাসক হাতে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে সেখানে নোঙর করা জাহাজের রেডিও বার্তার মাধ্যমে বাইরের উচ্চ-পদাধিকারীদের কাছে চট্টগ্রামের খবর পাঠিয়েছিলেন। অধিক সৈন্য পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করার আকুতি জানালেন। ২২ এপ্রিল, ১৯৩০, জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীরা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ট্রেনে করে আসা কয়েক হাজার সৈন্য এসে বিপ্লবীদের ঘিরে ফেলে। দুই ঘণ্টা প্রচণ্ড সম্মুখ যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন সৈন্য এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে বিপ্লবীদের পার্শ্ববর্তী গ্রামে লুকিয়ে রাখেন এবং পরে সবাই পালাতে সক্ষম হন। ব্রিটিশ শাসকরা নাজেহাল হয়ে মাস্টারদাকে ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। প্রায় ৩ বছর আত্মগোপনে থাকেন মাস্টারদা সূর্য সেন। মাস্টারদা সূর্য সেন পটিয়া উপজেলার গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে এক বৈঠকে ছিলেন। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর টাকার লোভে পুলিশকে জানিয়ে দিলে প্রায় ১০টার দিকে পুলিশ আর সেনাবাহিনী ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ মাস্টারদা সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন।
মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর করার আগে ব্রিটিশ সেনা ও জেল পুলিশ মিলিতভাবে হাতুড়ি দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে তাদের দাঁত, হাড় ভেঙে, মুখ থেঁতলে অর্ধমৃতদেহ দুটি ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। ফাঁসির পর লাশ দুটি ব্রিটিশ জাহাজে করে শরীরের সঙ্গে লোহা বেঁধে ভারত মহাসাগরের কাছাকাছি কোনো স্থানে পানিতে ফেলে দেয়। ব্রিটিশদের ভয় ছিল, তাদের ভূমিতে সমাহিত করতে দিলে হাজারো সূর্য সেন, হাজারো তারকেশ্বর জন্মাবে।
আমরা স্মরণ করতে চাই, সে সব বিপ্লবীকে যারা, মাস্টারদার সঙ্গে সার্বক্ষণিক দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন এবং জীবনদান করে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য দেখার পথ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে স্মরণ করি বিপ্লবী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদারকে, যিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে একই দিন, একই সময়, একই মঞ্চে ফাঁসিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এক বিশাল বিষয়। সব আত্মত্যাগী বিপ্লবীর ইতিহাস প্রাপ্য মূল্যায়নে ইতিহাসে সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। মাস্টারদা সূর্য সেন আমাদের ইতিহাস, আমাদের প্রেরণা, আমাদের প্রজন্মের উদাহরণ। জন্মদিনে মাস্টারদা সূর্য সেনকে জানাই শ্রদ্ধা ও লাল সালাম।

তপন ভট্টাচার্য্য : অর্থ সম্পাদক, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ, চট্টগ্রাম।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়