দুদক চেয়ারম্যান : দুর্নীতি নির্মূলে প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে দুদক

আগের সংবাদ

সড়কে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে : আইন ও বিধিমালার পরও সড়ক আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নেই

পরের সংবাদ

ঘরের সঙ্গে নতুন জীবন পেলাম

প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান, সিলেট থেকে : অভাবের তাড়নায় আমাদের ছোট বেলায়ই শেষ সম্বল ভিটামাটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন বাবা। এরপর ৩২ বছর ধরে ভাড়া থেকেছি। নিজের একটি ঘর হবে- এটা ভাবাও ছিল স্বপ্নের মতো। তাই আজকে আমার জীবনের সেরা দিন। এত খুশি হয়েছি, বলে বোঝানোর মতো না। কারণ আমরা শুধু ঘর না, নতুন জীবন পেয়েছি। এখন থেকে একটাই লক্ষ্য- অভাব দূর করা। ঘরের দলিল হাতে উচ্ছ¦াস প্রকাশ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন দিনমজুর মো. আবদুল লতিফ।
শুধু লতিফই নন, গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিসহ ঘর পাওয়া ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষরা এভাবেই নিজেদের আনন্দ-উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেন। তাদের চোখেমুখে দেখা যায় ঈদের আনন্দের ছাপ, খুশির হিল্লোল। কথা বলে মনে হলো- ঘর পাওয়া মানুষগুলোর জীবনের কালো মেঘ কেটে গিয়ে দেখা দিয়েছে জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার নতুন আশার আলো। গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরগুলো উদ্বোধনের পর সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নওয়াগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পের সার্বিক চিত্র ছিল এমনই।
সরজমিনে দেখা যায়, গোয়াইন ঘাটের নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের নওয়াগাঁওয়ের এই আশ্রয়ণ প্রকল্পটি ভারতের চেরাপুঞ্জি লাগোয়া, উঁকি দিলেই খালি চোখে দেখা যায় চেরাপুঞ্জির পাহাড়ি বনভূমি। পাহাড়ের কোলঘেঁষা, খাল-বিল ও হাওড় বেষ্টিত অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমির সরকারি অনাবাদি খাস জমিতে গড়ে উঠেছে এই আশ্রয়ণ প্রকল্প- যার তিন কিলোমিটার দূরেই গোয়াইন নদী।
৫ একর ৩৬ শতাংশ জায়গাজুড়ে গড়ে উঠা এ আশ্রয়ণের সব ঘরই বরাদ্দ পেয়েছে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। ভূমির মালিকানাসহ সম্পূর্ণ সরকারি খরচে নির্মিত দুটি কক্ষ, একটি প্রশস্ত বারান্দা, একটি স্যানিটারি টয়লেট ও একটি রান্নাঘর সংবলিত বাড়ি উপহার দেয়া হয় তাদের। আনুষ্ঠানিকভাবে ভূমির দলিল হাতে পাওয়ার পর উচ্ছ¡াসের জোয়ারে ভাসেন উপকারভোগীরা। ঘর পেয়ে নিজের মতো করে গোছগাছ করতে থাকেন সবাই।
এর আগে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে গোয়াইনঘাটসহ দেশের ১৫৯ উপজেলায় প্রায় ৪০ হাজার আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নওয়াগাঁও প্রান্তে ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জেবুন্নেসা হক, জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এমএম ইমরুল কায়েস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান প্রমুখ। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তিনটি আমের চারা রোপণ করা হয়।
ঘর পাওয়া মো. আবদুল লতিফ ভোরের কাগজকে বলেন, ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের সম্বল বলতে শুধু ভিটেমাটিটুকুই আছে। অভাবের তাড়নায় বাবা সেটিও বিক্রি করে দেন। এরপর থেকে রাস্তায় রাস্তায় ছাপড়া ঘরে ও মামার বাড়িতে বড় হয়েছি। একটু বড় হয়ে যখন আয় করা শিখলাম, তখন থেকে সিলেট শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতাম। এভাবে কেটেছে ৩২ বছর। সংসার হয়েছে। ২ মেয়েও আছে। কিন্তু ঘর না থাকায় সবসময় ওদের ভবিষ্যৎ ও বিয়ে নিয়ে চিন্তা কাজ করতো। ওদের মা আকলিমা মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় চিন্তা ছিলো আরো বেশি। এখন ঘর পেলাম। ঘর ভাড়া বাঁচিয়ে ওর (স্ত্রীর) চিকিৎসা করাতে পারব। মেয়েদের বিয়ে দিতে সমস্যা হবে না। অনেকে এক জায়গায় থাকায় আকলিমাকে নিয়েও চিন্তা কমবে।
আশ্রয়ণের ঘর পাওয়া ট্রাকচালক আজাদ মিয়ার স্ত্রী জয়েনা খাতুন বলেন, রানীগঞ্জে ২ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকতাম। কখনো ভাবিনি নিজেদের বাড়ি হবে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর দিয়েছেন। নিজের ঘর দেখার আনন্দ আর চেপে রাখা যাচ্ছিল না। তাই ৪ দিন আগে থেকেই বারবার ঘর দেখতে এসেছি। এখন ঘরের মালিকানা বুঝে পেলাম। নিজের মতো করে সাজিয়ে তুলব।
দিনমজুর নুরুল আমিন বলেন, জন্মের পর থেকেই দেখেছি, আমরা ভূমিহীন। ক্ষেতখামারে কাজ করে জীবন চালাতাম। এমন ঘর আমাদের কাছে স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু।
তাদের মতোই নওয়াগাঁও আশ্রয়ন প্রকল্পে মোট ১০০ জন ঘর পেয়েছেন। যাদের মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও অতি নি¤œআয়ের মানুষ। কেউবা আবার মৌসুমি মৎস্যজীবী। এদের প্রায় সবাই সমাজের মূল স্রোত থেকে ছিটকে পড়েছিলেন, অনেকেরই বেঁচে থাকার স্বাদ ও জীবন সূর্যের আলো প্রায় নিভে গিয়েছিল।
তাদেরই একজন স্বামী পরিত্যক্তা ও তিন সন্তানের মা পারভীন বেগম (৩৫)। চার বছর আগে তিন সন্তানসহ পারভীন বেগমকে ছেড়ে চলে যান স্বামী। এরপরই দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসে তার জীবনে। সন্তানসহ ঠাঁই হয় বাবা ইউনুসের আলী বাড়িতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস; পারভীন বেগমের বাবা ইউনুস আলীর পৈতৃক ভিটামাটিও নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। এরপর গৃহহীন বাপ-মেয়ে অন্যের জমিতে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেন। ঝড়-বৃষ্টি হলেই উড়ে যেত তাদের ঝুপড়ির ছাউনি। বন্যায় তলিয়ে গেলে ঠাঁই হতো সরকারি স্কুলে কিংবা আশ্রয় কেন্দ্রে।
পারভীন বেগম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে আমার জীবনের অনেক দুঃখ-কষ্ট দূর হয়েছে। প্রথম দিন ঘরের প্রবেশ করে খুশিতে কান্নাও করেছি। কল্পনাও করিনি কখনো এমন একটা পাকা ঘরে বসবাস করব। আমি এখন ৩ সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার সাহস পাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, এখন আমি হাঁস-মুরগি পালন করে এবং মানুষের বাড়িতে কাজ করেই সংসার চালাতে পারব। পড়াশোনা করিয়ে তিন সন্তানকে মানুষ করাই এখন আমার একমাত্র স্বপ্ন।
পারভীনের মতোই আরেক উপকারভোগী বাকপ্রতিবন্ধী নূর মোহাম্মদ লাদেন (৩৩)। শারীরিক কর্মক্ষমতা না থাকায় মানুষের কাছে হাত পেতেই চলে তার জীবন। প্রতিবন্ধী ছেলের পাওয়া ঘরটি পরিষ্কার করে দিচ্ছিলেন মা খচরুন বেগম। বিদ্যুতের সুইচ টিপে দেখছিলেন তা ঠিক আছে কিনা। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, তিন বেলা খাবার জোটাতেই আমাদের কষ্ট হয়। টাকার অভাবে ছোটবেলায় বাক প্রতিবন্ধী ছেলেটার কোনো চিকিৎসাই করাতে পারিনি। এখন আমার ছেলে সরকারের দেয়া পাকা ঘর পেয়েছে, যা আমি জীবনেও কল্পনা করিনি। এ জন্য আল্লাহর কাছে প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করি আমরা।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান বলেন, যারা এক বছর আগে বা দুই বছর আগে ঘর পেয়েছেন, তাদের জীবনমানে বেশ ভালো পরিবর্তন এসেছে। আশা করি, নওয়াগাঁওয়ের এই নতুন আশ্রয়ণ প্রকল্পেও অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন হবে, যা হবে একটি মাইলফলক। তিনি জানান, গোয়াইনঘাট উপজেলায় গতকাল মোট ১৭০টি ঘরের উদ্বোধন হয়েছে এবং এই উপজেলায় সবমিলিয়ে ১১০১টি ঘর হচ্ছে। যার মধ্যে ১২৪টির নির্মাণ কাজ চলছে। বাকিগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়