ইন্ডিয়ান হায়ার এডুকেশন মিট উদ্বোধন

আগের সংবাদ

ভোরের কাগজ, এনজিও ফোরাম ও বাউইনের সেমিনারে বক্তারা : এসডিজি ৬ অর্জনে কার্যক্রম বেগবান করার তাগিদ

পরের সংবাদ

মুখের ওপর মুখের ছাপচিত্র

প্রকাশিত: মার্চ ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেলিম মামার দোকানে বসে ঢকঢক করে দুই গøাস পানি মারলাম। শুকনো গলায় পানি পড়তেই বেশ ভালো লাগছে। হালচাষ করা চৈত্রের মাঠের মতো। বৈশাখের প্রথম বৃষ্টির জলে ভিজে যেমন করে নরম হয় মাটির টনটনা দলা। আজ আমার মন বড্ড খারাপ। চোখের কোণে নোনাজলের তুমুল উৎপাত। যেন চোখ থেকে খসে পড়তে পারলেই বাঁচে। অথচ আমি দাঁতে দাঁত চেপে হজম করার চেষ্টা করছি প্রতাপশালী সেই যন্ত্রণাটা।
‘কিছু অইছে, মামা? কিমুন যেন ফ্যাকাইস্যা লাগতাছে আপনেরে!’ সেলিম মামার গলা শুনে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে আমার। আশপাশে তাকাই। না, কেউ নেই। বোকামির এই গল্প ক্যাম্পাসে ভাইরাল হওয়ার সুযোগটাও তাই কম। মুরগি হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। ঈদের ছুটিতে সবাই যে যার মতো বাড়ি চলে গেছে। হল বন্ধ হয়েছে আরো তিন দিন আগে। এখন হলে আছি আমি আর সেলিম মামা। সেলিম মামা ঢাকাতেই ঈদ করেন। চামে ঢাকাইয়া এক মেয়েকে পটিয়ে ঘরজামাই হয়েছেন। সেই দুর্ধর্ষ প্রেমের গল্প খুব ক্ষীণ গলায় একদিন আমাকে বলেছিলেন। মামার শ্বশুর অবস্থাশালী লোক। নিউমার্কেটে কাপড়ের দোকান। সেই দোকানেই মামা কাজ করতেন। সেখান থেকেই মামিদের বাসায় মামার প্রতিদিন আসা-যাওয়া। গুল্লু মার্কা চেহারা ছিল মামার। দুধে আলতা রঙের না হলেও বেশ ভালো লাগল দেখতে। তাগড়া যুবক! কী যে মায়ার চেহারা ছিল তার! মামি নাকি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। ব্যস। টপ্পাস করে মামি মামার বুকের মধ্যে ঢুকে গেলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিজেকে দিয়ে ভোগ করছেন মামার সুখ। সেলিম মামার প্রেমের গল্প আমার মুখস্ত। কয়েকবার মামাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শুনেছি।
তারপর আবারো আশপাশ তাকিয়ে হরহর করে সবকিছু মামাকে খুলে বলে দিলাম- মামা, আজ টিউশনির টাকাটা পেয়েছিলাম। কিন্তু শালার পকেটমার আমার পকেট কাইট্টা নিয়া গেছে। কনত, এখন বাড়িত যামু কেমনে? ঈদে বাড়ি গেলে ছোট বোনটা আমার হাতের দিকে তাকাইয়া থাকে। চাইছিলাম বাজানের লাইগ্যা একখান পাঞ্জাবি কিনমু। মার লাইগ্যা একখান টাঙ্গাইল্লা শাড়ি কিনমু। কিন্তু কিছুই হইলো না, মামা। দেন, এক কাপ চা দেন। মাথাডা খুব ধরছে, মামা।
মাটির দিকে তাকিয়ে আমি চা খাচ্ছি। আনমনে অংক কষছি মাটিতে। নি¤œমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের ঘরে লেখার কাগজ না থাকলেও মাটির বুক উদোম থাকে সব সময়। সেখানে ইচ্ছামতো লেখা যায়। বাঘবন্দি খেলা যায়। পাঁচ গুঁটি খেলা যায়। চোখের জল ফেলা যায়। অনেকক্ষণ ধরে আমি আনমনে আমাদের জলেশ্বরী গ্রামটা ঘুরে ঘুরে দেখছি। সাপের মতো আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। সারি সারি তালগাছ। উত্তরের হাওয়ায় দোল খাওয়া বাবুই পাখির বাসা। হলুদ সন্ধ্যা গুলিয়ে যায় জলেশ্বরী নদীর টলটলে জল। চোখের সামনে এক পা দু পা করে হাঁটছে ঘুঘু দম্পতি। কাসেম চাচার টং দোকানে বসেছে বৈশ্বিক সংলাপ। বিবিসি বাংলা পরিক্রমা। ঐতো পথের ওপর ছোট বোন পরী দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে আমার জনম দুঃখিনী মা। বাবা আজ মাঠের কাজ আগে-ভাগে সেরে বাসস্ট্যান্ডে বসে ঘনঘন বিড়ি ফুঁকছে। তার অপেক্ষার বাস তবুও আর আসে না।
আচমকা আমার কাঁধের ওপর একখান হাত। সহসাই শীতল একটা অনুভব আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নেমে গেল। ঘুরে দেখি, সেলিম মামা। দোকান থেকে কখন যে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন- খেয়ালই করিনি!
– মামা, ওঠেন ত। বাইত যান। কাল বাদে ঈদ। বাড়ির মানুষ আপনের লাইগ্যা অপেক্ষা করতাছে।
– না, মামা। বাইত আর যামু না। আপনের দোকান বাকিও পরের মাসের টাকা পাইলে দিতে অইবো। কিচ্ছু মনে কইরেন না।
– দূর, মামা। বাকির ট্যাকা লইয়া আপনের চিন্তা করোন লাগতো না। এহন না পারলে পরে দিবেন। তাও না পারলে চাকরি পাইলে দিবেন। সমস্যা নাই ত। যান, বাড়িত যান। ঈদের খুশি বেকতের লগে ভাগাভাগি কইরেন।
আসার সময় সেলিম মামা আমার হাতের মুঠোয় পাঁচশ টাকার তিনটা নোট গুঁজে দিলেন। টাকাগুলো দেখেই ছলকে ওঠলো আমার দুই চোখ। গাল বেয়ে নোনাজল পড়ছে মাটিতে। নি¤œমধ্যবিত্ত ছেলের চোখের জলও মাটি দ্রুত শুষে নেয়। আড়াল করে রাখে আমাদের নিরেট বেদনার দাগ। সেলিম মামাকে জড়িয়ে ধরি। মামাও আমাকে তার প্রশস্ত বুকে টেনে নেন। পোষা বিড়ালের মতো আমি তার বুকে আরো মায়া খুঁজতে থাকি।
– এখন বাড়িত যান ত, মামা। ওহ, যাওনের সময় ছুডু বইনের লাইগ্যা একখান লাল টুকটুকে জামা লইয়া যাইয়েন। এই লন আরো পাঁচশ ট্যাকা।
বাস হাওয়ার বেগে ছুটছে। চলন্ত বাসে বসে আমি আনমনে দেখতে পাচ্ছি সেলিম মামার মুখ। কী নিখুঁত ও সুস্পষ্ট তার মুখের ছবি! আমি এখন আমার গ্রামকে দেখছি না। মা-বোনের ছবি মনে করতে পারছি না। বারবার শুধু আমি সেলিম মামার মুখটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। দেখতে দেখতে ক্রমেই আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে…।

রফিকুল নাজিম : মাধবপুর, হবিগঞ্জ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়