আশালতা : নজরুলের উত্থান-পতনময় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য নাম

আগের সংবাদ

বর্ষায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কা চট্টগ্রাম নগরবাসীর : চসিক-চউক ব্যস্ত দোষারোপে

পরের সংবাদ

চিকিৎসা ব্যয়ে পিষ্ট রোগীরা : চিকিৎসায় রোগীর নিজস্ব ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ, সবচেয়ে বেশি ব্যয় ওষুধ কিনতে- ৬৫ শতাংশ

প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে চিকিৎসায় রোগীর নিজস্ব ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেন্সেস) বেশি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয়। সরকার ২০১২ সালে চিকিৎসায় রোগীর নিজস্ব ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়। ওই বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। সেখানে ২০৩২ সালের মধ্যে রোগীর নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে দীর্ঘ এক যুগেও এ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। ব্যক্তির ব্যয় কমার বদলে উল্টো বেড়েই চলেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণাতেই এমন তথ্য মিলেছে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ২০১৮, ’১৯ ও ’২০ সালে চিকিৎসা ব্যয়ে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে মোট ব্যয়ের ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ। আর ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যয়ে সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে আর ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় করতে গিয়ে বছরে ৮৬ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে ওষুধ কিনতে। এতে ব্যয় ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া রোগ শনাক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, বিকল্প চিকিৎসাসেবায় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং হাসপাতালে খরচ ১০ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৯ সালের তুলনায় এ বছর হাসপাতাল ও বিকল্প চিকিৎসাসেবা নেয়ায় ব্যয় বেড়েছে। এসব ব্যয়ের মধ্যে সরকার ও দাতা সংস্থা থেকে আসে ৩১ শতাংশ। শুধু সরকার বহন করে ২৩ দশমিক ১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ একাউন্টসের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা দিতে ২০২০ সালে সরকারের মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৫৪ ডলার বা ৪ হাজার ৫৭৮ টাকা। বর্তমানে সরকার স্বাস্থ্যসেবায় যে অর্থ ব্যয় করে তার সবচেয়ে বেশি হয় ঢাকা বিভাগে, মোট ব্যয়ের ৩৭ শতাংশ। সবচেয়ে কম ৩ শতাংশ ময়মনসিংহ বিভাগে। মাথাপিছু হিসাবে ঢাকা বিভাগের জনপ্রতি

ব্যয়ের পরিমাণ ৭ হাজার ৩৯ টাকা এবং ময়মনসিংহে ২ হাজার ৬০ টাকা।
তবে গত ২ বছরে এই ব্যয় আরো বেড়েছে। কারণ, করোনার পর থেকে অর্থাৎ ২০২১ সাল থেকেই জিনিসপত্রের দাম বাড়তির দিকে। জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব সবকিছুর ওপরই পড়ে। ওষুধের দামও বেড়েছে। চিকিৎসার সঙ্গে যাতায়াত, খাবার, ওষুধ সবকিছু সম্পর্কিত। ফলে ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় বাড়াও স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। এর ফলে অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেশি হলে তা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা। শুধু অর্থায়নই সমস্যার সমাধান নয়; অর্থের যথাযথ ব্যবহারও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় বলা হয়, দেশের মানুষ কোন হাসপাতাল বা কার কাছ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে, সেটিও ব্যয়ের ওপর প্রভাব ফেলে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ কম। কিন্তু মাত্র ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ সরকারি আর ৮৬ শতাংশ মানুষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেয়। বেসরকারি খাতে অন্য যেসব জায়গা থেকে মানুষ চিকিৎসা নেয়, সেখানে খরচ অনেক বেশি এবং তাতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, পকেটের অর্থ খরচ কমাতে হলে প্রাইভেটের খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আবার বিদেশে বড় একটা অংশ চিকিৎসা নেয়। সেটিরও একটা প্রভাব এতে পড়ে। এরপর ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের একেক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একেক রকমের চার্জ আর টেস্ট ফি সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরকারিভাবে একটি গাইডলাইন তৈরি করে হাসপাতালের বেড সংখ্যা, যন্ত্রপাতি, অবস্থান, লোকবল, সুযোগসুবিধা ভেদে এ, বি, সি, ডি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে মান অনুযায়ী ফি নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়বে, যত্রতত্র ফি দিয়ে দেশের জনগণের অযাচিত অর্থ ব্যয় হবে না। এ সংক্রান্ত একটি কমিটি করে এক মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন মন্ত্রী। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সব মানুষের চিকিৎসা পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অনেকটা এগিয়ে গেলেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার উল্লেখযোগ্য আধুনিকায়ন ঘটেনি। এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ৫ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয়নি। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে যতদিন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হবে, ততদিন দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, বিভিন্ন কারণে চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায়। বাংলাদেশে যেটি লক্ষণীয় তা হচ্ছে চিকিৎসার একটা বড় অংশ ওষুধের ব্যয়। আর এর পুরোটাই খরচ হচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে সর্বনিম্ন বরাদ্দ হয়। ফলে চিকিৎসা ব্যয় মানুষের পকেটের ওপর পড়ে। রাষ্ট্র যদি মানুষের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দায়িত্বটা নেয় তাহলে চিকিৎসা খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। এ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সংখ্যা যে খুব বেশি তা কিন্তু নয়। আড়াইশ থেকে তিনশর মতো। বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়। এই ৩৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৯৫ শতাংশই মানুষ পকেট থেকে খরচ করে। সেই টাকার পরিমাণ হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবায় যে পরিমাণ টাকা খরচ হয় তার দুই-তৃতীয়াংশ। সরকার যদি ৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ কেনে, তাহলে মানুষের পকেট থেকে যে ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, তা ১৫ হাজার কোটিতে নেমে আসবে। মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমে আসবে।
ওষুধের পর নানা টেস্টে রোগীর খরচ বেশি হয়। সরকার চাইলে সেটিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, সরকারি বা বেসরকারি যে কোনো হাসপাতালে কত টেস্ট হয় তার কোনো মনিটরিং নেই। আমরা কিন্তু জানি না একজন ডাক্তার বছরে কোন অসুখের জন্য কত টেস্ট দিয়েছে। এটি যদি অনলাইনে মনিটর করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে, কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে বেশি করে ডায়াগনস্টিক টেস্ট হচ্ছে কিনা। এটা করা যাচ্ছে না বলে আমরা বলতে পারছি না, সব টেস্ট রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় কিনা। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হলে হেলথ স্ট্যাটাস বেড়ে যাবে।
ব্যক্তির পকেট ব্যয় বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২১ সাল থেকেই জিনিসপত্রের দাম বাড়া শুরু হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। অর্ধশতাধিক অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম বেড়েছে। চিকিৎসাসংক্রান্ত অন্যান্য জিনিসের দামও বেড়ে যাবে। ২০২১ সালে ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় ছিল ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ। সেটিও আন্ডার এস্টিমেটেড ছিল। ওটা সঠিকভাবে করলে ৮০ শতাংশও হয়ে যেতে পারে। স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো, দুর্নীতি কমানো ও নজরদারি বাড়ানো দরকার। শুধু ওষুধ নয়; রোগ শনাক্তের খরচের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বেড়েছে। হাসপাতালে অবস্থান ও যাতায়াত খরচও বেড়েছে। গত ছয় মাসে দুই দফায় ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এছাড়া ফার্মেসিগুলোতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধে সরকারকে আরো শক্ত হতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়