আশালতা : নজরুলের উত্থান-পতনময় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য নাম

আগের সংবাদ

বর্ষায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কা চট্টগ্রাম নগরবাসীর : চসিক-চউক ব্যস্ত দোষারোপে

পরের সংবাদ

‘কলাগাছ থেরাপি’তে কাজ না হলেও বাড়ছে জনসচেতনতা

প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রুমানা জামান : বছরের শুরুতে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় পয়ঃবর্জ্যরে সংযোগ সারফেস ড্রেনে, খালে বা লেকে দেয়া বন্ধ করতে কলাগাছ দিয়ে বেশ অদ্ভুত এক অভিযানে নামেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। বিষয়টি নজর কাড়ে নগরবাসীর। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, যেসব বাড়ির পয়ঃবর্জ্যরে লাইনে কলাগাছ ঢোকানো হয়েছিল মেয়রের নির্দেশে, সেগুলো পরের দিনই সরিয়ে ফেলেছেন বাড়ির মালিকরা। আগের মতোই পয়ঃবর্জ্য পড়ছে পানি নিষ্কাশনের নালায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রতীকী অভিযান দিয়ে কোনো কাজ হবে না। এখন প্রয়োজন শক্ত পদক্ষেপ। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের দাবি- কলাগাছ থেরাপি ছিল জনসচেতনতামূলক একটি অভিযান। পয়ঃবর্জ্যরে লাইনে কলাগাছ দেয়ার যে উদ্দেশ্য ছিল তা সফল হয়েছে। সোসাইটির জনগণ ও বাড়ির মালিকরা এখন নিজ উদ্যোগে ‘ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ বসাতে চান। তারা ডিএনসিসির সঙ্গে এ বিষয়ে সহায়তা পেতে যোগাযোগ করছেন।
ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসাতে বাধ্য করতে গত ৪ জানুয়ারি অভিযান শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গুলশানের দুটি বাড়ির পয়ঃবর্জ্যরে পাইপে কলাগাছ ঢুকিয়ে সংযোগ বন্ধ করা হয়। সেদিন মেয়র আতিক বলেছিলেন, যে কয়েকটা বাড়ির সুয়ারেজ লাইনে কলাগাছ ঢুকিয়েছি, তারা এখন পাগল হয়ে গেছে। এই অভিযান পরবর্তীতে বারিধারা, বনানী এলাকাতেও বিস্তৃত হয়। ৪০ দিনের অভিযানে অবৈধ পয়ঃসংযোগ বন্ধ করা হয় ৩৬টি বাড়ির।
সরজমিন গুলশান ও বনানী এলাকায় দেখা গেছে, সংযোগ বন্ধ করতে দেয়া কলাগাছ অভিযানের পরপরই তা আবার খুলে ফেলেছেন বাড়ির মালিকরা। অনেক বাড়িতে পয়ঃবর্জ্যরে একাধিক সংযোগ থাকায় একটি বন্ধ করলেও অন্যটি দিয়ে বর্জ্য যাচ্ছে নিষ্কাশন নালায়। আবার এই নালার উপর ফুটপাত নির্মাণের সময় কংক্রিটের ঢালাই দেয়ায় অবৈধ পয়ঃসংযোগ বন্ধ করাও কঠিন হয়ে উঠছে।
বনানীর ১৮ নম্বর সড়কের এ ব্লকের ১৬ নম্বর বাড়ির সংযোগটি বন্ধ করা হয় ডিএনসিসির অভিযানে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, পাইপের মুখে কলাগাছ নেই, তীব্র গতিতে বর্জ্য পড়ছে নিষ্কাশন নালায়। ওই এলাকার ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জানালেন, ৩ দফা কলাগাছ দিলেও পরের দিনই দেখা গেছে গাছ আর নেই। বাড়িটির তত্ত্বাবধায়ক শাহ জাহান বললেন, বাড়ির ভেতরে পানি আটকে গিয়েছিল। কেন আটকাল তা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। পরে দেখি পাইপের মুখ কলাগাছ দিয়ে আটকানো। তাই খুলে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
‘কলাগাছ অভিযান’ কতটা সফল হয়েছে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা ভোরের কাগজকে বলেন, এটা তো স্থায়ী সমাধানের জন্য করা হয়নি। এর মাধ্যমে সবাইকে একটি বার্তা দেয়া সম্ভব হয়েছে। জনগণের সচেতনতা বেড়েছে নিঃসন্দেহে। কলাগাছ থেরাপি দিয়েছি বলেই তারা আমাদের কাছে আসতে শুরু করেছেন। নিজ বাড়িতে সেপটিক ট্যাংক বানানোর জন্য তারা আমাদের সহায়তা চাইছেন।
ডিএনসিসি জানিয়েছে, গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকার ৩ হাজার ৮৩০টি ভবনে চালানো জরিপে দেখা গেছে- ভবনগুলোর মাত্র ৪১টি বাড়ির পয়ঃবর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশন করা হচ্ছে, যা শতকরা ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। ৫২৪টি ভবনের পয়ঃবর্জ্য আংশিক শোধন করা হয়। ৩ হাজার ২৬৫টি অর্থাৎ ৮৫ দশমিক ২৪ শতাংশ বাড়ির পয়ঃবর্জ্য ফেলা হচ্ছে পানি নিষ্কাশনের নালায়।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ : জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান ভোরের কাগজকে

বলেন, কলাগাছ থেরাপি- এটা হচ্ছে জাস্ট কিছু একটা করা, টেকসই কিছুই না। কলাগাছ ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই পচে গলে যায়। এ কারণে এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এ বিষয়গুলো মেয়র নিজেও জানেন। তিনি হয়তো জনগণকে সচেতন করতে প্রতীকী হিসেবে এই অভিযান শুরু করেছিলেন।
আদিল মুহাম্মাদ বলেন, পরবর্তীতে কঠোর বার্তা হিসেবে এই অভিযান শুরু করলেও এখন ডিএনসিসির উচিত টাইম ফ্রেম বেঁধে দিয়ে অবৈধ সংযোগ দেয়া বাড়ির মালিক ও সংস্থাকে অফিসিয়াল চিঠি দেয়া। মুখের কথায় কাজ হবে না। কারণ বাড়ির মধ্যে সেপটিক ট্যাংক করে নেবেন এমনভাবেই ভবন মালিকরা কিন্তু ভবনের নকশা অনুমোদন করেছিলেন। তাছাড়া চিঠিতেও কাজ না হলে আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। তবে এসব পদক্ষেপ নেয়ার আগে ডিএনসিসি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেপটিক ট্যাংক তৈরিতে প্রয়োজনে মালিকদের টেকনিক্যাল সাপোর্র্ট দিতে পারে। এরপর ডিএনসিসির দায়িত্ব হবে কতটুকু কাজ করতে হবে তা বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ‘টু দ্য পয়েন্ট’ বুঝে নেয়া।
অবৈধ সংযোগ পাইপ বন্ধে জটিলতা : ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মীরা জানিয়েছেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নালার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে গিয়ে পয়ঃবর্জ্যরে সংযোগ দেখলে বন্ধ করেন। অনেক জায়গায় অবৈধ সংযোগ দেখলেও উপরে কংক্রিটের ঢালাই থাকায় সংযোগ বন্ধ করা যায় না।
বনানী ১৫ নং রোডে কর্মরত মারুফ ইসলাম নামের একজন কর্মী জানান, বেশির ভাগ জায়গায় ঢালাই করে ফেলায় তারা কেবল ঢাকনা সরিয়ে দেখেন কোনো অবৈধ সংযোগ আছে কিনা। ঢাকনার কাছাকাছি সংযোগ থাকলে তা বন্ধ করতে পারেন। কিন্তু তা ভেতরের দিকে হলে আর পারেন না। অনেক বাড়ির মালিক চালাকি করে ঢালাইয়ের নিচে অবৈধ পাইপ ঢুকিয়ে রেখেছে। এই পাইপ বন্ধ করতে হলে আগে উপরের ঢালাই ভাঙতে হবে। এ কাজে ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার অনুমতিও লাগে। ফলে ঢাকনার কাছাকাছি থাকা পাইপগুলোই শুধু বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে।
পয়ঃবর্জ্য যাচ্ছে কোথায় : একটি সড়কের দুপাশে ‘পাইপ ড্রেন’ থাকে। ওই দুটি ড্রেন থেকে বৃষ্টির পানি এবং গৃহস্থালির ব্যবহৃত পানি যায় সিটি করপোরেশনের স্টর্ম সুয়ারেজ লাইনে। স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন হয়ে পানি বিভিন্ন লেক অথবা খালে গিয়ে পড়ে। আর বাড়ির পয়ঃবর্জ্যরে সংযোগ যাওয়ার কথা ঢাকা ওয়াসার পয়ঃলাইনে। সেই লাইন হয়ে পয়ঃবর্জ্য চলে যাবে ঢাকা ওয়াসার পাগলা শোধনাগারে।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, বাড়ির সংযোগ পয়োনালায় দিতে হবে। কোনো কারণে পয়োনালায় সংযোগ দিতে না পারলে সেপটিক ট্যাংকের মাধ্যমে বর্জ্য শোধন করতে হবে। ২০০৮ সালের ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ৫৯ ধারার গ উপধারার ২ ও ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যেখানে সরকারি পয়ঃপ্রণালির ব্যবস্থা রয়েছে ইমারতের সমস্ত পয়ঃপ্রণালি এবং ময়লা পানি নির্গমন পথ ইহার সহিত সংযুক্ত করিতে হইবে। যেখানে কোনো সাধারণ পয়ঃপ্রণালি নাই অথবা থাকিলে কর্তৃপক্ষ যদি বহিঃনির্গমন পথসমূহকে তাহার সহিত সরাসরি সংযুক্ত হইতে না দেয় তাহা হইলে নির্দিষ্ট আকার এবং অবস্থানে সেপটিক ট্যাংক ব্যবহার করিয়া বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করিতে হইবে এবং সোক পিট ব্যবহার করিয়া নোংরা পানি নিষ্কাশন করিতে হইবে। এইক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ অনুমোদনের জন্য প্রস্তুতকৃত লে-আউট নকশায় সেপটিক ট্যাংক এবং সোক পিট এর অবস্থান প্রদর্শন করিতে হইবে।’
গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় ঢাকা ওয়াসার পয়োনালা রয়েছে। তবে তা অনেক পুরনো হওয়ায় ঠিকমতো কাজ করে না। বাড়িতে সেপটিক ট্যাংকও নেই। তাই বিভিন্ন বাড়ির মালিকরা পয়ঃসংযোগ দিয়েছেন ওয়াসার ‘পাইপ ড্রেনে’। সেই বর্জ্য গিয়ে পড়ছে লেক বা খালে।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এস এম শরিফ-উল ইসলাম বলেন, বাড়ির মালিকরা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসাতে চান, আমরাও দেশ-বিদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছি। ইচ্ছা করলে একটি বাড়িতে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো যাবে। আবার দু-তিনটি বাড়ি মিলেও এটা বসাতে পারেন। নিরাপদ ও টেকসই পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক ও উন্নত পরিষেবা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা মেলার আয়োজন করেছি। অনেকেই সেখান থেকে ট্যাংক তৈরির জিনিসপত্র কিনেছেন। তাছাড়া পয়োঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে দ্রুত করা যায় তা নিয়ে ওয়াসার সঙ্গেও নিয়মিত বৈঠক চলছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়