আশালতা : নজরুলের উত্থান-পতনময় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য নাম

আগের সংবাদ

বর্ষায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কা চট্টগ্রাম নগরবাসীর : চসিক-চউক ব্যস্ত দোষারোপে

পরের সংবাদ

একাত্তরে র-এর ফাঁদে পাকিস্তান

প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

র-এর বয়স তখন মাত্র তিন বছর। একাত্তরের যুদ্ধ শুরুর আগেই পাকিস্তান র-এর ফাঁদে পড়ে যুদ্ধটা হেরে যায়। এই ফাঁদ উড়োজাহাজ হাইজ্যাকের ফাঁদ। হাইজ্যাকের ঘটনাটি ৩০ জানুয়ারি ১৯৭১-এর। হাইজ্যাক করা উড়োজাহাজটির নাম গঙ্গা। ভারতের অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করা একটি ফোকার ফ্রেন্ডশিপ উড়োজাহাজ। এফ-২৭ উড়োজাহাজটি শ্রীনগর থেকে জম্মুর পথে হাইজ্যাক করা হয়।
হাইজ্যাকার হাশিম কুরেশি ও আশরাফ কুরেশি রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য নিজেদের পক্ষে এবং জম্মু-কাশ্মির ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের পক্ষে কাজটা করেছেন? তাহলে উদ্দেশ্যটা কি জম্মু ও কাশ্মিরের সমস্যার কথা বিশ্ববাসীকে জানানো? নাকি অন্য কারো হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা আরো বাড়িয়ে দেয়া?
৩০ জানুয়ারি ১৯৭১, সকালটা কনকনে ঠাণ্ডা কিন্তু রৌদ্রকরোজ্জ্বল। দুই স্কুলবালক পীরজাদা ফাইয়াজ ও তার সহপাঠী আশফাক হোসেন তাদের জীবনের প্রথম আকাশভ্রমণের জন্য শ্রীনগরের বাড়ি ছেড়ে এসেছে। তারা রাজস্থানের চিতোরগড় বোর্ডিং স্কুলে যাচ্ছে। তারা শ্রীনগর এয়ারপোর্টের পথে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফোকার ফ্রেন্ডশিপ উজোজাহাজ গঙ্গা তাদের নিয়ে আকাশপথে জম্মু যাত্রা করবে। শ্রীনগর এয়ারপোর্টের টারমাকে উড়োজাহাজ দাঁড়িয়ে।
এ দুটি বালক ছাড়া উড়োজাহাজে আরো ২৫ জন যাত্রী। ইঞ্জিন চালু হলো, পাইলটরা উড়োজাহাজ রানওয়েতে নিয়ে গেলেন। শ্রীনগরের মাটি থেকে জাহাজ উড়ে গেল শ্রীনগরের আকাশে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই গঙ্গাকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বহর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেয়া হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ডিকমিশনড উড়োজাহাজ আবার কেমন করে রিকমিশন করে বহরে আনা হলো, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের তীরে যে আলোড়ন চলছে, তার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা, সে বিতর্কও চলতে পারে।
উড়োজাহাজ যখন জম্মু এয়ারপোর্টে নামতে যাচ্ছে, পেছন থেকে দুজন তরুণ ককপিটের দিকে ছুটে আসে। মুহূর্তের মধ্যেই অনিবার্য ঘটনাটি ঘটে গেল : হাতে পিস্তল থাকা তরুণ ককপিটের দরজায় লাথি মেরে পাইলটের দিকে এগোলেন, অন্যজনের হাতের মুঠোয় গ্রেনেড। ককপিটের দরজা বরাবর উল্টোমুখী হয়ে একেবারে যাত্রীদের মুখোমুখি, তার হাত কাঁপছে।
রিভলভার নিয়ে ককপিটে ছুটে যাওয়া তরুণ হাশিম কুরেশি। আর গ্রেনেড হাতে আশরাফ কুরেশি।
যাত্রীরা প্রাণভয়ে চেঁচাচ্ছে, ফোঁপাতে শুরু করেছে। আশরাফ কুরেশি যাত্রীদের দুহাত উপরে তুলে রাখতে নির্দেশ দিলেন।
উড়োজাহাজ চালাচ্ছিলেন, তাদের একজন ক্যাপ্টেন কাচরু ও অন্যজন ক্যাপ্টেন ওবেরয়।
ততক্ষণে ঢাকায় রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব তীব্র হয়ে উঠেছে। মঞ্চ এমনভাবে তৈরি হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসন মুজিবুর রহমানের ক্ষমতাসীন হওয়া ও সরকার গঠন করা ঠেকাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাবে। আর তা করতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং সামরিক আইন জারির প্রস্তুতিও চলছে।
উড়োজাহাজ হাইজ্যাকারদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে যাত্রীরা নিজেদের নিয়তির কাছে সমর্পণ করেছে।
হঠাৎ ককপিট থেকে উত্তপ্ত বিতর্কের শব্দ আসতে শুরু করে। হাইজ্যাকার হাশেম কুরেশি ও পাইলটের মধ্যে হইচই। কিন্তু উড়োজাহাজের শব্দের কারণে কী নিয়ে কথা হচ্ছে, বোঝা গেল না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তর্ক-বিতর্ক থেমে গেল। উড়োজাহাজ নিচের দিকে নামছে। গঙ্গা যখন আরো নেমে রানওয়ে স্পর্শ করল, যাত্রীদের ধারণা নেই, তারা কোথায় নেমেছে। টারমাকে পার্ক করা আরো উড়োজাহাজ দেখা গেল, উড়োজাহাজে পিআইএ লেখা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ধাক্কা দিয়ে উড়োজাহাজের দরজা খোলা হলো। ফাইয়াজ ও তার ক্লাসমেট দেখল, দরজা দিয়ে দুটো অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স নিচে ফেলা হয়েছে, সম্ভবত এগুলোকে নামার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সবার আগে লাফিয়ে নামলেন একজন হাইজ্যাকার, সম্ভবত হাশিম কুরেশি। উড়োজাহাজের ভেতর খাওয়ার পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। যাত্রীদের জন্য কিছু পানির বোতল তোলা হলো। কয়েক মিনিট পর ঘোষণা শোনা গেল, ইচ্ছে করলে নারী ও শিশুরা নেমে যেতে পারে।
সবার আগে সাড়া দিল ফাইয়াজ ও তার ক্লাসমেট। তারা দরজায় পৌঁছল। ফোকার ফ্রেন্ডশিপ ছোট উড়োজাহাজ হওয়ায় দরজা থেকে প্রথমে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে এবং তারপর টারমাকে লাফিয়ে পড়তে তেমন অসুবিধে হলো না। তারা এখন পাকিস্তানের মাটিতে।
মুহূর্তের মধ্যেই পাকিস্তানি গার্ডরা দুটি বালককে টার্মিনাল ভবনের দিকে নিয়ে গেল। তারপর শুরু হলো লাহোরি আতিথেয়তা : চা আর সঙ্গে স্পেশাল লাহোরি রুটি। চা, নাশতা ও আলিঙ্গনের বর্ষণ চলছে। পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তারা এসে যাত্রীদের সম্ভাষণ জানালেন। আর এ দলের যিনি প্রধান, তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি এই মাত্রই ঢাকা থেকে ভারতের আকাশসীমা দিয়ে লাহোরে এসে অবতরণ করেছেন। তখন পাকিস্তানি উড়োজাহাজ এভাবেই আসা-যাওয়া করত।
এয়ারপোর্টে অনেক মানুষের জমায়েত। তারা ভুট্টোকে উড়োজাহাজ গঙ্গার দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন। তিনি বললেন, কী ঘটেছে, এরা কারা, আমার কোনো ধারণা নেই। এ সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। লোকজন তাকে ঠেলে উড়োজাহাজের কাছে নিয়ে গেলে তিনি হাশিম ও আশরাফের সঙ্গে কিছু কথা বলেন। সন্ধ্যাবেলা যাত্রীদের এয়ারপোর্ট টার্মিনাল থেকে দুটি বাসে তোলা হয়। লাহোরের রাস্তা দিয়ে বাস যখন যাচ্ছে, নিরাপত্তা কনভয় বাস দুটিকে পাহারা দিয়ে এগোতে থাকে।
ভারত ও পাকিস্তান হাইজ্যাক নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছার চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যাপারটা সহজ নয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর দুই দেশের সম্পর্ক তখনো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি। এদিকে গঙ্গা ও যাত্রীদের ফিরিয়ে দেয়ার আলোচনা চলছে। হাইজ্যাকারদের দাবি, ভারতের কারাগারে আটক জম্মু-কাশ্মির ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের কয়েক ডজন সেনাকে মুক্তি দিতে হবে এবং তাদের পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে হবে।
দুদিনের উদ্বেগ ও লাহোরি আতিথেয়তার সমাপ্তি ঘটিয়ে গঙ্গার যাত্রীদের হোটেল গেটে অপেক্ষমাণ বাসে ওঠার নির্দেশ হলো। যখন থামল, জানা গেল এটা পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত। যাত্রীদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে, হোসেইনওয়ালা সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকবে।
ঘটনার নাটকীয় মোড় : পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থা উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরিয়ে দিল। কাউকেই কাছাকাছি আসতে দেয়া হয়নি। হাশিম ও আশরাফ কুরেশি দুজনই গ্রেপ্তার হয়, তাদের বিচার হয় এবং বিশেষ আদালতে ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত হয়। ওদিকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্ষমতা হস্তান্তরিত না হলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বাধীনতার ডাক হয়ে আবির্ভূত হতে পারে।
নাটকীয় আরো কিছু ঘটতে থাকে। ভারত তার আকাশসীমায় পাকিস্তানি উড়োজাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যোগাযোগ অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। শ্রীলঙ্কা হয়ে পশ্চিম ও পূর্ব উপকূল পাড়ি দিয়ে আসতে হবে। আকাশপথে নিষেধাজ্ঞা আসার পর পাকিস্তান গঙ্গা হাইজ্যাক ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। ভারতীয় উড়োজাহাজ হাইজ্যাকের ফাঁদ তৈরি করে দিয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। পাকিস্তান এ ফাঁদে পা দিয়েছে, আর এটাকে কাজে লাগিয়ে গঙ্গা জ্বালিয়ে দেয়ার অপরাধে আকাশপথ রুদ্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
হাশিম ও আশরাফ চিহ্নিত হয়েছেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে। বিচলিত পাকিস্তান জম্মুু এন্ড কাশ্মির ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট নেতা মকবুল ভাটসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে।
কে এইচ খুরশিদ নামের যে কাশ্মিরি যুবককে প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার পার্সোনাল সেক্রেটারি করেছিলেন, তিনিই আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি এ মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন।
তিনি আদালতকে বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সন্ধ্যা ৭টায় তিনি যখন লাহোর এয়ারপোর্টে পৌঁছেন, তাকে বলা হয়, সেখানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পিআইএ হাইজ্যাকারদের নিত্যদিনের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
এদিকে খালিদ হাসান সেখানকার মুহূর্তগুলোর চাক্ষুষ সাক্ষী। তিনি বললেন, পাকিস্তানি এজেন্সিগুলো হাইজ্যাকের সূত্র উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করছিল। প্রথমে তাদের মনে হয়েছিল, হাইজ্যাকটা জম্মুু এন্ড কাশ্মির ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে। কিন্তু পরে তারা এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের আভাস পান।
খালিদ হাসান বলেন, ফ্রন্টের নেতা মকবুল ভাট পেশোয়ার থেকে লাহোর এসে পৌঁছেছেন। দুজন হাইজ্যাকার হাশিম ও আশরাফ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।
তিনি বলেন, লাহোরের সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ সর্দার আবুল উকিল খান, কে এইচ খুরশিদ ও মকবুল ভাটকে একটি কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে হাশিম কুরেশি কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে বসে ছিলেন। তিনি ভাটকে বলেন, এ লোকগুলো আমাকে বলছে যেন উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরিয়ে দিই।
সাক্ষাতের পর কে এইচ খুরশিদ ও মকবুল ভাটকে নিয়ে সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ বেরিয়ে আসেন এবং তিনি তাদের বলেন, ‘খোদা কে লিয়ে হামারি জান ছোড় দো, জাহাজ কো উড়া দো’ (আমাদের ছেড়ে দাও, জাহাজ উড়িয়ে দাও)। তা-ই ঘটেছে। তবে সে কাজটা হাইজ্যাকাররা করেননি।
কিন্তু শিগগিরই পাকিস্তান বুঝতে পারল, এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মকবুল ভাট নেই কিংবা তার দল জেকেএনএলএফও জড়িত নয়। যদিও তাদের দুই বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। লাহোর হাইকোর্ট আটকের আদেশ নাকচ করে তাদের দেশপ্রেমিক আখ্যা দেয়, কারণ তারা নিজের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন।

কিন্তু হাশিম ও আশরাফ কেন হাইজ্যাক করতে গেলেন?
একটি তত্ত্ব হচ্ছে, কয়েক বছর আগে হাশিম কুরেশি সীমান্ত অতিক্রম করে মকবুল ভাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তখনই এ পরিকল্পনার জন্ম। কেউ বলেছেন, মকবুল ভাট আগেই জানতেন হাশিম কুরেশি কী চাইছেন।
কাশ্মির ফেরার পথে ভারতীয় গোয়েন্দারা হাশিম কুরেশিকে তুলে নেয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে পরে ছেড়ে দেয়। ভারতীয় সূত্র থেকে খালিদ হাসান বলেন, হাশিম কুরেশি তাদের কাছে স্বীকার করেছেন যে তিনি পাকিস্তানে উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী তিনি দ্বৈত গোয়েন্দাগিরিতে সম্মতি দেন।
ভারতীয় গোয়েন্দা এম বি সিনহা স্বীকার করেছেন, হাশিম কুরেশি ভারতীয় উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করতে রাজি হন, এভাবেই মকবুল ভাটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন এবং জেকেএনএলএফের ভেতর অনুপ্রবেশ করেছিলেন। সিনহা লিখেছেন, তার ওপর নির্দেশ ছিল- উড়োজাহাজের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের হাতে ছাড়বে না, তবে চাপ দেবে ভুট্টোর সঙ্গে তার ও তার কমরেডের আলোচনার পর এটা বিবেচনা করবে। এতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাইজ্যাকারদের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।
অনেকে মনে করেন, হাশিম কুরেশি সরল বিশ্বাসেই হাইজ্যাক করেছেন। ইউরোপ থেকে কাশ্মিরে ফেরার পর ২০০৮ সালে একটি সাক্ষাৎকারে কিছু প্রশ্নের আংশিক জবাব দিয়েছেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দারা যখন গঙ্গা নিয়ে ব্যস্ত, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রধান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। অপারেশন সার্চলাইট নামের বিভীষিকা চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জবাব দেয়।
ভারত আকাশপথে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে কার্যত পশ্চিম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, যার কারণ উড়োজাহাজ গঙ্গার হাইজ্যাক।

খেলনা পিস্তলে হাইজ্যাক
হাশিম কুরেশির কথোপকথন থেকে :

‘আমি বাসে চড়ি, কিন্তু পুলিশ বাস থামায় এবং একটি পিস্তল ও হ্যান্ড গ্রেনেডসহ আমি ধরা পড়ি। আমাকে বিএসএফ ইন্টারোগেশন সেন্টারে নেয়া হয়। আমি তাদের বলি, আরো তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে আমি পাকিস্তানে হাইজ্যাকের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বিএসএফ আমাকে শ্রীনগর এয়ারপোর্টের দিকে নজর রাখতে বলে। খবরের কাগজে একটি বিজ্ঞাপনে দেখি, দেখতে সত্যিকারের পিস্তলের মতো এবং চোরকে ভয় পাইয়ে দেয়ার মতো পিস্তল বিক্রি হবে। আমি ডাকযোগে একটি কিনি। কাঠ দিয়ে হ্যান্ড গ্রেনেডের অনুরূপ কিছু বানিয়ে তাতে ধাতব রং লাগাই।’
‘উড়োজাহাজ ওড়ার পরই আমি ককপিটে ছুটে যাই এবং পাইলটের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হাইজ্যাকের ঘোষণা দিই। পাইলটকে উড়োজাহাজ পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিই। ক্রুসহ জাহাজে যাত্রী ৩৪ জন।’
আমরা ২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এয়ারপোর্টে থাকি। তারপর লাহোর পুলিশের একজন কর্মকর্তা এসে বলেন, জাহাজে আগুন লাগিয়ে নাটকটা যেন শেষ করি। ভাট এর বিরোধিতা করেন।’
‘শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যানভর্তি জ্বালানিসহ এসে বললেন, মকবুল ভাটই আগুন লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তা-ই করি। কিন্তু পরে জানতে পারি, তিনি এ কথা বলেননি এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এর বিরোধিতা করেছেন।’
ভারতীয় বিশ্লেষকই জানাচ্ছেন :
১. উড়োজাহাজ হাইজ্যাক ছিল ‘র’-এর পরিকল্পনা।
২. গঙ্গা এয়ারলাইন্সের প্রাচীনতম উড়োজাহাজের একটি, যা অপারেশন থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
৩. হাইজ্যাকে ক্ষতি ন্যূনতম রাখার জন্য গঙ্গাকেই আবার অপারেশনে আনা হয় এবং একটি অপারেশনই হাইজ্যাকে সমাপ্ত হয়।
৪. হাশিম কুরেশি শুরুতে ভারতীয় গোয়েন্দা এজেন্ট কিংবা ডাবল এজেন্ট ছিলেন।
৫. হাইজ্যাকার দুজন খেলনা পিস্তল ও ভুয়া গ্রেনেড দিয়ে হাইজ্যাক সফল করেন।

‘র’ পাকিস্তানকে হাইজ্যাকের ফাঁদে ফেলে যুদ্ধ শুরুর আগেই যুদ্ধে হারিয়ে দেয় একাত্তরের ৩০ জানুয়ারি। (উৎস : একাত্তরের দলিল তিন খণ্ড, আন্দালিব রাশদী)

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়