আশালতা : নজরুলের উত্থান-পতনময় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য নাম

আগের সংবাদ

বর্ষায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কা চট্টগ্রাম নগরবাসীর : চসিক-চউক ব্যস্ত দোষারোপে

পরের সংবাদ

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সংবর্ধনা : শিক্ষার আলো ছড়ানো মাধুরী বণিক জাতীয় পতাকা জড়িয়ে মরতে চান

প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আয়েন উদ্দীন : আজ থেকে ৫৫ বছর আগে এক কিশোরী শিক্ষার আলোবঞ্চিত এক গ্রামের শিশুদের আলোকিত করার ব্রত নিয়েছিলেন। ৬৫ বছর বয়সে এখনো তিনি বই হাতে ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ান। কখনো গাছতলা, কখনো ঘরের উঠানে শিশুদের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার পানালিয়া গ্রামের মাধুরী বণিক।
শিক্ষানুরাগী মাধুরী বণিককে সম্মান জানাতে তার গাছতলার পাঠশালায় গতকাল শুক্রবার গিয়ে হাজির হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। খোলা আকাশের নিচে গড়ে ওঠা স্কুুলে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও স্কুলের শিশুদের বই ও ছবি আঁকার উপকরণ উপহার দেয়া হয়। মাধুরী বণিককে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
১৯৬৮ সালে নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন মাধুরী। পানালিয়া গ্রামের তাঁত অধ্যুষিত এলাকার ছেলেমেয়েরা দারিদ্র্যের কষাঘাতে স্কুলে যেতে পারত না। সমাজের এই বৈষম্য তাকে নাড়া দিত। মাধুরী বলেন, আমাদের বাড়ির আশপাশে শিশুরা কেউই স্কুলে যায় না এ কথা মা মিলন বণিককে বলি আমি ওদেরকে বাড়িতে পড়াব। মা বললেন, তোমার পড়াশোনার পাশাপাশি তুমি যতটুকু সময় পাও সেই সময়টাতে তুমি শিশুদের পড়াবে। ১০ জন শিশু শিক্ষার্থী নিয়ে নিজঘরের উঠানে এভাবেই পাঠশালার শুরু। নাম দেই ‘মা ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্র’। মানুষ পয়সার জন্য ছোটে, আমি বিনা পয়সায় আমার শিক্ষকতা শুরু করি। এ প্রতিষ্ঠানে অনেকেই স্বেচ্ছাশ্রমে শিশুদের পাঠদান দিচ্ছেন। শিশুরা যাতে স্কুলে আসতে উৎসাহী হয়, এ জন্য শিশুদের চকলেট-বিস্কুট দিই।
আজ থেকে ৫৫ বছর আগে যেভাবে শুরু করেছিলেন সেভাবেই খোলা আকাশের নিচে চলছে মাধুরীর স্কুল। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে পাঠশালার কার্যক্রম চালু রেখেছেন। এখনো পড়ানোর ঘর নেই। তিল তিল করে গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধা শহীদ স্মৃতি পাঠাগারটি জীর্নশীর্ণ। তার দীর্ঘদিনের এই সংগ্রামকে সম্মান জানিয়ে সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল মাধুরীর হাতে লাইব্রেরির জন্য ৬ শতাধিক বই ও ১ লাখ ৩ হাজার টাকা তুলে দেয়া হয়।
এ সময় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, নবাবগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামের মাধুরী বণিক গত তিন দশক ধরে মায়েদের জন্য পাঠাগার এবং শিশুদের জন্য গাছতলায় পাঠশালা স্থাপন করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদানের যে মহান উদ্যোগ নিয়েছেন, এ জন্য আমরা জাতি হিসেবে গর্বিত। আমরা আশা করব দেশ ও জাতির কল্যাণে বঙ্গবন্ধু আদর্শের সৈনিক মাধুরী বণিকের এই অসামান্য অবদানের জন্য তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা ও স্বাধীনতা পদক দেয়া উচিত। এ সময় তিনি স্থায়ী পাঠাগার ও পাঠশালা প্রতিষ্ঠার জন্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মৌলবাদ ও সা¤প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, মাধুরী বণিক তার কাজের মাধ্যমে যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন তা এ সময়ে একেবারেই বিরল। তিনি মাত্র নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও তার জ্ঞানের পরিধি অনেক। সেই জ্ঞান তিনি শিশুদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের

.চেতনায় শিশুদের গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন। মাধুরী বণিকের পাঠশালার কার্যক্রম চালাতে তিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার আহ্বান জানান।
মাধুরী বণিক শুধু শিশুদের শিক্ষা দেন না, মায়েদেরও বই পড়ান। নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, শিশুদের মানসপট গঠনের জন্য মাধুরী বণিক ঘরে ঘরে গিয়ে মায়েদের কাছে বই পৌঁছে দেন- মায়েরা বই পড়ে বাচ্চাদের জ্ঞান দান করতে পারেন। জাতি গঠনের জন্য এমন দৃষ্টান্ত কখনো দেখিনি। আশা করি, আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মাধুরী বণিকের মতো শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো ছড়াব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে আমরা যদি নিজের অবস্থান থেকে এরকম মহতী কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত রাখি তাহলে অচিরেই বাংলাদেশ আরো সমৃদ্ধির পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে।
মাধুরী বণিককে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ, সহসভাপতি চারুশিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বারক আলভী, সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক লেখক আলী আকবর টাবী, আইটি সেলের সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময় ও জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের নির্বাহী সভাপতি আবৃত্তিশিল্পী মো. শওকত আলী। এ সময় নবাবগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান এবং কলাকোপা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল স্থায়ী পাঠাগার ও স্কুল গড়ায় সহযোগিতার প্রতিশ্রæতি দেন।
ছাত্রজীবনে মাধুরী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি নারী আন্দোলন শুরু করেন। এ সময়ে প্রতিষ্ঠা করেন নবাবগঞ্জ উপজেলা মহিলা সংঘ। মাধুরী জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অস্ত্র সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করছেন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেননি। কখনো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবিও করেননি। বিয়ে-সংসার শিক্ষা আলো ছড়ানোয় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাই কুমারী জীবন কাটাচ্ছেন। জীবনে নিজের মতো করে কিছুই ভাবেননি। তার একটাই চাওয়া- শেষ জীবনে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে মৃত্যুবরণ করতে চান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়