শেয়ারট্রিপ : অনলাইনে তারিখ পরিবর্তন ও রিফান্ড সেবা চালু

আগের সংবাদ

চিকিৎসা ব্যয়ে পিষ্ট রোগীরা : চিকিৎসায় রোগীর নিজস্ব ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ, সবচেয়ে বেশি ব্যয় ওষুধ কিনতে- ৬৫ শতাংশ

পরের সংবাদ

খোকা থেকে জাতির পিতা

প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি বৃক্ষ যেমন হঠাৎ করে বড় হয় না, পরিবেশের সঙ্গে নিয়ত সংগ্রাম করে তাকে বেড়ে উঠতে হয়, তেমনি একজন মানুষও শৈশব থেকে হঠাৎ করে বড় মানুষ হতে পারে না। নানা ধরনের বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে বড় হতে হয়।
পশু-পাখি, বৃক্ষ, লতা প্রাকৃতিক নিয়মে বেড়ে ওঠে, মানুষ তার ব্যতিক্রম। মানুষ সব সময় প্রকৃতি নির্ভর নয়। প্রকৃতি তার অনুকূল না হলে সে প্রকৃতিকে তার নিজের মতো করে তৈরি করে। মানুষ নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবেশ রচনা করে। এই পরিবর্তন সাধন করে মানুষ তার মেধা, প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার বলে। এ কারণে মানুষ শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ মানুষদের যারা পরিচালনা করেন তারা শ্রেষ্ঠতর, যাকে আমরা ক্ষণজন্মা, মহামানব বা মহাপুরুষ বলে থাকি। মহামানব হওয়ার লক্ষণগুলো শৈশবেই তাদের চরিত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন আরব দেশের পরিবেশ সভ্যতার অনুকূলে ছিল না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, রাহাজানি, মিথ্যা, জোচ্চুরি ছিল তাদের নিত্যদিনের সহচর। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ ছিল তখনকার নিয়ম। সেই সময়ে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও নিকৃষ্ট পরিবেশের কালিমা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। নিজের চেষ্টায় তিনি সেই কদর্য পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। মিথ্যাচারিতার সমুদ্রে বাস করেও তিনি সত্যে অবিচল থেকেছেন। আরববাসী শৈশবেই তাকে ‘আল-আমীন’ অর্থাৎ সত্যবাদী উপাধী দিয়েছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর মধ্যেও মহৎ হওয়ার কিছু গুণ দেখা দিয়েছিল। স্কুলে পড়ার সময় একবার ছাত্রদের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বালক জিন্নাহ্ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করার জবাবে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘আমাদের দৌড়াতে বলা হয়েছে, কিন্তু কোথায় গিয়ে থামতে হবে তা বলা হয়নি। গন্তব্য না জেনে দৌড়ানো যায় না।’ বালক জিন্নাহ্ পরবর্তীকালে অনেক বড়ো আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হয়েছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিলেন। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী তাকে কায়েদে আজম অর্থাৎ জাতির মহান নেতা সম্বোধন করতেন। এছাড়া মুসলিম বিশ্বের অনেক মহান ব্যক্তির কথা বলা যায় যাদের মধ্যে রয়েছেন, ইমাম বুখারী (র.), ইবনে সীনা, হজরত আবদুল কাদের জিলানী (র.), মওলানা রুমী, ইমাম আল-গাজ্জালী (র.), ইবনে খলদুন প্রমুখ। বিশ্বের অন্যান্য মহাপুরুষদের কথা বলতে গেলে প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখিত দৃষ্টান্তের আলোকে বাংলাদেশেও এমনি এক মহামানব জন্মগ্রহণ করেছিলেন টুঙ্গিপাড়া গ্রামে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। তার নাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশবে তার নাম ছিল খোকা। গ্রামবাসী তাকে ‘মিয়াভাই’ বলে ডাকত। শৈশবেও তার মধ্যে অন্যান্য মহাপুরুষদের মতো কয়েকটি অসাধারণ গুণের বিকাশ লক্ষ্য করা গেছে। তার সবচেয়ে বড়ো দুটি গুণ ছিল; সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর মহত্ববোধ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা। এই দুটি গুণের পরিচয় আমরা তার সমগ্র জীবনের ঘটনাবলির মধ্যে দেখতে পাই। এই দুটি গুণের জোরে তিনি খোকা থেকে একটি জাতির পিতা হতে পেরেছিলেন। তার একটি মাত্র ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার জন্য গোটা জাতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৩০ লাখ লোক বিনা দ্বিধায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। বিশ্বের মহামানবদের কাতারে তিনি তার স্থান করে নিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে গোটা বাঙালি জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন।
শেখ মুজিবের বাল্যবন্ধু সৈয়দ নুরুল হক (মানিক মিয়া) বলেছেন, গিমডাঙ্গা স্কুলে পড়ার সময় মুজিবের ক্লাসের এক ছাত্র জামার অভাবে স্কুলে যেতে পারছিল না। তা জানতে পেরে বালক মুজিব তার গায়ের জামা খুলে ওই ছাত্রকে দান করে গেঞ্জি গায়ে বাড়ি ফিরেছিল। তিনি আরও বলেন, মিশন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় মুজিবের ক্লাসের একটি ছেলে লুঙ্গির অভাবে স্কুলে যেতে পারছিল না। মুজিব ওই ছেলেকে নিজের পরনের লুঙ্গি খুলে দিয়ে গায়ের চাদর পরে বাড়ি ফেরে (সূত্র : মানুষের বন্ধু বঙ্গবন্ধু, সম্পাদনা : মুনতাসীর মামুন)।
আরেকবার পথের ধারে এক দরিদ্র বৃদ্ধকে শীতে কষ্ট পেতে দেখে মুজিব তার গায়ের চাদরখানা তাকে পরিয়ে দিয়েছিল। এক ছাত্রকে বৃষ্টিতে ভিজে পথ চলতে দেখে মুজিব তার নিজের ছাতা ওকে দান করে নিজে ভিজতে ভিজতে বাড়ি আসে। দেশে একসময় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছিল। মুজিব নিজ বাড়ির গোলাঘর থেকে ধান নিয়ে তাদের মধ্যে বিতরণ করে। সে সময় তার বাবা গোপালগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি মুষ্টি ভিক্ষার চাল সংগ্রহ করে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মধ্যে বিতরণ করেছিল। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় মুজিব ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করে উপদ্রুত এলাকার হিন্দু মুসলমানের প্রাণ বাঁচায় এবং তাদের বাড়িঘর, ধনসম্পদ রক্ষা করে। গরিব ছাত্রদের জন্য সে লজিং জোগাড় করে দিত।
মুজিব অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তাদের স্কুল পরিদর্শনে আসেন। সঙ্গে মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলের সমস্যা বিষয়ে তাদের কিছুই অবহিত করেনি শুনে মুজিব কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে তাদের পথরোধ করে। তারা তখন স্কুল পরিদর্শন শেষে কলকাতা ফিরছিলেন। মুজিব বলে, আপনারা আমাদের স্কুলের সমস্যার সমাধান না করে যেতে পারবেন না। বালক মুজিবের সাহস দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন তারা। সোহরাওয়ার্দী তখনই বুঝেছিলেন, এই ছেলে ভবিষ্যতে একদিন বড় নেতা হবে। তিনি মুজিবকে তার ঠিকানা লিখে দিয়ে তার সঙ্গে কলকাতা গিয়ে দেখা করতে বলেন। এ ধরনের অনেক মানবিক ও দুঃসাহসী ঘটনা শৈশবে মুজিবের জীবনে ঘটেছিল, যা তার বড় হওয়ার ভিত্তি রচনা করে। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে মুজিব তার প্রতি সমর্থন জানায়, তার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছাত্রও ছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুজিবসহ ১৮ জন ছাত্রকে আর্থিক জরিমানা এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে। অন্য ছাত্ররা জরিমানা দিয়ে মুচলেকা দিলে কর্তৃপক্ষ তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়। শেখ মুজিব জরিমানা বা মুচলেকা দিতে অস্বীকার করায় তাকে স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। এমনিভাবে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনসহ দেশের সবকটি সরকার বিরোধী আন্দোলনে মুজিব নেতৃত্ব দেন। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি কারাগারে আটক ছিলেন। জনগণ তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত কর। সরকার তার সঙ্গে আপস করতে চাইলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। মৃত্যুদণ্ডের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার লাশ আমার বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও।’ তিনি প্রাণ ভিক্ষা করেননি, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। বিবিসির জরিপে তিনি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন। কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্বের জন্য গোটা বাঙালি জাতি আজ বিশ্ব দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের আসনের মর্যাদা লাভ করেছে। এতদসত্ত্বেও যারা বঙ্গবন্ধুর নিন্দা করে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরোধিতা করে তারা বাঙালি জাতির কলঙ্ক। তাদের নিন্দা করার ভাষা বিশ্বের কোনো ভাষায় আজও রচিত হয়নি। যে জাতি বড়ো হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাকে কোনো কুলাঙ্গার ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়