ভারত মিয়ানমার থাইল্যান্ড : কানেক্টিভিটি প্রকল্পে যুক্ত হতে আগ্রহী বাংলাদেশ

আগের সংবাদ

শুভ জন্মদিন পিতা

পরের সংবাদ

ফের ‘ভেরিফিকেশন’ নাটক! : মিয়ানমার থেকে আসা ১৭ সদস্যের প্রতিনিধিদল টেকনাফে

প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য (ঢাকা) ও জাবেদ ইকবাল চৌধুরী (কক্সবাজার) : নানামুখী চাপে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হলেও কবে সেই প্রক্রিয়া শুরু হবে তার দিনক্ষণ এখনো জানায়নি। এ অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ফের ভেরিফিকেশন শুরু করেছে। আগামী ৫/৬ দিনের মধ্যে এ দফায় ৪২৯ রোহিঙ্গার ভেরিফিকেশন শেষ করবে বলে জানিয়েছে টেকনাফে আসা মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল। প্রসঙ্গত, প্রায় বছর তিনেক আগে নিজভূমে ফিরিয়ে নিতে ৭১১ রোহিঙ্গার ভেরিফিকেশন শেষ করেছিল মিয়ানমার। এ দফায় ভেরিফিকেশন হবে আরো ৪২৯ রোহিঙ্গার। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে শুধু ভেরিফিকেশন নাটকই হচ্ছে। প্রত্যাবাসন দূর-অস্ত।
জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষক শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে যাচাই-বাছাই কিংবা ভেরিফিকেশনের নামে কালক্ষেপণ করা হয় কিনা- সে বিষয়ে আমাদের গভীর নজর থাকবে। যাচাই-বাছাই শেষে যদি মিয়ানমার সরকারের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হয় তাহলে আমরা সাধুবাদ জানাব। তবে বিষয়টি কিছুটা জটিল হয়ে গেছে উল্লেখ করে সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। তারা নিপীড়িত হয়ে এখানে এসেছে। এখন তারা ফিরে যেতে চায়। এখানে যাচাই-বাছাই আবার কীসের। যাচাই-বাছাই হওয়ার পর না হয় বাবা-মায়ের নাগরিকত্ব চূড়ান্ত হলো। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে যেসব শিশু জন্ম নিয়েছে তাদের নাগরিকত্বের কী হবে- প্রশ্ন এই কূটনীতিকের।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন হলেও চীন গত পাঁচ বছর ধরে মিয়ানমার সরকারের নিন্দা করেনি। এ অবস্থায় সেই চীন এখন পাইলট আকারে কিছু রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে পাঠাতে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চায়। এ কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের নতুন পাইলট প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হচ্ছে চারদিকে। এতদিন বাংলাদেশে এবং বিদেশে সবাই বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ন্যূনতম একটা শর্ত হতে হবে সেখানকার নাগরিক

আইনের পরিবর্তন। সেটা চলতি উদ্যোগে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে কিছু বলা হচ্ছে না। এর মধ্যেই গত ৮ মার্চ মিয়ানমার সরকার চীন, ভারতসহ সে দেশে থাকা কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের আরাকান অঞ্চল দেখাতে নিয়ে যায়। তারা বোঝাতে চাইছে, কিছু পরিমাণ রোহিঙ্গাকে গ্রহণের জন্য আরাকান প্রস্তুত। এরপরই গতকাল বুধবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল এসেছে। তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চালাবেন বলে জানা গেছে। ১৭ জনের প্রতিনিধিদলটি মিয়ানমারের রাখাইনের মংডু টাউনশিপ থেকে বুধবার সকাল সোয়া ১০টায় স্পিডবোটে নাফ নদী পার হয়ে টেকনাফ ট্রানজিট জেটি ঘাটে এসে পৌঁছায়। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি কর্মকর্তা তাদের স্বাগত জানান। এরপর সকাল ১১টা থেকে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা টেকনাফ স্থলবন্দরের অভ্যন্তরে মালঞ্চ সম্মেলন কক্ষে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করে।
জানতে চাইলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে মিয়ানমার ইমিগ্রেশন বিভাগের কর্মকর্তারা এসেছেন। দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন দেশটির মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ। কমিশনার আরো বলেন, প্রতিনিধিদলটি মিয়ানমারে ফিরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করবে। এছাড়া তাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের কথাও রয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ আট লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছে। ওই তালিকা থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে এক হাজার ১৪০ জনকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে ভেরিফিকেশন বছর তিনেক আগে শেষ হলেও বাকি ৪২৯ জনের ব্যাপারে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি এখন ওই ৪২৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাইয়ের জন্য টেকনাফে এসেছেন।
মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অংশ নিয়ে টেকনাফের লেদা ও শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মাস্টার সৈয়দ উল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, মূলত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন, মিয়ানমারের কোথায় আমাদের বাড়ি, শহর কোনটি। এই শহরে কী কী আছে প্রভৃতি বিষয় জানার চেষ্টা করছে প্রতিনিধিদলটি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরো চার লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ সে সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এই হত্যা ও নির্যাতনকে চিহ্নিত করেছিল ‘জাতিগত নিধনের ধ্রæপদী উদাহরণ’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি বছরের মার্চে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো ওই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর প্লাস্টিকের খুপরি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সুচি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার একপর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রæতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। এরপর আসে করোনা মহামারি, রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের মনোযোগে ঢিল পড়ে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই সুচির দ্বিতীয় দফার সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের কয়েক দিন আগে চীনের নেতৃত্ব প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিল। তার চূড়ান্ত ফল আর পাওয়া যায়নি। ওই সময় বাংলাদেশ আশা করেছিল, ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে হয়তো প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে। সেই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকারে রাখা বাংলাদেশ সরকার বারবার অভিযোগ করে আসছে, আন্তর্জাতিক মহল প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের এক বছরের মাথায় বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে নবগঠিত ‘অ্যাডহক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পার্সনস ফ্রম রাখাইন’ এর বৈঠক হয়। এরপর গত বছরের ১৪ জুনে হয় দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি)’ সভা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব চ্যান আয়ে বৈঠকে নিজ দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের যে তালিকা দেয়া হয়েছিল, মিয়ানমারের তা যাচাই করে দেখার কথা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখনো ওই পর্যন্তই। যদিও ওই সভা শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছিলেন, হতাশ হলে সব শেষ। আমাদের চেষ্টা আমাদের স্বার্থেই করতে হবে। যেহেতু আমাদের জন্য বড় চাপ, আরো বেশি চেষ্টা করতে হবে। আমরা এখনো আশাবাদী যে, বছরের শেষে বা বছর শেষের আগে হয়তো (প্রত্যাবাসন) শুরু করতে পারব।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পররাষ্ট্র সচিবের আশার বাণী অনুযায়ী বছর শেষে অর্থাৎ ২০২২ এর শেষে প্রত্যাবাসন তো হয়নি; বরং ২০২৩ এর শুরুতে এসে আবারো শুরু হয়েছে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের ভেরিফিকেশন। এই ভেরিফিকেশন করার জন্য গতকাল বুধবার মিয়ানমার থেকে ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এসছে। তারা যাচাই-বাছাই করছে। সেই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের পরিচালক মো. বারিকুল ইসলাম। গতকাল ভোরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, তারা যাচাই-বাছাই করছেন। যাচাই-বাছাই শেষে কী হবে বা যারা যাচাই-বাছাই করছেন তারা কী বলবেন তা আমি বলতে পারি না। তবে আমিও আপনাদের মতো আশাবাদী, রোহিঙ্গারা নিজভূমে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু কবে ফিরবে তা আমার লেভেল থেকে বলা সম্ভব নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়