চলতি সপ্তাহে ঝড় বৃষ্টির সম্ভাবনা

আগের সংবাদ

গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ ঘাটতির আশঙ্কা : সেচের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে > ঘাটতি থাকবে ৩ হাজার মেগাওয়াট

পরের সংবাদ

উদ্বিগ্ন বন্দর ব্যবহারকারীরা : চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো

প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সমরেশ বৈদ্য, চট্টগ্রাম থেকে : চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা-পরিবহন-আনসারসহ কন্টেইনার খালাসের সঙ্গে জড়িত অপারেটর কর্মচারীদের যোগসাজশে বন্দরে একটি শক্তিশালী পাচারচক্র গড়ে উঠেছে। এরা নানা কায়দায় জাল কাগজপত্র তৈরি করে বন্দরের ভেতর থেকেই পণ্যভর্তি কন্টেইনার পাচার করে আসছে। কারণ যারা নিরাপত্তা দেবেন বন্দর ইয়ার্ডে রাখা কন্টেইনারসহ অন্য পণ্যের, তারাই যদি এ ধরনের অপরাধে জড়িত থাকেন তাহলে তো বন্দরের নিরাপত্তা ‘বজ্র আঁটুনি ফসকাগেরো’ হয়েই আছে। এমনতর পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা সত্যিকার অর্থে কতটুকু নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রসঙ্গত, বন্দরের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াও তাদের অধীনে আনসার সদস্য, সিসিটিভি ক্যামেরা, বন্দরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় পণ্যবাহী কন্টেইনার স্ক্যান করার জন্য স্ক্যানার রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকও সেখানে কাজ করেন। এতসব নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য থেকে পণ্যভর্তি কন্টেইনার পাচার হওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
এরই মধ্যে সম্প্রতি জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যভর্তি কন্টেইনার পাচারের সঙ্গে জড়িত একটি সিন্ডিকেটকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। ইতোপূর্বে মদভর্তি কন্টেইনার পাচারের ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষী মোজাম্মেল হোসেন রবিন এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বদাতা বলে জানিয়েছে পুলিশ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক ভোরের কাগজকে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘ইয়ার্ড থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে কন্টেইনার নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে কয়েকজন কর্মচারীর সম্পৃক্ততার তথ্য আমরা পেয়েছি। মামলা হয়েছে, বিষয়টি এখন পুলিশ তদন্ত করে দেখছে। পাশাপাশি বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর কমান্ডার সাজ্জাদের নেতৃত্বে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তাকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। বন্দর সচিব ফারুক বলেন, যে ইয়ার্ড থেকে কন্টেইনারটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেখানে পুরোপুরিভাবে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ইয়ার্ডটি একটু দূরে। তবে পাচারকারী চক্র যেহেতু ধরা পড়েছে, আশা করি এ ব্যাপারে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম বন্দরের সাউথ কন্টেইনার ইয়ার্ড (গুপ্তখাল) থেকে তিনটি ট্রেইলরে (লরি) পণ্যবোঝাই দুটি কন্টেইনার বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় গেটে আটকে দেয়া হয়। দায়িত্বরত একজন গোয়েন্দা সদস্যকে মারধর করে একটি খালি ট্রেইলর নিয়ে চালকের সহকারী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাকি দুটি ট্রেইলর ও কন্টেইনার এবং চালক ও সহকারীসহ চারজনকে আটক করেন বন্দরের নিরাপত্তারক্ষীরা। তাদের দেয়া তথ্যে পরবর্তীতে স্থানীয় ইপিজেড থানা পুলিশ বন্দরের পরিবহন ও নিরাপত্তা বিভাগে কর্মরত চারজনকে আটক করে। আটক আটজনসহ মোট নয়জনের বিরুদ্ধে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালকের কার্যালয়ের অধীন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মারুফ হোসেন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।
গ্রেপ্তার হওয়া আটজনের মধ্যে বন্দরের চারজন হলেন- পরিবহন বিভাগের নিম্নমান বহিঃসহকারী মো. আব্দুল হাকিম (৩৪), নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালকের কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী কাজী আবু দাউদ (৪৮) এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা শাখায় পদায়ন হওয়া আনসার সদস্য অনুকুল বিশ্বাস (২৫) ও এনামুল হক। গ্রেপ্তারকৃত বাকি চারজন হলেন- লরিচালক জালাল উদ্দিন (২৩),

আইয়ূব আলী (২৩), নাজমুল হোসেন (২৭) এবং সহকারী নুরুল ইসলাম (২০)। একই মামলায় সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় থাকা বন্দরের নিরাপত্তা পরিচালকের দপ্তরের নিরাপত্তারক্ষী মোজাম্মেল হোসেন রবিনের (৩৭) সঙ্গে কন্টেইনার খালাসের যন্ত্রাংশ পরিচালনায় নিয়োজিত অপারেটরসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৫-৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। যেসব পণ্য বন্দর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে- আমদানি করা প্রায় ২৯ লাখ টাকার ২৫ মেট্রিক টন প্লাস্টিকের দানা ও প্রায় ৫ লাখ টাকার ৩২ রোল ফেব্রিকস।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীরা এ ধরনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ড এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন ভোরের কাগজকে বলেন, বন্দরের ভেতর থেকে অবৈধভাবে পণ্য পাচার হওয়ার ঘটনাটি ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত আতঙ্কজনক। কাস্টমস, বন্দরসহ সব প্রতিষ্ঠানের এসব ব্যাপারে আরো বেশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তিনি বলেন, আমরা বারবারই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির বিষয়টি অনলাইন প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার দাবি জানিয়ে আসছি। এতে করে জালিয়াতি চক্র অনেকটা কোণঠাসা হতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে তাদের কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কারণ, সেখানে কাস্টমস সদস্য ছাড়াও বাইরের কিছু লোক কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করে থাকে। তারাই অনেক ক্ষেত্রে পাসওয়ার্ড খুলে পণ্য খালাসের জন্য কাগজপত্র তৈরির চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকে।
চট্টগ্রাম ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল করিম বলেছেন, ‘আটজনকে গ্রেপ্তারের পর আমরা আদালতের নির্দেশে একদিনের রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। বন্দরের কর্মচারী, আনসার সদস্য, লরিচালক, সহকারী মিলে এটা পুরো একটা চক্র, যারা জাল নথিপত্র দিয়ে কন্টেইনার খালাসের চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত। সর্বশেষ যে দুটি কন্টেইনার বন্দরের ইয়ার্ড থেকে বের করে নেয়া হচ্ছিল, সেগুলোর জন্য কোনো নথিপত্রও দাখিল করা হয়নি। বন্দরের নিরাপত্তাকর্মী বাধা দিলে তাকে মারধর করা হয়।’
সূত্রমতে, কন্টেইনার ইয়ার্ডের গেটে দুই শিফটে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের কর্মী এবং একই সঙ্গে তিন শিফটে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। প্রতি শিফটে বন্দরের দুজন নিরাপত্তারক্ষী এবং একজন গোয়েন্দা নিরাপত্তা সদস্য থাকেন। তাদের সঙ্গে প্রথম দুই শিফটে তিনজন এবং তৃতীয় শিফটে চারজন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। নিয়ম অনুযায়ী, জাহাজ থেকে কন্টেইনার খালাসের পর আমদানিকারকের প্রতিনিধি কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের অংশ হিসেবে বন্দরের শুল্ক বিভাগে একটি বিল অব এন্ট্রি প্রদান করে থাকে। বন্দরের যাবতীয় ফি এবং কাস্টম হাউসে পণ্যের জন্য নির্ধারিত শুল্ক কর পরিশোধ করার পর আমদানিকারককে পণ্য খালাসের অনুমতি দেয়া হয়। খালাস প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সময় বন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। খালাস শেষে দেয়া ছাড়পত্র নিরাপত্তা বিভাগে জমা দিতে হয়। নিরাপত্তা বিভাগের অনুমোদনের পর ছাড়পত্রের কপি গেটে জমা দিয়ে তবে পণ্যবাহী পরিবহনকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।
তবে পণ্যভর্তি কন্টেইনার বের করে নেয়ার ঘটনার পর এখন বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের নজরদারির শিথিলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সূত্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার দিন সকাল ৮টায় বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের এএসআই মারুফ হোসেনের কাজে যোগ দেয়ার সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তিনি পৌনে ৯টার দিকে গেটে পৌঁছান। গোয়েন্দা নিরাপত্তা সদস্য নজরুল ইসলাম একাই ট্রেইলরগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং তাদের হামলার শিকার হন।
ওসি আব্দুল করিম বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে আমরা তথ্য পেয়েছি, সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় থাকা বন্দরের নিরাপত্তারক্ষী নথিপত্র জমা না দিয়ে লরিচালকদের ইয়ার্ডে প্রবেশের ব্যবস্থা করেন। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া বন্দরের কর্মচারী ও আনসার সদস্যদের যোগসাজশ আছে। যারা খালাসে জড়িত তারাও পর্যাপ্ত নথি চেক করেননি অথবা নথিপত্র ছাড়াই পণ্য নিয়ে যেতে তাদের সহযোগিতা করেছেন বলে আমাদের মনে হচ্ছে। লরিগুলো যেসব প্রতিষ্ঠানের তাদের কারও সম্পৃক্ততা আছে কিনা সেটাও আমরা যাচাই করে দেখছি।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়