মাদ্রাসা কর্মচারীর কাণ্ড : জাতীয় পরিচয়পত্র ও এমপিওতে ভিন্ন তারিখ!

আগের সংবাদ

যে কারণে দলে নেই মাহমুদউল্লাহ

পরের সংবাদ

ভিন্ন সংগঠনের নামে জমায়েত : নতুন কৌশল নিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা জামায়াতের

প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এস এম মিজান : দীর্ঘদিন মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় নয় জামায়াতে ইসলামী। ইস্যুকেন্দ্রিক গণমাধ্যমে কিছু বিবৃতি পাঠানো আর মাঝেমধ্যে রাজধানীতে ঝটিকা মিছিল বের করা ছাড়া তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই বললেই চলে। সূত্র বলছে, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ দশ দফা দাবি আদায়ে বিএনপিসহ রাজপথের বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নিজেদের সক্রিয় করার চেষ্টা করছে স্বাধীনতাবিরোধী দলটি। যদিও বিএনপি কৌশলে দলটিকে এড়িয়ে চলার নীতিতে রয়েছে। এ অবস্থায় রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা দলটির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সংগঠনের নামে রাজধানীসহ সারাদেশে গোপনে সংগঠিত হচ্ছে। এভাবে ‘নতুন কৌশলে’ রাজপথে সক্রিয় থেকে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
জানা যায়, গত শনিবার সন্ধায় রাজধানীর দারুস সালাম থানাধীন মিরপুর-১ ক্যাপিটাল মার্কেটের ‘ফোর সি’ নামে একটি রেস্টুরেন্টে ‘জাকাত ব্যবস্থা’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। মূলত যাকাত ব্যবস্থা শীর্ষক আলোচনা সভার আড়ালে গোপনে সংগঠিত হয়েছিল জামায়াত-শিবিরের শতাধিক নেতাকর্মী। যদিও প্রোগ্রামটি জামায়াতের ব্যানারে ছিল না। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালিয়ে ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে আটটি ককটেল উদ্ধার দেখিয়ে

বিস্ফোরকসহ বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। এ বিষয়ে মিরপুর বিভাগের দারুস সালাম জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. জামিনুর রহমান খান বলেন, মিরপুর-১ এর ক্যাপিটাল মার্কেটের একটি রেস্টুরেন্টে রাষ্ট্রবিরোধী দুরভিসন্ধিমূলক কার্যক্রম চলছে- এমন সংবাদ পেয়ে অভিযান পরিচালনা করে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। তাদের আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড চাওয়া হবে।
দারুস সালাম থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ওই রেস্টুরেন্টে জামায়াতের ব্যানারে কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। কিন্তু আলোচনা সভাটির আয়োজনে জামায়াতের নেতাকর্মীরাই যুক্ত ছিলেন। সেখানে অভিযান চালিয়ে ৬০ থেকে ৭০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন মামলার আসামি। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন জামায়াতের গ্রেপ্তার ৫৭ জন ছাড়াও পালিয়ে যাওয়া আরো ৩০ থেকে ৪০ জন মিলে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই এই বৈঠকের আয়োজন করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালিয়ে তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছে পুলিশ।
তবে জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রচার বিভাগের পরিচালক আতাউর রহমান বলেন, জাকাত ইসলামের একটি মৌলিক বিধান। ওই রেস্টুরেন্টে জাকাত শীর্ষক সেমিনার চলছিল। সেখানে আগত এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি এবং মার্কেটে আগত অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে বিনা অপরাধে আটক করে নিয়ে যাওয়া দুঃখজনক। তিনি আরো বলেন, সভা-সমাবেশ করা মৌলিক অধিকার। বিনা অপরাধে এভাবে আটকের ঘটনায় দেশে অস্থিরতা বাড়বে। আমরা আশা করব, নিরপরাধ মানুষকে কষ্ট না দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ছেড়ে দেবে।
এর আগে গত ৪ মার্চ চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার জামালখান এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে ‘টি টোয়েন্টি প্লাস’ নামে একটি সংগঠনের অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অনুষ্ঠানে হানা দেয় কোতোয়ালি থানা পুলিশ। সেখান থেকে ৩০ জনকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। গ্রেপ্তার সবাই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মামলার অভিযোগে বলা হয়, অভিযুক্তরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহের কর্মক্ষমতা ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়।
এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত বিভিন্ন কৌশলে সংগঠিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে নামে-বেনামে খোলা হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন। ৪ মার্চ রাতে জামালখান এলাকায় ‘টি টোয়েন্টি প্লাস’ নামে একটি সংগঠনের অভিষেক অনুষ্ঠানের আড়ালে দলটির নেতাকর্মীরা গোপন বৈঠক করছিল। ওই সংগঠনের এবং জামায়াতের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী একই তারিখে। পরে সেখানে অভিযান চালিয়ে ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জানা যায়, একই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েকশ নেতাকর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন গোপন বৈঠককালে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী এভাবে ‘নতুন কৌশলে’ এগোচ্ছে। গোপনে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ দশ দফা দাবি ও জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে শক্তি দেখাতে চাইছে। জানা গেছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম দুই কর্মসূচিতে পৃথকভাবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলে অংশ নেয় জামায়াত। এর মধ্যে ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিল করতে গিয়ে মালিবাগে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও লাঠিপেটার শিকার হন নেতাকর্মীরা। এতে অনেকে আহত হন, অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু এ ঘটনায় বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন- কার্যত এরপর জামায়াত পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। কারণ সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের যাত্রা বা কর্মসূচির বিষয়ে বিএনপি অন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করলেও জামায়াতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। তবে দলটির নেতাকর্মীরা বসে নেই। গোপনে সারাদেশে চালাচ্ছে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর সারাদেশে জামায়াতের রাজনীতিতে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রশাসনিক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এছাড়া ২০১৩ ও ২০১৫ সালে আগুনসন্ত্রাসের মামলায় দলটির নেতকর্মীদের নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। মোকাবিলা করতে হচ্ছে অসংখ্য মামলা। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজনীতির মাঠে ফিরছেন একাধিক মামলা মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন পলাতক ও আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা।
প্রযুক্তির মাধ্যমে গোপনে সংগঠিত হচ্ছে জামায়াত-শিবির : প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ না করে ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জামায়াত-শিবির সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়াতে অনলাইনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। জানা গেছে, সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক কার্যক্রম চলছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কর্মীদের সঙ্গে নেতারা সাংগঠনিক যোগাযোগ রাখছে। সুযোগ পেলেই তারা বৈঠকে মিলিত হচ্ছে। অনলাইন লাইব্রেরির মাধ্যমে সংগঠনের আদর্শ প্রচার করছে।
কৌশলে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনীতির মাঠে ‘সুসংগঠিত’ দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে চুপ থাকার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। মাঠের রাজনীতি অনুকূলে না থাকায় নেতাকর্মীদের মন এখন দল গোছানোর দিকে। কেন্দ্রের নির্দেশনা মতো আনুষ্ঠানিক বৈঠকের বদলে নানা কৌশলে সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ভেতরে ভেতরে সারাদেশে কাজ চলছে দলের। আগে গোপনে বৈঠক করার যে ধারাটি ছিল, সেটিও এখন আর সেভাবে হচ্ছে না। তবে আগের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক কাজ করতে না পারলেও বসে নেই দলটির নেতাকর্মীরা। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র থেকে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী তৃণমূল পর্যায়েও ভিন্ন কৌশলে চালানো হচ্ছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। কখনো কখনো সবার কাছে দলীয় সিদ্ধান্ত পৌঁছে যাচ্ছে ব্যক্তিগত আলাপে। কখনো আবার আড্ডার ফাঁকে সেরে নেয়া হয় সাংগঠনিক আলাপ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতে ইসলামীর একজন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য বলেন, ২০১৬ সাল থেকে জামায়াত সমাজকল্যাণ ও সংগঠন গোছানোর কাজ করছে। এ সময়ে কয়েক লাখ কর্মী ও ১০ হাজার রুকন বেড়েছে। আমাদের স্বাভাবিক সাংগঠনিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং থাকবে। এই অবৈধ সকরারের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলত চলছে, চলবে। এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ২০২৩-২০২৫ কার্যকালের জন্য পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। এরই মধ্যে ৮৬ সাংগঠনিক জেলা শাখা ও এর অধীনে থাকা উপজেলা, থানা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ের সব কমিটি গঠন করেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে দলটির প্রকাশ্যে তৎপরতা না দেখা গেলেও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে নীরবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এ বিষয়ে পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জামায়াতের সব কার্যক্রমে আমাদের সর্বোচ্চ নজর রয়েছে। দলটিকে আমরা কোনোক্রমেই মাঠে নামতে দেব না। স্বাধীনতাবিরোধী দলটি রাজপথ অস্থিতিশীল করবে, সে সুযোগও তাদের দেয়া হবে না। তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দমন করা হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়