মাদ্রাসা কর্মচারীর কাণ্ড : জাতীয় পরিচয়পত্র ও এমপিওতে ভিন্ন তারিখ!

আগের সংবাদ

যে কারণে দলে নেই মাহমুদউল্লাহ

পরের সংবাদ

প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

খুলনার টার্মিনাল থেকে ভিড়ের স্টিমারে এক চিলতে জায়গা নিয়ে বসেছিল শাহেদ। শুক্র-শনি দুদিন অফিস ছুটি। তারপর আরো দুদিন ছুটি নিয়েছিল। আজকের দিনটা নাকি ভালোবাসা দিবস। শাহেদ সুযোগ পেলেই অজানা পথে বেরিয়ে পড়ে। কখনো কোনো বন্ধুর বাড়ি, আবার কখনো হোটেলে রাত্রিযাপন করে নিজের ডেরায় ফিরে আসে। এবারের যাত্রা ছিল গন্তব্যহীন। রাতের স্টিমারে ফিরতি পথে ঢাকার সদরঘাট টার্মিনালের টিকেট কাটা হয়েছে।
এখন সকাল। শাহেদের হঠাৎ চোখ পড়ল কয়েক গজ দূরে একটি জটলায়। গাদাগাদি নারী আর শিশুদের ভিড়ের মাঝে কোনো মতে বসে আছে রাফিজা। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!
রাফিজা নামটা একটা ভারী পেন্ডুলামের মতো ধাক্কা দিল শাহেদের ভেতরে। তার বন্ধ সময়ের ঘড়িটাকে চালু করে দিল পেছন দিকে। প্রথম ধাক্কায় শাহেদের মনে হলো- সে দুহাতে ভিড়টাকে ঠেলতে ঠেলতে এক্ষুণি চলে যায় রাফিজার কাছে। তারপর তার দুই কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে চিৎকার করে বলে- এই রাফিজা! তুই কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি, রাফিজা?
কেমন একটা বিরস বদন করে বসে আছে রাফিজা। পরনে আগের মতোই সেলোয়ার-কামিজ। সোজা সিঁথির দুপাশে টান টান করে আঁচড়ানো চুলগুলো পেছনে একটা বড় ক্লিপ দিয়ে আটকানো। এক বছরের ব্যবধানে দেখছে রাফিজাকে। না, এক বছরে রাফিজার কিছুই বদলায়নি। বদলায়নি তার চেহারাও!
রাফিজা গ্রাম থেকে ওঠে আসা মেয়ে। অভাবের তাড়নায় কিংবা কোনো পরিস্থিতির শিকার হয়ে আর দশজন মেয়ে যেমন গ্রাম থেকে এসে গার্মেন্টসে চাকরি করে, রাফিজাও সে রকম। গার্মেন্টসের ছুটি শেষে একদিন বস্তির ডেরায় ফিরছিল সে। ফাঁকা রাস্তায় পেয়ে একদল ছোকরা তার পিছু নিল। তারা নোংরা বাক্যবাণে তাকে জর্জরিত করতে থাকল। রাফিজার কিছুই করার ছিল না। সে নির্বাক দাঁড়িয়ে পড়ল। একটি ছেলে রাফিজার ওড়না ধরে টান দিল। ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দৃশ্যটি শাহেদের নজরে এলো। ছোকরাগুলো শাহেদের উপস্থিতি টের পেয়ে কেটে পড়ল। ভয়ে শাহেদের গা ঘেঁষে রাফিজা মৃদু ভাষায় বলল- আমাকে গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচালেন। এজন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
শাহেদ বলল- কী এখনো এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? বাসায় যাও।
রাফিজা বলল- আমার ভয় করছে। আমাকে আর একটু এগিয়ে দেবেন?
তারপর শাহেদ তাকে বস্তির ডেরা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছিল।
সেই থেকে আস্তে আস্তে রাফিজার সঙ্গে শাহেদের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। কী একটা গভীর মায়া জন্মে যায়। এই মায়াই নাকি ভালোবাসা। সময় পেলেই শাহেদ রাফিজার ডেরায় যায়। ডেরা বলতে পুরু করে বিছানো পুরনো খবরের কাগজের ওপর পুরনো ছেঁড়া শাড়ি পাতা বিছানা। মাথায় দেবার একখানা বালিশ। ছোট্ট একটা নড়বড়ে কেরোসিন কাঠের চৌকির ওপর বাসন-বাটি আর তেল-মসলার মলিন শিশি। একটা দড়িতে ঝোলানো কিছু জামাকাপড়। কিছু বইপত্তর আর মোমবাতি।
রাফিজাও শাহেদের ভাড়া করা একটা চিলেকোঠায় নিয়মিত যাতায়াত করত। চিলেকোঠার অবস্থাও রাফিজার ডেরার চেয়ে খুব ভালো বলা যাবে না। শাহেদের মনে পড়ল, একদিন রাফিজা বলেছিল- এই একটা গল্প বলো না! তখন শাহেদ বলেছিল- গল্প শুনবি? তবে শোন। একটা রাজা ছিল। রাজাটা না বড্ড গরিব!
এইটুকু শোনার পরই রাফিজার সে কী খিলখিল হাসি। হাসি আর থামেই না। হি… হি… রাজাটা বড্ড গরিব।
শাহেদ একটা বেসরকারি অফিসে কম বেতনের চাকরি করে। অনাথ-আশ্রমে মানুষ সে। অনাথ আশ্রম থেকে বেরিয়ে এক শিক্ষকের আশ্রয়ে থেকে পড়াশোনা শেষ করে নিজের জন্য একটা দ্বিতল বাড়ির চিলেকোঠা ভাড়া নেয়। সেখানেই সে একা একা নীরব যুদ্ধ চালাচ্ছিল।
শাহেদ বলত- জানিস রাফিজা, আমার মনে হয় আমাকে বোধহয় আমার বাবা বা কেউই রাখতে চায়নি। কিংবা হয়তো কেবল পরস্পরের শরীর উপভোগের লোভে একটি পুরুষ আর একজন স্ত্রীলোকের মিলন ঘটিয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে যে আমি কোনো দুর্ঘটনায় মৃত দম্পতির ফেলে যাওয়া অনাথ সন্তান অথবা কোনো ধর্ষিতার শরীরে তৈরি হওয়া ঘৃণার ফসল। জানি না।
রাফিজা বলেছিল- এই চুপ করো! অমন করে কথা বোলো না।
শাহেদ দেখেছিল, রাফিজার চোখ দুটো তেল ভরা পিদিমের মতো জলে টলমল করছে।

২.
মামা-মামির অত্যাচারে, মাধ্যমিক পাস করা পিতৃ-মাতৃহীন রাফিজা একদিন গ্রাম থেকে চাঁদপুরের লঞ্চ টার্মিনালে এসে ভোরের লঞ্চে ঢাকায় এসেছিল। লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছে একবার ভাবনায় এসেছিল, অজানা-অচেনা ভদ্রলোকের সোমত্ত মেয়ের কোথায় জায়গা হবে! তাহলে আবার মাথা নিচু করে ওই মামার বাড়ি ফিরবে? মামা-মামি বাড়িতে ঢুকতেই দেবে না হয়তো। ভয়ে রাফিজার বুক ধুক্ ধুক্ করছিল। তারপর গায়ের বান্ধবী আন্নার ডেরায় উঠেছিল। আন্নাই তাকে গার্মেন্টসে চাকরি পাইয়ে দেয়। বস্তিতে তারই পাশে একটি ঘরও ভাড়া করে দেয়।
সেই রাফিজাই এক বছর আগে হারিয়ে যায়। কোনো কওয়া নেই, বলা নেই- হঠাৎ রাফিজা নিরুদ্দেশ। কত রোমহর্ষক পরিণতির কল্পনা করেছে শাহেদ। কেউ তুলে নিয়ে গেল না তো রাফিজাকে! কোনো অস্বাভাবিক কামাবেগের শিকার হলো না তো? কোনো ধর্ষণ? তারপর থেকে বহুদিন শাহেদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকার পাতায় খবর পড়ত। ‘ধানক্ষেতে ধর্ষিতা নারীর মৃতদেহ’। ‘লঞ্চের কেবিনে নারীর লাশ’। ‘হোটেলের কামরায় খুন হওয়া মহিলার গলিত শব’। শাহেদের পাগল পাগল লাগত। অথচ এখন দেখছে রাফিজা ঠিকঠাকই আছে। একেবারে আস্ত। এই এক বছরে তার বয়সটাও তেমন খোয়া যায়নি। গায়ে আঁচড়টুকু পর্যন্ত লাগেনি। ওই তো বিরস বদনে একটা ব্যাগ নিয়ে বসে আছে। বিরস বদন! কারণ বিরূপ হাওয়া। ভিড়! মাছি, মানুষের দেহের চাপ।
যাক্গে। শাহেদের কী? তাছাড়া আর অতীতের কথা ভেবে কী লাভ! যত্তসব! কিন্তু হঠাৎ স্টিমারটা একটা ঝাঁকুনি দিল। থেমেও গেল। সেই ফাঁকে চমকে উঠল রাফিজা। তার ভাবনার গুটি কেটে বেরিয়ে প্রজাপতির পাখনার মতো চোখের পল্লব দুটি কাঁপিয়ে চারদিকে চেয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ সরিয়ে নেবার চেষ্টা করার আগেই শাহেদকে দেখে ফেলল। রাফিজার সঙ্গে চোখ মিলতেই সব ভুলে সরে পড়ার ধান্দা লোপাট হয়ে গেল শাহেদের। গড়বড় হয়ে গেল সব। ভেবেছিল কে রাফিজা? কোন রাফিজা? আমি কাউকে চিনি না। এক বছর আগেও যেমন কোনো রাফিজা ছিল না আমার জীবনে। এক বছর বাদেও নেই। রাফিজা নামের কেউ হাওয়ায় মিলে গেছে। কিন্তু আবার কেন জানি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সব ওলটপালট হয়ে গেল? রাফিজার ঠোঁট দুটো একটু স্ফুট হয়ে উঠেছে কিছু বলার জন্য। উঠে দাঁড়াল সে। এগিয়ে আসছে রাফিজা, অজান্তেই ইশারা করল শাহেদ।
শাহেদ বলল- কেমন আছিস?
রাফিজা ঘাড় নাড়ল। অর্থাৎ ভালো।
সদরঘাট টার্মিনালে টুক করে নেমে পড়ল দুজনে। তারপর নিরিবিলি জায়গায় একটি বেঞ্চি খালি পেয়ে দুজন পাশাপাশি বসে পড়ল।
শাহেদের দিক থেকে কোনো কৈফিয়ত আসার আগেই রাফিজা অকপটে বলে চলল- খবর এলো মামা মৃত্যু পথযাত্রী। ভেবেছিলাম মামাকে একনজর দেখেই চলে আসব। আমি পৌঁছানোর আগেই মামা দেহত্যাগ করেন। মামি একা হয়ে যাওয়ায় আমাকে আর ছাড়লেন না। এবার বরং ভীষণ আদর করা শুরু করলেন। মামি তার এক বোনপোর সঙ্গে আমার বিয়ে দেয়ার জন্য কথা পাকা করে রাখলেন। ওদিকে মামার বাড়ি যাওয়ার পথেই মোবাইল সেটটা ছিনতাই হয়ে যায়। তোমার নম্বরটা মুখস্থ ছিল না। তাই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না।
এবার রাফিজার প্রশ্ন- তা শিক্ষকের মেয়েকে বিয়ে করছ কবে?
– তুই তোর মামির বোনপোকে বিয়ে করছিস যেদিন, সেদিন।
হো… হো… করে হেসে উঠল দুজনে। আরো কাছে এসে শাহেদের হাত দুটি শক্ত করে ধরে রাফিজা বলে, আমি ভুলিনি গো তোমায়। তাইতো একেবারে চলে এসেছি।
শাহেদ বলল, একেবারে!
সুরুয খান : বাজার মসজিদ সড়ক, মানিকগঞ্জ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়