মাদ্রাসা কর্মচারীর কাণ্ড : জাতীয় পরিচয়পত্র ও এমপিওতে ভিন্ন তারিখ!

আগের সংবাদ

যে কারণে দলে নেই মাহমুদউল্লাহ

পরের সংবাদ

এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে দেশ : সামনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের শক্তি কিছুটা দুর্বল করেছে। তারপরও বাংলাদেশের ‘তারকা’ অবস্থান অব্যাহত আছে। বর্তমানে ১৬টি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ে, আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে উত্তরণ পর্যায়ে আছে বাংলাদেশসহ আটটি দেশ। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) ওই আট দেশের পরিস্থিতি নতুন করে মূল্যায়ন করেছে। সেখানে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থানের চিত্র উঠে এসেছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের বেশি আছে। বাংলাদেশ এখনো উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তার ওপর উচ্চমাত্রায় নির্ভরশীল। কোভিডের কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ২০২০ ও ২০২১ সালে যথাক্রমে ২ ও ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এলডিসি থেকে উত্তরণে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এ তিন সূচকে নির্ধারিত মানদণ্ডের অনেক ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ। আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো ‘সবুজ’ অবস্থানে থাকলেও চারটি দেশ হলুদ অবস্থানে চলে গেছে। ইতোমধ্যে অ্যাঙ্গোলা তাদের উত্তরণ প্রক্রিয়া নিজেরা আবেদন করে স্থগিত করেছে। কোভিডের প্রভাবে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। তাদের মাথাপিছু আয় ক্রমে কমছে। নির্ধারিত মাত্রার মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করে অ্যাঙ্গোলা এলডিসি থেকে বের হতে চেয়েছিল। মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে পারলে অন্য দুটি সূচকে কম নম্বর থাকলেও এলডিসি উত্তরণ হওয়া যায়। কিন্তু সেই মাথাপিছু আয়ে টান পড়ায় অ্যাঙ্গোলা পিছিয়ে গেল। অন্যদিকে সোলোমন আইল্যান্ডের ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের কথা থাকলেও এখন তারা নিজেরাই অনুরোধ করেছে, এ উত্তরণের সময় আরো তিন বছর যেন পিছিয়ে দেয়া হয়। নেপাল ও ভুটানের অবস্থাও আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। ঋণ নিয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে লাওস।
কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পাঁচ দিনব্যাপী জাতিসংঘের এলডিসি-৫ সম্মেলন। এবারের সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর নানামুখী চ্যালেঞ্জে পড়বে বাংলাদেশ। বড় চ্যালেঞ্জ হবে রপ্তানি আয় কমে যাওয়া। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি আয় কমবে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ শুল্কে রপ্তানি করতে হবে বলে আয় কমতে পারে কমপক্ষে ৫১ হাজার কোটি টাকা। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও খুলতে পারে। যেমন, এলডিসি থেকে উত্তরণ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন বার্তা দেবে। এতে বাংলাদেশের নতুন ভাবমূর্তি ও ব্র্যান্ডিং বাড়বে, যা বৈশ্বিক নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের কাছে বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি, পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও তদারক বিষয়ে ২০২১ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতেই উঠে এসেছে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সম্ভাবনার দুয়ার খোলার কথা। সময় এসেছে বাজার সুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে বেরিয়ে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতাভিত্তিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিকে যাওয়ার। আর অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এত দিন বহির্বিশ্ব থেকে যেসব শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছিল, ২০২৬ সালের পর সেগুলো অন্য সব এলডিসিভুক্ত দেশ বাংলাদেশের কাছে দাবি করবে। আবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে গেলে ডব্লিউটিওর বিধিবিধান মানতে হয়। উন্নয়নশীল দেশ হয়ে যাওয়ামাত্রই বিধিবিধানগুলো পরিপূর্ণভাবে মানতে হবে। এসব নিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ওষুধশিল্প। চ্যালেঞ্জের মধ্যে আরো রয়েছে- পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেয়া যাবে না। শুল্ক হারও যৌক্তিক করতে হবে। বিশ্ব কাস্টমস সংস্থা (ডব্লিওসিও) ও ডব্লিউটিওর বিধিবিধান মেনে বাংলাদেশকে সব ধরনের শুল্কহার নামিয়ে আনতে হবে যৌক্তিক পর্যায়ে। কাজটি এমনভাবে করতে হবে, যাতে দেশীয় শিল্পের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয়। এ জন্য রাজস্ব আয় অনেক কমবে। নগদ সহায়তা দেয়ার সঙ্গে ডব্লিউটিওর তিনটি চুক্তি জড়িত। এগুলো হচ্ছে- ভর্তুকি ও পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থার ওপর চুক্তি, কৃষি ভর্তুকি এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থার ওপর চুক্তি। রপ্তানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৪৩টি পণ্যে রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এএসসিএম চুক্তিতে বলা হয়েছে, এলডিসিভুক্ত দেশ নগদ সহায়তা দিতে পারবে। আর পণ্য উৎপাদনে আমদানি করা পণ্যের বিপরীতে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের শর্ত আরোপ করে কোনো ভর্তুকি দেয়া যাবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলেই বাংলাদেশ রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা হারাবে এবং নগদ সহায়তা আর দিতে পারবে না।
বাংলাদেশসহ ১২টি দেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে। এ উত্তরণের ফলে এসব দেশ শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা হারাবে। এতে দেশগুলো রপ্তানিতে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়বে, তার ৯০ শতাংশই হবে বাংলাদেশের। মূলত এলডিসি থেকে বের হলে প্রচলিত শুল্ক-কর দিয়েই ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। তাতে রপ্তানি কমতে পারে। বাংলাদেশসহ এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো নেপাল, ভুটান, অ্যাঙ্গোলা, লাওস, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সাও তামে অ্যান্ড প্রিন্সেপে। এসব দেশ মোট যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে, তার ৫৩ শতাংশই বাংলাদেশের। সেবা রপ্তানির ক্ষেত্রে এ হার ৭১ শতাংশ। বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তাই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ, তা ধরেই সব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হবে। পশ্চাৎপদ চিন্তা বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎমুখী চিন্তা করতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশ গভীর সংকটে পড়বে বলা হলেও তা মনে করি না আমরা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কোটামুক্ত শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা উঠে যাওয়ার সময়েও একই কথা বলা হয়েছিল। উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশের যে আত্মশ্লাঘা আছে, তা বাড়তি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত করতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় থাকা অন্য কোনো দেশের এমন সাফল্য নেই। এলডিসি থেকে উত্তরণে মাথাপিছু আয় সূচকে একটি দেশের নির্ধারিত মানদণ্ড হলো ১ হাজার ২৪২ মার্কিন ডলার। সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৯৩ ডলার। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্টের ওপরে থাকতে হয়। এ সূচকে বাংলাদেশ পেয়েছে ৭৭ দশমিক ৩ পয়েন্ট। এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে ‘স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি’ বলা যায়। আর জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ পয়েন্টের নিচে থাকতে হয়। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৬ দশমিক ৬ পয়েন্ট। এই সূচকে কিছুটা অগ্রগতি আছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। যদি কোনো নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাহলে যেখানে আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়ার সুযোগ আছে, তা যেন দ্রুত চাওয়া হয়।

রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়