পার্বত্য শান্তি চুক্তি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার

আগের সংবাদ

‘বাংলাদেশ বিজনেস সামিট’ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী : সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে বিদেশিদের বিনিয়োগের আহ্বান

পরের সংবাদ

শাল্লায় হাওড়ে জমি নেই তবু পিআইসি সদস্য অকৃষকরা

প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জয়ন্ত সেন, শাল্লা (সুনামগঞ্জ) থেকে : সুনামগঞ্জের শাল্লায় নীতিমালার তোয়াক্কা না করে হাওড়ে জমি নেই এমন তিন অকৃষককে প্রায় ২৫ লাখ টাকার প্রকল্প দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যা উপজেলায় রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। কৃষকের অধিকার কেড়ে নিয়ে অকৃষকদের পিআইসি দিলো- এমনই অভিযোগ হবিবপুর ইউপির মৌরাপুর গ্রামের কৃষকদের। প্রতি বছরই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রকাশের হুমকি-ধামকি দিয়ে প্রকল্প নেয় এই চক্রটি। অল্প ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে প্রতি বছর নীতিমালা লঙ্ঘন করে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে এই মহলটি। তাদের নামে বেনামে রয়েছে একাধিক পিআইসি। বাঁধে বাঁধে গিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগও পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে উপজেলাজুড়ে চলছে সমালোচনার ঝড়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় বকুল আহমেদের বাড়ি শাল্লা ইউপির দামপুর গ্রামে। বাঁধ থেকে তার গ্রামের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৩০কি.মি.। বাঁধটি পড়েছে হবিবপুর ইউপির মৌরাপুর গ্রামসংলগ্ন ভান্ডাবিল হাওড়ে। বকুল আহমেদ ২৭নং পিআইসির সদস্য সচিব। শান্ত কুমার দাসের বাড়ি নারকিলা গ্রামে। তিনি ওই প্রকল্পের সভাপতি। বাঁধ থেকে তার গ্রামের বাড়ি ২০কিমি দূরে। বিপ্লব রায়ের বাড়ি উপজেলার আনন্দপুর গ্রামে। বাঁধ থেকে তার গ্রামের বাড়ি ১৫ কিমি দূরে। তিনি ওই প্রকল্পের সদস্য। আবার ওই তিনজনই অবস্থান করেন শাল্লা সদরে। পেশায় শান্ত কুমার দাস দলিল লেখক, বকুল আহমেদের রয়েছে চা-পান ও সিগারেটের দোকান আর বিপ্লব রায়ের রয়েছে ফার্মেসির ব্যবসা।
কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, কৃষকের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে যারা তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন তদন্তপূর্বক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক এ দাবি হাওড় বাঁচাও আন্দোলন উপজেলা কমিটির।
উপজেলার ভান্ডাবিল হাওড় উপপ্রকল্পের আওতায় ২৭নং পিআইসির বাঁধে কোনো সাইনবোর্ড পাওয়া যায়নি। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ভান্ডাবিল হাওরের নতুন বৈশাখালি ভাঙা থেকে ১৪৬ মিটার অক্ষত বাঁধে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৪ লাখ ৯৭ হাজার ৮৩২ টাকা ৫৫ পয়সা।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, এইসব সাংবাদিকের ভান্ডাবিল হাওড়ে কোনো জমিই নেই। অথচ প্রকৃত সুবিধাভোগী কৃষকদের বাদ দিয়ে দুর্নীতিকে আড়াল করতে সাংবাদিকদের ওই পিআইসি দেয়া হয়েছে বলে জানান হবিবপুর ইউপির বাঁধসংলগ্ন গ্রাম মৌরাপুর গ্রামের কৃষকরা।
মৌরাপুর গ্রামের সঞ্জয় চন্দ্র দাস বলেন, শান্ত দাসের বাড়ি নারকিলা, বকুল আহমেদের বাড়ি শাল্লা ইউপির দামপুর, বিপ্লব রায়ের বাড়ি আনন্দপুর গ্রামে। এই হাওড়ে এদের কোনো জমি নাই। একেক জনের বাড়ি বাঁধ থাইক্কা ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। এরা সবাই থাকে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও বাজারে। ‘শুনছি হেরা নাকি সাংবাদিক। এদের বাঁধও টেকসই হয় নাই, কাজও বাকি রইছে। বানডা এখনই ডেইল্লা পইরা গেছে গা। এখন বৃষ্টি হইলেই বানডা ভাইঙা যাইব গা। এরার যেখানে জমিন নাই, এরাতো নিজের মতো কইরা বানডা ভালা করত না। এরা পিআাইসি পায় কিভাবে এমন প্রশ্ন করেন ওই কৃষক’। ভান্ডাবিল হাওড়ের ২৬নং পিআইসির সদস্য রবীন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, তারা যে পিআাইসি আনছে তাদের তো একগুটা জমি নাই এই হাওরে। আমাদের ২৬নং পিআইসির মধ্যে একটু অংশে তাদের ঢুকাই দিছে। আমাদের ২৬নং পিআইসির ৭২৮ মিটার বাঁধে বরাদ্দ দিছে মাত্র ২০লাখ ৫৪ হাজার টাকা আর তাদের মাত্র ১৪৬ মিটারে বরাদ্দ দিছে ২৫ লাখ টাকা। আমরা গরিব মানুষ কিছু মাছ টাস মাইরা খাই। এরার বিরুদ্ধে কিছু কইতে গেলেই পুলিশ পাঠাইয়া আমাদের হয়রানি করে। আমাদের অনেক ক্ষতি করছে এরা। মানুষ অখন ডরাইয়া এরার বিরুদ্ধে কিছু কইত চায় না। এরার বাঁধে মাত্র ৪ লাখ টাকার মাটি কাটছে বলে জানান তিনি।
একই গ্রামের অশুক চন্দ্র দাস বলেন, প্রতিবাদ করতে গিয়া চড় খাইতাম নি। এখন যদি পাইন্যে ঢেক্কা দেয় পইলা আমার ক্ষেত তলে যাইব। কইবার যায়গা নাই। কানবার জায়গা নাই আমরার। শান্ত দাসের বাঁধে ২৫ লাখ টাকা পাইছে। এরার ২/৪ লাখ টাকা খরচ অইব। সব লুটপাট চলছে বলে জানান তিনি। মৌরাপুর গ্রামের খোদ্ ২৭নং পিআইসির সদস্য সুজিত কুমার দাস বলেন তাদের জমি নেই হাওড়ে। আমি আবেদনই করিনি। তারপরও তারা আমারে সদস্য রাখছে। তারা তো প্রতি বছরই পিআইসি নেয়। সদস্য সুজিত কুমার দাস আরো বলেন, ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান ২৭নং পিআইসির ওই সদস্য।
অন্যদিকে (৮, ৯ ও ১০ মার্চ) ৩দিনব্যাপী হাওড়ের বিভিন্ন বাঁধে সরজমিন গিয়ে দেখা যায় বরাম হাওড় উপপ্রকল্পের আওতায় ৫০, ৫১, ৫৬ ও ৫৭নং পিআইসির মাটির কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। এলাকার কৃষকরা বলছেন, এই কাজ সম্পন্ন হতে সময় লাগবে আরো ১৫দিন। বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) শাল্লা সদরসংলগ্ন ছায়ার হাওড় উপপ্রকল্পের ১২৪নং পিআইসির বাঁধেও মাটি ফেলতে দেখা গেছে। এমন আরো বেশকিছু বাঁধে মাটির কাজই এখনো বাকি থাকতে দেখা গেছে। কোথাও বাঁধে মাটি ভরাটের কাজ, কোথাও ড্রেসিং, কোথাও ঘাস, অনেক বাঁধে করা হয়নি কমপেকশনও। এমনকি অনেক বাঁধে বরাদ্দ গোপন করতে সাঁটানো হয়নি সাইনবোর্ডও।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা কর্মকর্তা (এসও) আব্দুল কাইয়ুমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি তিনি। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তালেব বলেন, ৫১ ও ৫৭ পিআইসির উপর দিয়ে অন্য পিআইসির গাড়ি চলার কারণে তারা কাজ শুরু করতে পারেনি। আমাদের ২টা পিআইসির মাটির কাজ বাকি আছে। অনান্য পিআইসির ড্রেসিংয়ের কাজ বাকি আছে। কত পার্সেন্ট কাজ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমি বলতে পারব না। তবে আজকে সন্ধ্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে দিবেন বলে জানান তিনি। ২৭নং পিআইসির বিষয়ে জানতে চাইলে তিন বলেন ওরা তো কম্পিউটারে কাজ করার সময় আমার সামনে কাগজপত্র দিছে। তারা তো গত বছরও কাজ করেছে। কাগজপত্র জমা দেয়ার প্রেক্ষিতেই তাদের পিআাইসি দেয়া হয়েছে। মৌরাপুর গ্রাম থেকে তাদের জমি নেই হাওড়ে এমন অভিযোগ তার কাছে পৌঁছেনি বলে জানান উপজেলা কাবিটা স্কিম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জ জেলারসহ অন্যান্য জেলার একমাত্র বোরো ফসল আগাম বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার পর, ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে সরকার। প্রণীত হয় সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা ২০১৭। সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা ২০১৭-এ স্কিম বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও সময়সূচির (ক) ও (খ) -এ স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে স্থানীয় দরিদ্র্য জনগণকে স্কিন বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত করার লক্ষ্যে (ইমপ্লিমেন্টেশন প্রজেক্ট) পিআইসির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হইবে। হাওড় এলাকায় বাঁধের নিকটবর্তী (যথাসম্ভব) জমির মালিক ও উপকারভোগীদের সম্পৃক্ত করিয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি পিআইসির মাধ্যমে কাজ বাস্তবায়ন করিতে হইবে। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু করিয়া আবশ্যিকভাবে ২৮ ফেব্রয়ারির মধ্যে কাজ সমাপ্ত করিবে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে ৯ মার্চের মধ্যেও কাজ শেষ হয়নি। বরং কোনো কোনো প্রকল্পের কাজ মাত্র শুরু হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়