কাতার নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : প্রবাসে অপরাধে জড়ালে দায় নেবে না সরকার, দালালের মাধ্যমে কেউ বিদেশমুখী হবেন না

আগের সংবাদ

বিপর্যয় সামালের সক্ষমতা কম : ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারামেডিকেল টিম নেই, প্রয়োজন উন্নত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম

পরের সংবাদ

সিরিজ বিস্ফোরণ : সব দোষ গ্যাসের?

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঢাকার সিদ্দিক বাজার, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড বা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রতিক বিস্ফোরণগুলো ‘নাশকতা’ নয় ‘দুর্ঘটনা’-তা অন্তত মন্দের ভালো। নাশকতা থেকে তো রক্ষা। সেই বিবেচনায় কিছুটা স্বস্তি বোধ করাই যায়। নাশকতা হয়ে থাকলে শঙ্কার অন্ত থাকত না। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে কিছুদিন ধরে একের পর এক এ ধরনের ‘দুর্ঘটনা’ ঘটে চলছে কেন? দুর্ঘটনার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই বলে একটির পর আরেকটি চলতেই থাকবে?
চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীমা অক্সিজেন কারখানায় গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনাটি এত ভয়ংকর যে আধা কিলোমিটার দূরে উৎক্ষিপ্ত লোহার পাতের আঘাতে মানুষ মারা গেছে। এ ঘটনায় ৬-৭ জন নিহতের আগে গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের কেশবপুরে বিএম ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন ৫০ জন। এই কারখানা থেকে সীমা অক্সিজেন কারখানার দূরত্ব পৌনে এক কিলোমিটার। বিস্ফোরণে কারখানা ভবনের ছাউনি উড়ে গেছে। টিন আর লোহার পাতের টুকরা ছড়িয়ে আছে আশপাশে। ভবনের লোহার খুঁটিগুলোও হেলে পড়েছে। সিলিন্ডারবাহী দুটি ট্রাকের একটির সামনের অংশ পুড়ে যায়। অন্যটির দরজা-জানালার কাচ উড়ে গেছে। কারখানা এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। ধসে পড়েছে কারখানার দেয়াল।
সীতাকুণ্ডের ঘটনার ঘায়ের মাঝেই রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজার এলাকায় সাত তলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে জনাবিশেকের মৃত্যুর খবর। বিস্ফোরিত ভবনের বেজমেন্টের অবস্থার খবর জানার বাইরে। সিদ্দিক বাজারে সাত তলা যে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার তিন তলা পর্যন্ত পুরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেজমেন্ট। ফায়ার সার্ভিসের আশঙ্কা, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, বিস্ফোরণে এমনভাবে ভবনটি ধসে পড়েছে যে ভেতরের বেজমেন্ট ও নিচ তলায় ঢোকার কোনো অবস্থা নেই। জায়গায় জায়গায় ইট ঝুলে আছে। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভেতরে গেছেন তারা। সিদ্দিক বাজারের আগে একই কাণ্ড ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটি তিন তলা বাণিজ্যিক ভবনে। একের পর এক নন স্টপে বিস্ফোরণ ঘটেই চলছে, থামানোর কি উপায় নেই? নাশকতা নয় বলে কেউ দায়ী নন?
বিগত কয়েক বছরে এ ধরনের ছোট-বড় বিস্ফোরণের খবর গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। প্রায় সব বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়েছে ‘গ্যাস লিকেজ’ বা ‘জমে থাকা গ্যাস’কে। কোনো ঘটনাই তদন্তের বাইরে থাকছে না। কয়েকটির দুর্ঘটনার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। যে ক’টির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে সেখানে বিস্ফোরণের জন্য প্রধানত দায়ী করা হয়েছে ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে। আর কারো দায় বা দায়িত্ব থাকতে নেই? কর্তৃপক্ষ বা তদন্তের মালিক-মোক্তারদের মতিগতি বলছে, আর কারো যেন দায়বদ্ধতা নেই। এর আগে, ২০২১ সালের জুনে রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণের জন্যও দায়ী করা হয়েছিল তিন তলা ভবনের নিচ তলায় জমে থাকা গ্যাসকে। অথচ ওই ঘটনায় ভবনের নিচ তলায় কোনো গ্যাস সংযোগ পাওয়া যায়নি, গ্যাস সিলিন্ডারও অক্ষত ছিল। সে সময় বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, তারা সেখানে মিথেন গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন যা পয়ঃনিষ্কাশন লাইন থেকে লিক হতে পারে। এর আগের বছর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণ ৩৪ জনের মৃত্যুর ঘটনার পোস্টমর্টেমও ছিল এমনই। তদন্ত সংস্থা সিআইডি বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটন করে জানিয়েছিল, মসজিদের ভেতরে গ্যাস লাইনের লিকেজ দিয়ে বের হয়ে আসা গ্যাসের ওপর বিদ্যুতের স্পার্ক পড়তেই বিস্ফোরণ ঘটেছে।
প্রতিটি দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন এক ধরনের রুটিন ওয়ার্ক। এ কমিটিকে রিপোর্ট দিতে সময় বেঁধে দেয়া হয়। অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদন দিতে দীর্ঘ সময় চলে যায়। নানা ঘটনার তোড়ে মানুষও ঘটনা ভুলে যায়। এর মাঝে প্রতিবেদনে তদন্তের ফলাফল সামনে এলেও দুর্ঘটনার সব দায় বর্তায় কোনো ব্যক্তি, ভবন মালিক, কারখানা মালিকের ওপর। তার মানে গ্যাসের লিকেজের জন্য এরাই দায়ী। ভবন করতে যে ফায়ার সার্ভিস, সিটি বা পৌর কর্তৃপক্ষের নকশা পাস করানো হয় তা আলোচনার বাইরেই থেকে যায়। কোনো ভবনের নকশা অগ্নিনিরাপত্তা মেনে করা হয়েছে কিনা, আগুন নেভানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে কিনা, সেইসঙ্গে কেমিক্যাল মজুত বা কারখানার লাইসেন্স দেয়ার সময় পর্যাপ্ত নজরদারি ছিল কি না, তাও উহ্য থেকে যায়।
কোনো ভবনে অবৈধ বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংযোগ কীভাবে এলো, এই অক্সিজেন কারখানা নিয়ম মেনে পরিচালিত হচ্ছিল কিনা, কন্টেইনার ডিপোতে কীভাবে এত কেমিক্যালের মজুত হলো এসব প্রশ্নও সামনে আসে না। এসব বিষয় তদারকির কি কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ নেই? কর্তৃপক্ষের তো অভাব নেই। নইলে ভবন বা কারখানা করতে গেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরণ পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদফতরসহ নানা জায়গায় ধরনা দিতে হয় কেন? কোনো কোনোটিতে ব্যাংক এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানিও দায়বদ্ধ থাকছে। কিন্তু অঘটন ঘটলে ভবন বা প্রকল্পের মালিক ছাড়া আর কারো নাম আসে না। যাদের গাফেলতি থাকতে পারে তাদেরই তদন্ত কমিটিতে রাখা আরেক পরিহাস। আবার গাফেলতির অভিযোগে যে কোনো মালিককে গুরুতর শাস্তির আওতায় আনার নজিরও কম।
এ ধরনের সব অঘটনের খবর গণমাধ্যমে আসে না। আলোচিত ও বড় ঘটনা ছাড়াও প্রতিনিয়ত ছোটখাটো অসংখ্য বিস্ফোরণ ঘটছে। হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভুক্তভোগীরা। বিস্ফোরক আইন ও নীতিমালার তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন দাহ্যপদার্থ রাখা ছাড়াও এসব দুর্ঘটনার বড় একটি অংশ পুরাতন গ্যাসলাইন লিকেজ ও এসি থেকে হচ্ছে। মেকানিকদের অদক্ষতায় অনেক সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা বলছেন, গ্যাসের লিকেজ ও এসি-ফ্রিজের ছোটখাটো ত্রæটি সারাতে অনেকেই মেকানিক ডেকে আনেন। মেকানিকদের সঠিক কারগরি জ্ঞান না থাকার কারণে বেশির ভাগ সময়ই মেরামতের পরও ত্রæটি থেকে যায়, যে কারণে এসব জায়গায় বারবার বিস্ফোরণ ঘটে। তাছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন নিয়মিত পরীক্ষা না করার করাণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিল্ডিং কোডে এ সম্পর্কে গাইডলাইন দেয়া আছে। চাইলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরও গাইডলাইন দিতে পারে। তাই বারবার অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণের মতো ঘটনাগুলোকে শুধুই দুর্ঘটনা বলা যায় না। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, ঢাকার সায়েন্স ল্যাব, সিদ্দিক বাজারসহ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো কোনো কিছুর ইঙ্গিত কি না, অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
পরিচালনার দায়িত্বরতদের কাছে সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। একদিকে মনিটরিংয়ের জায়গায় বড় ঘাটতি, আরেক দিকে এত সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও ব্যাপক। মনে পড়ে, সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর পর বিদেশি বায়াররা শর্ত জুড়ে দিয়েছিল গার্মেন্টসের ফায়ার সেফটি না থাকলে তারা পোশাক কিনবে না। তখন রাতারাতি এসব প্রতিষ্ঠানের চেহারা বদলে গেছে। তা সম্ভব হলো কীভাবে?- এ প্রশ্নের জবাব খুঁজলে অনেক ব্যবস্থা বেরিয়ে আসবে। নইলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা বিস্ফোরণোন্মুখ হতেই থাকবে। পুরান ঢাকার অবস্থা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে পুরনো ইউটিলিটি সার্ভিস, তার সঙ্গে মিশ্র ধরনের এমন সব পণ্যের গুদাম আছে। দাহ্য, বিপজ্জনক পদার্থ সেখানে গুদামজাত করা হয়। রাস্তাঘাটও সরু। ঢাকা শহর গড়ে তোলাই হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এখানে ভূগর্ভস্থ পয়োবর্জ্য লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, গ্যাসের লাইন-কোনটা কোনদিক দিয়ে গেছে তা অনেকের জানা নেই। যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় দুর্ঘটনার ব্যবস্থা হয়েই আছে। এ মুহূর্তে বড় ভূমিকম্প হলে তা মালুম করা যাবে। রাজধানীতে নির্মিত ভবনগুলোর অবস্থা জানার ‘ম্যাপিং’ নেই। ম্যাপিং থাকলে বোঝা যেত, মাটির নিচে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, স্যুয়ারেজ লাইন কীভাবে আছে, কতটুকু ঝুঁকিতে আছে?

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়