কাতার নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : প্রবাসে অপরাধে জড়ালে দায় নেবে না সরকার, দালালের মাধ্যমে কেউ বিদেশমুখী হবেন না

আগের সংবাদ

বিপর্যয় সামালের সক্ষমতা কম : ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারামেডিকেল টিম নেই, প্রয়োজন উন্নত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম

পরের সংবাদ

বিয়ে, সমাজ, শ্রেণির কাঠামো ও নারী দিবসের ভাবনা

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘বিয়ে ব্যক্তিগত বিষয়’- কথাটি সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত ফলাও করে প্রচার করা সম্ভব- বাস্তবে তা নয়। বিয়ে সম্পূর্ণ সামাজিক বিষয়- নারী-পুরুষের মিলনের জন্য বিয়ে দরকার হতো না- যদি তা সামাজিক ও আইনত বাধ্যবাধকতা না থাকত। পাত্র-পাত্রীর পছন্দ নিজস্ব হলেও বিয়ে সামাজিক। যুগে যুগে পছন্দের ধরন পাল্টালেও বিয়ের সামাজিক ক্ষমতা সামান্য খর্ব হয়নি। এ পদ্ধতি ভালো না মন্দ- সেটি এখানে আলোচ্য নয়- বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়েও কথা নেই- কথা সামাজিকতা নিয়ে, অন্যের কথা বলা না-বলা নিয়ে।
আগে পরিবারের পছন্দের ওপর ছেলে-মেয়ে উভয়কে নির্ভর করতে হতো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর-কনের জন্য পাত্র দেখার সুযোগ ছিল না। পুরুষরা মাঠের কাজে বাইরে গেলে নারীরা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকত; পর নারী-পুরুষের দেখা হতো কদাচিৎ পছন্দের প্রশ্ন ছিল গৌণ। কিন্তু বর্তমান ধারার স্কুল-কলেজ চালু হওয়ার পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ের সহশিক্ষার ফলে, কর্মস্থলে নারী-পুরুষ সহকর্মী হিসেবে পাশাপাশি থাকাতে তারা নিজেরা নিজেদের জীবনসঙ্গী পছন্দ করতে পারছে পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতে; পরিবারের কাছে পছন্দের সুযোগ কম। পরিবারের পছন্দের চেয়ে ছেলে-মেয়ের পছন্দ গুণগতভাবে তেমন আলাদা নয়, উভয় ক্ষেত্রে স্বধর্ম, স্বগোত্র এবং সম-অর্থনৈতিক শ্রেণির মধ্যে সংঘটিত হয়, কদাচিৎ শ্রেণি-বর্ণের বাইরে গেলেও মূল্যগত কিছু বোঝাপড়া সমানুপাতিক ভূমিকা রাখে। শিক্ষিত অশিক্ষিতকে, ধনি গরিবকে, চাকরিজীবী মহিলা বেকার যুবককে, হিন্দু মুসলমানকে, ব্রাহ্মণ শূদ্রকে স্বভাবত বিয়ে করে না, বা করতে পারে না। এমনকি বিয়ে সংক্রান্ত কথাবার্তাও সমশ্রেণির মধ্যে হয়ে থাকে। শ্রেণির বাইরে কথাবার্তা হলে বুঝতে হবে সেখানেও কিছু সম্পর্কের সূত্র আছে- যেমন রাজার বিয়েতে প্রজার আনন্দ। নায়ক-নায়িকার বিয়েতে ভক্ত-শ্রেণি আহ্লাদিত হয়। রাজার মতো নায়ক-নায়িকার প্রতি যেহেতু তাদের কিছু হক আছে, সেহেতু তাদের কথা বলারও অধিকার আছে। এই কথা বিরূপ বা অনুরূপ হোক, তাতে রাজা-রানি কিংবা নায়ক-নায়িকার প্রত্যক্ষ লাভ বৈ ক্ষতি নেই। কারণ কাজটি করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তারা নিজেরাই যথেষ্ট- এখানে নারী বা পুরুষ বলে আলাদা কোনো লিঙ্গ নেই, তারা ক্ষমতা কাঠামোর অংশ। ক্ষমতা নিজেই পুরুষবাচক, সুতরাং তারা নারী বলে যারা ভ্রান্তি-বিলাসে সুখ পেয়ে থাকেন, তারা মরীচিকার জগতে বাস করেন।
গরিবদের জন্য সমাজ নামক ভূদেববাবুরা এতই শক্তিশালী সে ব্রাহ্মণ হোক বা মৌলবী সাহেব হোক, চাইলেই শূদ্রানিকে কিংবা শাস্ত্রে থাকা সত্ত্বেও কুলীন বালিকাকে বিয়ে করতে পারছে না; পাশাপাশি মৌলবী সাহেব প্রতিদিন চারটি বিয়ের ফতোয়া দিলেও একটির বেশি বিয়ে করে ঘরে আনতে পারছে না। আইন এবং সমাজ তার পক্ষে যাচ্ছে না, এমনকি পেশা হারানোর ভয় থাকছে। কোনো মৌলবী সাহেব পছন্দ নয় বলে বারবার স্ত্রী ত্যাগ করলে বাজারে তার দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অথচ অর্থনৈতিক উচ্চবিত্ত শ্রেণি, তারকা লেখক-লেখিকা, গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা-সমাজের আইন অমান্যকারী জোচ্চোর শ্রেণি, কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই প্রতিদিন সঙ্গী পরিবর্তন করে চলেছে। এই শ্রেণির কেউ কেউ হুজুর নির্দেশিত বালিকা বধূ, ব্রাহ্মণ নির্দেশিত অসহায় কুলীন বধূ, শিয়া নির্দেশিত চুক্তি বধূ- এমনকি নানারূপে অসংখ্য দাস-দাসী গমন করছে, তারা আজকে অর্থনৈতিকভাবে আকবর বাদশা। তাদের স্বামী বা স্ত্রী স্বধর্ম বা বিধর্মে তা নিয়ে যদিও তারা চিন্তিত নন, তবু আমরা স্বনিয়োজিত হয়ে তাদের পক্ষ অবলম্বন করে সামাজিক মিডিয়া গরম করে তুলছি- যাতে তাদের গায়ে কোনো আঁচড় না লাগে- এটি সমশ্রেণির প্রতি সহমর্মিতার নিদর্শন। অথচ কিছুদিন আগে দিল্লিতে রাহুল রাজপুত নামে ইংরেজি অনার্সের এক ছাত্র অসমবর্ণে প্রেমের দায়ে প্রেমিকার পরিবারের লোকজনের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছে- এই খবরটি নিয়ে কারো মধ্যে তেমন আগ্রহের উদ্রেক করেনি। প্রতিদিন উপমহাদেশে এ ধরনের করুণ ঘটনা অবিরত ঘটে চলেছে। এমনকি ধর্ষণের শিকার নারীদের প্রায় শতভাগ দুর্বল অর্থনৈতিক শ্রেণির ও ক্ষমতা কাঠামোর বাইরের মানুষ।
রানি ভিক্টোরিয়া মুন্সি আব্দুল করিমের প্রেমে মশগুল থাকলে, ডায়ানার ডোডি ফায়েদের সঙ্গে যুক্ত থাকা তাদের ক্ষমতা ও অধিকার, জনগণ কিংবা ভক্ত-শ্রেণি নিজের আনন্দে সে-সব নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তা না হলে তারা রাজা-রানি বা তারকা কেন! কিন্তু প্রতিদিন যারা পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে নিহত হচ্ছে তাদের জন্য কোনো নারীবাদীরা এগিয়ে এসে সমাজ ও শ্রেণিচ্যুতির কোনো আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে না, বরং প্রত্যহ স্বগোত্র-স্বধর্ম-স্বশ্রেণির মধ্যে তথাকথিত নিজের বিদ্রোহী সত্তা জাহির করছে। এমনকি এসব ক্ষেত্রে নারীর পক্ষ অবলম্বন মূলত পুরুষের ক্ষমতা কাঠামোর অংশ, তাতে দুর্বল নারীদের ক্ষতি বৈ লাভ নেই। উনিশ শতকে রামমোহন-বিদ্যাসাগর বিশ শতকে বেগম রোকেয়া ছাড়া কেউ প্রায় ভাবতেই পারল না, নারীর ক্ষমতায়নে সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা আছে। তারকা নারীরা কখনো সংখ্যাগুরু নারীর প্রতিনিধিত্ব করে না- যতটা করে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর।
এ দেশের নারীরা এখনো পুরুষের পৃষ্ঠপোষকতায় নারী মুক্তির স্বপ্ন দেখে, অথচ উনিশ-বিশ শতকের পুরুষের তুলনায় বর্তমানে নারীরা সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে বহুগুণে শক্তিশালী অথচ প্রভাবের বাইরে তাদের কোনো ভূমিকাই আজো লক্ষ্য করা গেল না। তারা যতটা পোশাকের স্বাধীনতার জন্য, মুখ নিঃসৃত বাণীর জন্য, মধ্যরাতে ক্লাবে যাওয়ার জন্য, দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করার জন্য লড়াই করেছেন ততটা উত্তরাধিকারের জন্য, আইনের চোখে সমতার জন্য লড়াই করেনি। তারা প্রশ্ন করেনি- একই পিতামাতার সন্তানরা কেবল লিঙ্গরেখার কারণে কেন বৈষম্যের শিকার হবে? দৈব আইনও হয়তো ততটা বৈরি নয়, যতটা সমাজ তৈরি করে নিয়েছে। যতক্ষণ এই সমস্যার সমাধান না হবে ততক্ষণ নারীমুক্তি উচ্চবর্গীয় সংলাপ ও নারী পারফরমারদের মুক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়