কাতার নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : প্রবাসে অপরাধে জড়ালে দায় নেবে না সরকার, দালালের মাধ্যমে কেউ বিদেশমুখী হবেন না

আগের সংবাদ

বিপর্যয় সামালের সক্ষমতা কম : ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারামেডিকেল টিম নেই, প্রয়োজন উন্নত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম

পরের সংবাদ

ইচ্ছে পূরণ

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মেয়ের স্কুলেই নাদিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয় থেকে গভীর বন্ধুত্ব। আমার মেয়ে মেঘা, নাদিয়ার মেয়ে অবন্তী। আমাদের দুজনের আর কোনো সন্তান নেই। অবন্তী আর মেঘা একই ক্লাসে পড়ে। দুজনেরই পড়াশোনার প্রতি প্রচণ্ড অনীহা। আমার আর নাদিয়ার মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল থাকলেও একটি বিষয়ে খুব অমিল- আমি মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে খুব সিরিয়াস কিন্তু নাদিয়া ততটা সিরিয়াস নয়। নাদিয়া সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, শপিং করে, মুভি দেখতে যায়। আমি সারাদিন বসে বসে মেয়েকে পড়াই।
মেঘা ক্লাস সিক্সে ওঠার পর আমি বাসায় টিচার রাখলাম। অনেকগুলো কোচিংয়ে ভর্তি করালাম।
অবন্তীর জন্য বাসায় একটা টিচার রাখল নাদিয়া।
নাদিয়াকে বললাম, অবন্তীকেও কোচিংয়ে ভর্তি করাও।
নাদিয়ার উত্তর, কেউ চাইলে নিজে নিজেই পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। স্কুলের টিচাররা তো আছেই। অবন্তীকে তো আমি প্রাইভেট টিচার দিয়েছি। এর চেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারব না আমি। আমার মনে হয় করা উচিতও নয়। তাছাড়া সামর্থ্যরেও একটা বিষয় আছে। একগাদা কোচিংয়ে দেয়ার মতো টাকা নেই আমার।
তুমি যত টাকা ঘোরাঘুরি আর শপিংয়ের পেছনে খরচ করো, সেই টাকা অবন্তীর কোচিংয়ের পেছনে খরচ করার পরও বেঁচে যাবে নাদিয়া- আমি বললাম।
আমার নিজেরও একটা জীবন আছে, সেই জীবনটা উপভোগ করা উচিত।
আমি মনে মনে বলি, নাদিয়ার ধারণা একদম ভুল। নিজের জীবন উপভোগ করার প্রচুর সময় আমরা পরে পাব। এখন প্রয়োজন হলে সবটুকু সময় মেয়েকে দেয়া উচিত।
সকাল থেকে বাসার কাজ শেষে মেয়ে যখন বিকালে টিচারের কাছে পড়তে বসে নাদিয়া তখন ইয়োগা সেন্টারে যায়, শপিং করে, মুভি দেখতে যায়, ঘোরাঘুরি করে।
সকাল থেকে বাসার কাজ শেষে মেয়ে যখন টিচারের কাছে পড়তে বসে নিজের ইচ্ছেগুলোকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে আমি তখন পাহারা দেই, মেয়ে টিচারকে ফাঁকি দিচ্ছে কিনা, টিচার মেয়েকে ফাঁকি দিচ্ছে কিনা। প্রায় ছুটিতেই নাদিয়া কখনো মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে, কখনো একা একা ঢাকার বাইরে ঘুরতে যায়। ছুটি হলেই আমি একটার পর একটা কোচিংয়ের পেছনে ছুটি। মেয়ের সিলেবাস এগিয়ে নেয়ার মরণপণ চেষ্টা করি!
মেঘা খুব ভালো রেজাল্ট করে এসএসসি পাস করল। অবন্তী টেনেটুনে কোনোরকমে পাস করল।
আমি আর থাকতে পারলাম না। অবন্তী তো আমার মেয়ের মতোই। নাদিয়া এভাবে অবন্তীর ক্ষতি করতে পারে না। নাদিয়া বুঝতে পারছে না। ওর ভুলটা ধরিয়ে দেয়া উচিত আমার।
তোমার এভাবে ঘোরাঘুরি করা উচিত নয় নাদিয়া। অবন্তীর পড়াশোনার প্রতি তোমার নজর দেয়া উচিত। তুমি ভুল করছ। একদিন তোমাকে আফসোস করতে হবে- আমি বললাম।
নাদিয়ার উত্তর, আমি কোনো ভুল করিনি।
আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে এবার সে বলল, ভুল করছ তুমি। আমি আফসোস করব না, একদিন আফসোস করতে হবে তোমাকে।
আমি এমন হাসি হাসলাম! নাদিয়ার নজর এড়াল না। হাসিটার মানে, আমার মেয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে, তোমার মেয়ে টেনেটুনে পাস! তুমি বলছ আমি ভুল করছি! আফসোস করব আমি! আহাম্মক কত প্রকার হয়!
আমার সেই অর্থপূর্ণ হাসিকে থোড়াই কেয়ার করে নাদিয়া হাসতে হাসতে বলে, নিজেকে ভালোবাসতে শেখ। তোমাকে আফসোস করতে হবে না কোনোদিন।
তোমার ভাবনায় ভুল আছে নাদিয়া। তুমি আগে ঘোরাঘুরি করছ। আমি পরে ঘোরাঘুরি করব। মেয়ের ক্ষতি করে জীবন উপভোগ করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। সবকিছুর একটা সময় আছে। মেয়েকে সেটেল করার পর আমার হাতে অফুরন্ত সময় থাকবে তখন ঘুরব, যা যা ইচ্ছে পূরণ করার করব। তাতে দুই দিকই রক্ষা হলো।
আমি পুরোটা সময়ই জীবনকে উপভোগ করতে চাই। যেখানে কাল কী হবে আমি জানি না। সেখানে মেয়ের সেটেলড হওয়া তো অনেক দূরের বিষয়। আমি আজ নিয়ে বাঁচি, কাল নিয়ে বাঁচি না। আমি আমার মেয়ের প্রতি যতটুকু দায়িত্ব পালন করছি তাতে মেয়ের যতটুকু সফলতা আসবে তাতেই আমি খুশি। তোমার মতো নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে মেয়েকে সফলতার সর্বোচ্চ সীমায় দেখতে চাই না আমি।
আমি ভাবলাম, ওর সঙ্গে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। চুপ করে গেলাম।
আমার স্বামী কোনো সবুজ শাড়ি গিফট করলে আমি সযতনে সেটা আলমারিতে তুলে রাখি, সবুজ পাহাড়ে যখন ঘুরতে যাব তখন শাড়িটা পরব বলে। নীল রঙের কোনো শাড়ি কেউ দিলে, তুলে রাখি সেন্টমার্টিনের নীল পানিতে যখন ঘুরতে যাব তখন পরব। সাদা শাড়ি পেলে রেখে দেই শরৎকালে যখন ঘুরতে যাব তখন পরব বলে।
আমার মেয়ে বুয়েটে ভর্তি হলো। ভেবেছিলাম বুয়েটে ভর্তি হলে আমি ফ্রি হতে পারব। কিন্তু সারাক্ষণ এই পরীক্ষা সেই পরীক্ষা লেগেই থাকে! পড়তে পড়তে মেয়ে সারাক্ষণ তার পছন্দের খাবার খেতে চায়, আমি সেগুলো বসে বসে বানাই। আমি নিজেকে সান্ত¡না দেই, আর একটু ধৈর্য ধরি। চূড়ায় তো প্রায় উঠেই গেছি!
মেয়ে বুয়েট পাস করেই চাকরিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দিলাম। বললাম, আমাদের সঙ্গেই এক বাসাতেই থাক। কিন্তু না, ওদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে তাই আমাদের বাসার পাশেই বাসা ভাড়া নিল। সংসার আলাদা করল, কিন্তু সংসার দেখার সময় নেই ওর। আমি সারাদিন মেয়ের বাসায় গিয়ে ওর নতুন সংসার গুছিয়ে দেই। বছর না ঘুরতেই ওর ফুটফুটে একটা মেয়ে জন্ম নিল। বাচ্চা আর সংসার চোখে দেখারও সময় পায় না আমার মেয়ে! স্বামী-স্ত্রী দুজনে বিশাল পদে চাকরি করে। দায়িত্ব অনেক, সারাদিন পাগলের মতো কাজ করে। ছুটির দিনেও অজস্র মিটিং! আমি নাতনি নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত, নিজের সংসার, মেয়ের সংসার সামলাই।
নাদিয়ার মেয়ে অবন্তী চাকরি করে। অবন্তী আর ওর স্বামী মিলে ওদের বাচ্চা বড় করছে, সুন্দর করে সংসার সামলিয়ে নিচ্ছে। ওরা তো আর আমার মেয়ে আর ওর স্বামীর মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বিশাল পদে দায়িত্বরত নয়। ওদের ওপর হাজার হাজার কাজের চাপ নেই। নাদিয়ার মেয়ে বিকালে অফিস থেকে বাসায় ফেরে, ওর স্বামী বিকালে অফিস যায়, ফেরে রাত ১২টায়। ওরা নিজেরাও ঘোরে। নাদিয়াও টই টই করে ঘোরে।
আমার নাতনি ক্লাস ফাইভে ওঠার পর মেঘারা সপরিবারে আমেরিকায় পাড়ি জমায়। আমার হাতে এখন অজস্র সময়। মেয়ের আমেরিকা যাওয়ার কষ্ট বুকে থাকলেও একটা শান্তি আমি অনুভব করি, এখন জীবনের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত চাওয়াগুলো পূরণ করতে পারব! বাকি জীবনটা ঘুরব, শপিং করব, গান শুনব, মুভি দেখব! যা যা এতদিন করতে পারিনি সব ইচ্ছে পূরণ করব, সব!
মেঘা আমেরিকায় যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর আমি আর নাদিয়া একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক ঘোরাঘুরি করলাম, শপিং করলাম। সকালে বের হয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর থেকেই কোমড়ে ব্যথা অনুভব করছিলাম। তবুও জোর করে সারাদিন ঘুরলাম। শেষের দিকে এসে কোমড়ের ব্যথাটা বেশ বেড়ে গেল। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। নাদিয়া গট গট করে হাঁটছে। আমি নাদিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছি না, নাদিয়া বিরক্ত হচ্ছে।
বুড়া হয়ে গেছি বুঝলা, আমি বললাম নাদিয়াকে।
আরে দূর! কী যে বলো না! মাত্র তো ষাট বছর! এটা কোনো বয়স নাকি আজকাল! আরো বিশ বছর ধুমায়ে বেড়াব, ফুর্তি করব আমরা। বিশ বছর না হলেও পনেরো বছর তো চোখ বন্ধ করে ঘুরতে পারব। আমি তো সারাজীবনটা উপভোগ করলাম। তুমি পনেরো বছর নিশ্চিন্তে জীবনটা উপভোগ করতে পারবা। পনেরো বছর তো কম সময় নয়, তাই না!
আমি মিটিমিটি হাসতে হাসতে মাথা নাড়ালাম। আসলেই তাই। আমি তো এভাবেই জীবনটাকে সাজিয়েছিলাম। পনেরো বছর নিজের ইচ্ছেগুলো পূরণ করে, ঠিকমতো জীবনটা উপভোগ করার পর যদি মারা যাই তাহলে কোনো আফসোস থাকবে না আমার। বাসায় ফিরলাম। কোমড়ে গরম পানির সেঁক দিলাম। কিন্তু কোনো উপকার হলো না। রাতে ঘুমাতে পারলাম না। সকালে বিছানা থেকে উঠতে পারছি না, কোমড়ে প্রচণ্ড ব্যথা! ভাবলাম অনেক ঘোরাঘুরি করেছি তাই, হয়তো রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, আমি আর কোনোভাবেই বিছানা থেকে উঠতে পারছি না! ডাক্তার বলল, ভয়ংকর হাড়ক্ষয়!
মেয়েকে সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য দিনের পর দিন ওর পেছনে ছুটেছি। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিনি। নিয়ম পালন করিনি। শরীরটা যে ভেতরে ভেতরে ক্ষয় হয়ে গিয়েছি তা কখনো খেয়াল করিনি। ডাক্তার একগাদা ওষুধ দিয়েছে। খাচ্ছি কিন্তু কোনো উন্নতি নেই। ডাক্তার বলেছে, স্বাভাবিক জীবনযাপন আর করতে পারব না। আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারি না। অল্পদিনের মধ্যেই ডায়বেটিস, কিডনি রোগ ধরা পড়ে। হাই প্রেসার আগে থেকেই ছিল। মেয়ে আমেরিকা যাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই আমার স্বামী হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। আমার মেয়ে প্রচুর টাকা দিয়ে অনেক কাজের লোক রেখেছে আমার দেখাশোনার জন্য। কিন্তু আমি চাই আমার মেয়ের হাতের ছোঁয়া, আদর, ভালোবাসা!
নাদিয়া নিজের শরীর ও মনের যতœ নেয়ার কারণে অসুখ-বিসুখ স্পর্শ করেনি ওকে। এখনো সে নাতনির হাত ধরে ঘোরাঘুরি করে, শপিং করে, মুভি দেখতে যায়। নাদিয়ার মেয়ে রাতে উঠে নাদিয়া ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে কিনা, মায়ের গায়ে চাদরটা ঠিকমতো আছে কিনা দেখে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অসুখ হলে সারারাত জেগে নাদিয়ার সেবা করে। ক’বছর ধরে মেয়ের সঙ্গেই থাকে নাদিয়ারা।
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মেয়ের ফোনের অপেক্ষা করি। একদিন যায়, দুদিন যায়, তিন দিন যায় মেয়ের ফোন আসে না! সময়ের বড়ই অভাব আমার মেয়ের, আমেরিকাতেও বিশাল পদে চাকরি করে আমার মেয়ে। ফোনের অপেক্ষা করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন হয়তো একদিন ফোন আসে। আমার তখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ফোন হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকি। কাজের মেয়ে ফোন ধরে ফোনের লাউডস্পিকার চালু করে, মেয়ে ওপাশ থেকে বলে ওঠে, মা তুমি সারাজীবনই আমার কষ্ট বুঝতে চাও না!
একদিন আলমারিতে গুছিয়ে রাখা সবুজ, নীল আর সাদা রঙের শাড়িগুলো বের করে নাড়াচাড়া করতে করতে আমার বুকটা হিংসেয় জ্বলে ওঠে! জীবনে এই প্রথমে আমি কাউকে হিংসে করলাম!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়