কাতার নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : প্রবাসে অপরাধে জড়ালে দায় নেবে না সরকার, দালালের মাধ্যমে কেউ বিদেশমুখী হবেন না

আগের সংবাদ

বিপর্যয় সামালের সক্ষমতা কম : ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারামেডিকেল টিম নেই, প্রয়োজন উন্নত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম

পরের সংবাদ

আতঙ্কের বসতি পুরান ঢাকা : কেমিক্যাল গোডাউন না সরায় ক্ষোভ, নিমতলীর ১৭ দফা বাস্তবায়ন জরুরি

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান : একের পর এক যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ট্রাজেডি। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এরপরও আগুন আর বিস্ফোরণ ঝুঁকিতেই রয়েছে পুরান ঢাকার প্রতিটি অলিগলি। বিশেষ করে হাজার হাজার কেমিক্যাল গুদাম, প্লাস্টিক কারখানা, জুতার কারখানা, ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাসের লাইন, অপরিকল্পিত ভবন ঐতিহ্যের পুরান ঢাকাকে পরিণত করেছে আতঙ্কের নগরীতে। কোনো বড় ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্টরা ঝুঁকিমুক্ত করতে নানা পদক্ষেপের কথা শোনান। তবে বাস্তবায়ন হয় না এর কিছুই। বিশেষ করে মৃত্যুকূপ খ্যাত কেমিক্যাল গুদামগুলো সরানো হয়নি এখনো। এগুলোকে রাসায়সিক পল্লীতে স্থানান্তরের কথা বলা হলেও কবে নাগাদ সেখানে সরানো হবে সেটিরও নির্দিষ্ট কোনো জবাব নেই কারো কাছে। ফলে বছরের পর বছর ধরে আতঙ্ক নিয়েই পুরান ঢাকায় বসবাস করছেন বাসিন্দারা।
এদিকে পুরান ঢাকা মৃত্যুকূপ হওয়ার পরও ঝুঁকি এড়াতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাসিন্দারা। একইসঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে পুরনো গ্যাসের লাইন সংস্কার ও কেমিক্যাল গুদাম সরানোর দাবি জানিয়েছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১০ সালে নিমতলী ট্রাজেডির পর গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭টি সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছিল। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে পুরান ঢাকায় আর এত বড় বড় ট্রাজেডির ঘটনা ঘটত না। কিন্তু সরকার ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন থেকে সরে এসেছে। পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে হলে, ওই ১৭ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিমতলী ট্রাজেডির পর করা ওই ১৭ দফা সুপারিশের মধ্যে রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেয়া; অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া; রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত, কেনাবেচা ও লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই; বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা এবং আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুত ও বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার কথা ছিল। সূত্র জানায়, নিমতলী

ট্র্যাজেডির পর সিটি করপোরেশন, শিল্প মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই কমিটি পুরান ঢাকায় অতি ঝুঁঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে- এমন ১ হাজার ৯২৪ জন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীর তালিকা করে। এই তালিকা মন্ত্রিসভায়ও জমা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানান্তর প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি। অথচ ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে অগ্নিকাণ্ডের জন্য পুরান ঢাকার ৫০৮টি প্লাস্টিক কারখানা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতে। মাত্র আড়াই হাজার গোডাউনকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের মতো গোডাউন অবৈধ। এসব গোডাউনে ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে। যার অনেকগুলোতেই রয়েছে সোডিয়াম আনহাইড্রোজ, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোপাইল ও টলুইনের মতো ২৯ ধরনের কেমিক্যাল- যেগুলো আগুনের আঁচ পেলেই ভয়াবহ ধরনের অগ্নিকাণ্ড তৈরি করতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১১ বছরে শুধু পুরান ঢাকায় পৃথক ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে মাত্র ৩টি ঘটনার পর মামলা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনের ৯৮ ভাগই অবৈধ। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাসায়নিকের এক একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী, যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে।
এদিকে সবশেষ গত মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ক্যাফে কুইন স্যানেটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরণে ঝরে যায় ২২টি প্রাণ। আহত হয় দুই শতাধিক। ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিস্ফোরণ এতটাই ভয়াবহ ছিল, সব লাশ উদ্ধারের পর ভবনটি ধসে পড়ার শঙ্কায় বন্ধ রাখা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কার্যক্রম। নিমতলী, চূড়িহাট্টা, আরমানিটোলা ট্রাজেডির পর এই ঘটনায় আবারো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।
সিদ্দিকবাজারের স্যানিটারি ব্যবসায়ী ‘ফরহাদ ট্রেডিংয়ের’ মালিক ফরহাদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, পুরান ঢাকা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। এরপরও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সপরিবারে এখানে থাকছি, ব্যবসা করছি। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, একের পর এক বড় ট্রাজেডির সাক্ষী হতে হচ্ছে আমাদের। সবশেষ ক্যাফে কুইন স্যানেটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে পরিচিত অনেককে হারাতে হলো। যাদের দেখে ব্যবসা করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি, চোখের সামনে তাদের চাপা পড়া লাশ উদ্ধার করতে দেখেছি। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে। আমরা আর আতঙ্ক নিয়ে বাস করতে চাই না। পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হোক। গ্যাস লাইন সংস্কার করে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।
সিদ্দিকবাজারের বাসিন্দা ফল ব্যবসায়ী রিপন ভোরের কাগজকে বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা শুনি। সেই নিমতলী ট্রাজেডি থেকে এসব আশার বানী শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। এখন আমরা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা চাই। সব কেমিক্যাল গুদাম ও জুতার কারখানাসহ পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ সবকিছু সরিয়ে নেয়া হোক। এক প্রশ্নের জবাবে রিপন বলেন, কেমিক্যাল কারখানা মানেইতো মৃত্যুকূপ। কিছু লোভী বাড়িওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া পাওয়ার আশায় এসব কারখানা করার সুযোগ দিচ্ছে। প্রশাসন সব জেনেও চুপ। আগুন আর বিস্ফোরণে আর কত প্রাণ ঝরলে প্রশাসনের হুঁশ ফিরবে জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। সেখানকার আরেক বাসিন্দা নবাবপুরের একটি মোটর পার্টস দোকানের কর্মচারী সুজন শিকদার ভোরের কাগজকে বলেন, ঝুঁকির কথা বলে কী লাভ। দুর্ঘটনা ঘটার দুদিন পর সবাই ভুলে যায়। সিদ্দিকবাজারে এই যে বিস্ফোরণ ঘটলো, এটি নিয়ে সবাই ব্যস্ত। অথচ ওই ভবনের পেছনে কয়েকশ জুতার কারখানা, যেখান থেকে আবারো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে সেদিকে কারো নজর নেই।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব ভোরের কাগজকে বলেন, অপ্রশস্ত রাস্তা, কেমিক্যাল গোদাম, অপরিকল্পিত ভবনের কারণে সবসময় পুরান ঢাকা ঝুঁকিতে থাকে। এই ঝুঁকিমুক্ত হতে সবার আগে পুরান ঢাকাবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তারা ঐক্যবদ্ধ নয় বলেই নিমতলী ট্রাজেডির পর যে ১৭ দফা বাস্তবায়নের কথা ছিল, সরকার সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে। পরবর্তীতে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা আর সরকারের ওপর চাপও প্রয়োগ করতে পারেনি। উল্টো তারা ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। এর থেকে বেড়িয়ে এসে কঠোর অবস্থানে গিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করে নিতে হবে। পাশাপাশি বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, রাস্তা প্রশস্ত করা, আধুনিক গ্যাস লাইন ব্যবস্থা, ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী পুরান ঢাকা পুনর্গঠনে ২-৩ শতাংশ সুদে বিশেষ প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে সিটি করপোরেশনের উদ্যগে প্রত্যেক ভবনে বসবাসযোগ্য নবায়নযোগ্য সার্টিফিকেট ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নিজের বাড়ি ও প্রতিবেশীর বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও বাসিন্দাদের উদ্যগী হতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, পুরান ঢাকার ঝুঁকি এড়াতে সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ আমরা করে যাচ্ছি। তবে বাসিন্দাদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। কেননা, পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন ও প্লাস্টিক কারখানাগুলোর কারণে ঝুঁকি কয়েকগুণ বেশি। অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ ঘটলে সরু রাস্তার কারণে উদ্ধার অভিযানেও আমাদের বেগ পেতে হয়। এসবকিছু বিবেচনায় যত দ্রুত সম্ভব কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক কারখানা সরিয়ে নেয়া হলে ভালো হবে। ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাসের লাইন সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার ডিজি বলেন, এ বিষয়ে তিতাস কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। তবে ঝুঁকি এড়াতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়