এবার ডিএনসিসির গাড়িচাপায় বাইক চালকের মৃত্যু : মেশিনে পেঁচিয়ে নিহত ১

আগের সংবাদ

আতঙ্কের বসতি পুরান ঢাকা : কেমিক্যাল গোডাউন না সরায় ক্ষোভ, নিমতলীর ১৭ দফা বাস্তবায়ন জরুরি

পরের সংবাদ

কেন এত ভবন বিস্ফোরণ? : সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব, সামর্থ্যরে ঘাটতি আছে রাজউকের

প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আজিজুর রহমান জিদনী : দুদিনের ব্যবধানে রাজধানীর দুটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ২৩ জনের প্রাণহানি ও শতাধিক আহতের ঘটনায় ফের সামনে এসেছে একটি প্রশ্ন। আর তা হলো- ঢাকায় এত ভবন বিস্ফোরণ ও এ ধরনের দুর্ঘটনার পেছনে দায় কার?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে নানা বিষয়। প্রথমত তারা বলছেন, মেগাসিটি ঢাকার সুউচ্চ ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামো প্রতিযোগিতা করে গড়ে উঠলেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না কেউ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সে ধরনের কোনো সমন্বয় নেই বললেই চলে। অসংখ্য গ্যাসলাইন ঢাকার তলদেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে তার নকশাও নেই। তারা জানেও না কোথায় কোথায় গ্যাস লাইন রয়েছে! আবার সেগুলোর সংস্কারও করা হচ্ছে না। বিদ্যুতেরও প্রায় একই অবস্থা। অধিকাংশ বাড়িতে নেই অবাধ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা। অকুপেন্সি (বাসযোগ্য) সনদ দেয়ার সক্ষমতা নেই রাজউকের। এমনকি ফায়ার সার্ভিসকে শুধু মনিটরিং করা ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। এখনো ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায়নের অপেক্ষায় রয়েছে তারা। ফলে রাজধানীতে এমন মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হচ্ছে না। এখনই এসব ঘাটতি দূর ও সমন্বয় জোরদার

করতে না পারলে ভবিষ্যতে তা আরো বাড়বে।
অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক কর্মকর্তা এ কে এম শাকিল নেওয়াজ গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, সাধারণত তিন কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রথমত, প্রকৃতিপ্রদত্ত ঝড়-বৃষ্টি। দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনাবশত (যা ভবনের সুয়ারেজ লাইন, মিথেন বা ন্যাচারাল গ্যাস, এলপি গ্যাস, তেলজাতীয় বা দাহ্যজাতীয় পাউডার থেকে সৃষ্ট)। আর তৃতীয় কারণটি হলো- উদ্যেশ্যপ্রণোদিত। যেমন- ভবন মালিকদের শত্রæতা বা বৈরিতা, ভবন ঋণ বা ইনস্যুরেন্স, তৃতীয় পক্ষের ক্ষোভসহ ব্যক্তিক নানা ইস্যু। যেহেতু প্রথম ও তৃতীয় কারণে বেশির ভাগ সময়ই বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে না, তাই দ্বিতীয় কারণেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। কিন্তু দ্বিতীয় কারণে এখন পর্যন্ত যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা বন্ধে বা কমিয়ে আনতে তেমন কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি। এই পরিস্থিতি না বদলালে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীজুড়ে ৭২ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা এখন টাইম বোমায় পরিণত হয়েছে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় বিপর্যয়। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, রাজউক বছরে গড়ে ১০-১৫ হাজার ভবনের অনুমোদন দেয়। কিন্তু গড়ে প্রতি বছর ৯০ হাজারের বেশি ভবন তৈরি হচ্ছে। তাহলে বাকিটা কীভাবে হচ্ছে? তাই যারা ভবন তৈরি করছেন, তাদের অনুরোধ করব, জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী যেন তৈরি করেন।
এ বিষয়ে নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা একটি আবদ্ধ সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছি। অর্থাৎ আমাদের বাড়িগুলো তৈরির সময় বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মানছি না বা প্রকৌশলী-স্থপতিদের দিয়ে প্রকৗশলগত দিক থেকে মজবুত বাড়ি করছি না। আর যে কর্তৃপক্ষ এসব দেখভালের দায়িত্বে আছে তারা সাংঘাতিক অবহেলা বা অবজ্ঞা করছে। আগে আমরা যেমন পর্যাপ্ত ভ্যান্টিলেটর (আলো-বাতাস) ব্যবস্থা রেখে কক্ষ বা রান্নাঘর বানাতাম এখন তার উল্টো করছি।
তিনি আরো বলেন, অপ্রকৌশলগত কার্যক্রমের কারণে আমাদের সেপটিক ট্যাংকগুলোতে ভেন্ট পাইপ রাখার যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ রয়েছে তা আমরা রাখছি না। আলো-বাতাস আসা যাওয়ার পথের লাইন বা পাইপ বন্ধ করে তারই ওপর কাঠামো নির্মাণ করছি। এমনকি বেজমেন্টে যেখানে কোনো কিছু করার কথাই না সেখানে আমরা দোকানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে গুদাম করে ফেলছি। ফলে সেখানে যদি পয়ঃনিষ্কাশন স্টোরেজ বা গ্যাসলাইন থাকে তাও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ছে। আর এসবের ব্যবহার পরিবর্তন করে নিয়মিত ভবনগুলোকে বিপজ্জনক টাইম বোমা বানিয়ে ফেলেছি আমরা।
ইকবাল হাবিব বলেন, দুঃখের বিষয় হলো- শুধু ভবনের ব্যবহার পরিবর্তন, অননুমোদিত কার্যক্রম বন্ধ, গ্যাস যেখানে জমতে পারে সেখানে ভেন্ট ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, সমস্ত কাঠামো ভূমিকম্প সহায়ক কিনা বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা মোকাবিলা করার যথাযথ ব্যবস্থা আছে কিনা- এমন ‘বাসযোগ্য সনদ’ প্রক্রিয়াও আমরা চালু করতে পারিনি। বিএনবিসি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের কথা থাকলেও তা হয়নি। সত্যিকার অর্থে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সব ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় করে প্রতি বছর যে কোনো ভবনের বিদ্যুতায়ন, এসি ব্যবস্থা, লিফট ব্যবস্থা ও গ্যাস ব্যবহারের কার্যক্রম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ‘বাসযোগ্য সনদ’ প্রক্রিয়া চালুর বিকল্প নেই।
একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে রাজধানীতে গ্যাস থেকে ৮টি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ বনানীর সিলভার স্টোন ভবনে বিস্ফোরণে কেউ নিহত না হলেও ৬ জন আহত হন। ওই বছরই ২৪ জুন উত্তরার আলাউদ্দিন টাওয়ারে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪ জন নিহত ও ৬ জন আহত হন। ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী ধলপুরে বিস্ফোরণে ৬ জন নিহতসহ আহত হন ১ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন নিহত হওয়াসহ আহত হন ৩৭ জন। পরের বছর ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ১০ জন আহত হন। একই বছর ১২ নভেম্বর একই এলাকায় বিস্ফোরণে ১ জন নিহত ও ৮ জন আহত হন। ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকায় বিস্ফোরণে মারা যান ৯ জন, আহত হন আরো ৬৬ ব্যক্তি। কয়েকটি দুর্ঘটনার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। যেগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন সামনে এসেছে, সেখানে বিস্ফোরণের পেছনে মূলত দায়ী করা হয়েছে ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে। প্রতিবারই ঘটনার তদন্তে কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রকাশ্যে এলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বেশির ভাগ সময়ই দায় চাপিয়ে দেয়া হয় ভবন মালিকের ওপর। অনেক বিষয় তদারকি করা সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলেও বারবার তাদের দায় এড়াতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, বিস্ফোরণ থেকে আগুন শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা বাংলাদেশেই হতে পারে। তবে ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ বলে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এখানে কমপ্লায়েন্স একটি বড় ইস্যু। ২০০৪ সালের শাঁখারি বাজার ট্র্যাজেডি থেকে ওয়াহিদ ম্যানশন ও এফআর টাওয়ারের দুর্ঘটনা যদি আমরা দেখি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তদন্ত কমিটি কিছু পরামর্শ দিয়েছে। তবে সেগুলোর কোনোটি কি বাস্তবায়িত হয়েছে? না সেভাবে কিছুই হয়নি। শুধু আলোচনাই হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পুরান ঢাকায় ২০১৫-১৬ সালে আমরা ৪০০ এর মতো ভবন জরিপ করেছিলাম। তখন আমরা সবগুলোতেই গুদাম পেয়েছি। চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর প্রত্যেকটাকে উৎখাতের চেষ্টাও হলো। তবে এরপরই আবার সব কর্মযজ্ঞ থেমে গেল। আসলে ব্যবস্থা না নিতে পারলে এমন ঘটনাই ঘটবে। রাজউকের কোনো ক্যাপাসিটি নেই উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক বলেন, প্রত্যেকটি উন্নত বা নিয়ম মেনে চলা দেশে সেখানকার নগর কর্তৃপক্ষ ভবনগুলোকে অকুপেন্সি সনদ দিয়ে থাকে। কিন্তু ঢাকায় ৬ লাখ ভবনের মধ্যে মাত্র ১০০টিতে রাজউক অকুপেন্সি সনদ দিতে পেরেছে। অকুপেন্সি সনদ সাধারণত ভবনের কমপ্লায়েন্স অর্থাৎ বিদ্যুৎ, গ্যাসলাইন, সুয়ারেজ লাইন, ফায়ার সেফটি পরীক্ষা করে দেয়া হয়ে থাকে। সে ক্যাপাসিটি রাজউকের নাই। তাই আমাদের দেশেই বিআরটিএ ও পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ থার্ড পার্টিকে দিয়ে তাদের কাজ করাচ্ছে। রাজউকও তা করতে পারে। তবে এখানে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নয়তো এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়