সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের উদ্বেগ

আগের সংবাদ

কেন এত ভবন বিস্ফোরণ? : সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব, সামর্থ্যরে ঘাটতি আছে রাজউকের

পরের সংবাদ

৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা না করা ছিল বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত

প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে যুদ্ধপ্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছিলেন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগে ৩ মার্চ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে পল্টনে এক ছাত্র গণসমাবেশে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। আর সেই ইশতেহারের একটি ধারায় বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। কথা ছিল ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। কিন্তু ১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ৩ মার্চের প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বাংলার ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওই দিনই (১ মার্চ) ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির অনির্ধারিত বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের জানান, আমরা যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষম এবং ৭ কোটি বাঙালির মুক্তির জন্য আমি চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত রয়েছি। ষড়যন্ত্রকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় না হলে আমরা নতুন ইতিহাস রচনা করব। বস্তুত ‘নতুন ইতিহাস রচনা করব’ কথাগুলোর দ্বারা বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণারই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির নানাদিক পর্যালোচনা করলে এটা পরিষ্কার হয় যে, পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং কথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ মতো অন্য কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতার বিষয়টি মাথায় রেখে কৌশলী বক্তব্য দেন তিনি।
সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলেছেন, মুক্তির কথা বলেছেন। যুদ্ধ শব্দটি সরাসরি না বলে ‘লড়াই’ এর জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকার কথা বলেছেন। সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে চাকরিজীবী ও সাধারণ জনতা এই ভাষণ শুনে শিহরিত হয়েছেন। সিদ্ধান্ত জেনে গেছেন, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের গণ্ডিবদ্ধ নেই। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই ভাষণ শোনার পর যে রক্ত আগুন জ্বলে উঠে বাঙালির শিরা-উপশিরায় সেই থেকে বাঙালিরা নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসিহংস-অসহযোগ আন্দোলনে। চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষার পর এলো ২৫ মার্চ। সেই থেকে মুক্তির শেষ সময় পর্যন্ত বাঙালি তরুণ-যুবক-দামাল ছেলেসহ বাঙালি, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা এই ভাষণকে মন্ত্রজ্ঞান তথা যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ মনে করে লড়াই করে গেছেন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। যদিও ২৫ মার্চের দিনগত মধ্যরাতে গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক একটি ঘোষণা দিয়ে যান। বস্তুত ৭ মার্চের ভাষণের পর দেশের সাধারণ কৃষক-শ্রমিক দিনমজুর থেকে গাঁয়ের গৃহবধূর মুখে মুখেও তখন বলাবলি হচ্ছিল, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকছে না। যে কোনো মুহূর্তে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। যেসব বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং অস্ত্র তুলে নেয়ার আহ্বান মনে করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক, (পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) জেনারেল জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের আরেক সেক্টর কমান্ডার হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে প্রথম প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী ইপিআর কমান্ডার, মেজর রফিকুল ইসলাম (পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) বলেন, ‘… সেদিন আমার অনুভব হয়েছিল, তার ভাষণে আমাদের প্রত্যেকের জন্য শুধু নয়, সামরিক বাহিনীর প্রতিটি বাঙালির জন্য কী করণীয় তিনি সে নির্দেশ সুস্পষ্টভাবে সে ভাষণে দিয়েছিলেন। (চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় দেয়া বক্তৃতা-১৯৯৪)।
তারপরও কিছু লোক মাঝে মাঝে প্রশ্ন তোলেন, বঙ্গবন্ধু কেন সেদিন (৭ মার্চ) সরাসরি বা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেরকম করলে তাৎক্ষণিক পরিণতি বা বিশ্বব্যাপী কী প্রতিক্রিয়া হতে পারত সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মাথায় রাখেন বলে মনে হয় না। তখনো বিশ্বের অন্যতম প্রধান সুপার পাওয়ারের অধিকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শক্তি চীন পাকিস্তান সরকারের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা মানেই হলো যুদ্ধ ঘোষণা। কিন্তু এই যুদ্ধ শুরু হলে তা দীর্ঘায়িত বা স্বল্পকালীন হওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভ ও বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী চুক্তি তখনো সম্পাদিত হয়নি। এমনই এক পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বল্পকালীন একান্ত বৈঠকে বসে জানিয়ে দেন যে, ‘পূর্ব বাংলার স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’ এর আগে ৬ মার্চ চরম কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আহ্বান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘আমার অনুরোধ তাড়াতাড়ি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকা এসে আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করব। আমি আশ্বাস দিতে পারি যে, জনগণের কাছে আপনার প্রদত্ত ওয়াদা পালিত হতে পারে।’ (বাংলাদেশের তারিখ : মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৩৮)। এমন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কী সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন? জানা যাক বিশিষ্ট আইনজীবী, বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের একটি বিশ্লেষণের উদ্ধৃতি থেকে; ‘এটা পরিষ্কার ছিল যে, ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ এবং রাজনীতি সচেতন ব্যাপক জনগণের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে দায়িত্বের ভার ছিল শেখ মুজিব ও তার দলের ওপর ন্যস্ত। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার সার্বিক ফলাফল তাই সতর্কভাবে বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন ছিল। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অর্থ দাঁড়াত সামরিক বাহিনীকে তার সব শক্তি নিয়ে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ররোচিত করা। বহির্বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়াই বা কী দাঁড়াবে? অন্য দেশের সরকারগুলো কি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে? একটি সুসংগঠিত সামরিক আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য যতদিন প্রয়োজন ততদিন টিকে থাকতে পারবে তো? অজস্র প্রশ্নের মধ্যে এগুলো ছিল কয়েকটি যা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা হলো। বৈঠকে শেখ মুজিব বিভিন্ন মত শুনলেন, তবে নিজের অভিমত সংরক্ষিত রাখলেন।’ কাজেই চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ‘স্বাধীনতা’। কিন্তু শেখ মুজিব কেবল একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত রইলেন। কেননা এটা পরিষ্কার ছিল যে, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে এবং নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে তারা অবস্থানও নিয়ে ফেলেছে যাতে স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়া হলে তৎক্ষণাৎ তারা আক্রমণ শুরু করতে পারে।’
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পূর্ববর্তী মধ্যরাতে (৬ মার্চ) ইয়াহিয়ার একটি বার্তা নিয়ে একজন ব্রিগেডিয়ার এসেছিলেন দেখা করতে। বার্তায় বলা হয়েছিল, ইয়াহিয়া খুব শিগগিরই ঢাকায় আসার ইচ্ছা রাখেন এবং এমন একটি মীমাংসায় পৌঁছার আশা করছেন যা বাঙালিদের সন্তুষ্ট করবে। এটা ছিল এক চাতুর্যপূর্ণ যোগাযোগ… এটাকে তার (ইয়াহিয়ার) জন্য একটা অজুহাত তৈরির চেষ্টা হিসেবেও দেখা হলো এভাবে যে, যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয় তাহলে ইয়াহিয়া সারা পৃথিবীকে বলতে পারবে যে, একটি শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছার জন্য তিনি ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবই একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে শক্তি প্রয়োগে বাধ্য করেছেন। ৭ মার্চ একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া থেকে শেখ মুজিবের বিরত থাকার ক্ষেত্রে এটাও ছিল বিবেচনার আর একটি বিষয়। (ড. কামাল হোসেন : মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল; পৃষ্ঠা ৬১-৬৩-৬৪)।
সুতরাং যারা বলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা যুদ্ধ ঘোষণা না করে ভুল করেছিলেন- বলা যায়, তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই। কারণ সেদিন বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খান বা মার্কিনি সতর্কতাকে উড়িয়ে দিয়ে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তা হতো যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া এরকম ঘোষণা বরং পাকিস্তানি বাহিনীকে তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র হামলার জন্য উসকানি হিসেবে গণ্য হতো। সেরকম হামলা শুরু হলে মূল নেতৃত্বসহ স্বাধীনতাকামী হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেন। অত্যাচার-নির্যাতনে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াত যে, বাঙালির স্বাধীনতা তো দূরের কথা, এমনকি স্বায়ত্তশাসনও স্বপ্নের বিষয় হয়ে থাকত। ৭ মার্চের পর বাঙালি ছাত্র-যুবক-জনতা স্থানীয়ভাবে বা ভারতে গিয়ে লড়াইয়ের জন্য যেটুকু প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল সেরকম সুযোগও আর পাওয়া যেত না। আসলে হাজারো সাধারণ নেতাকর্মী আবেগের বশে চাইলেই এমন কোনো সিদ্ধান্ত কোনো দূরদর্শী জাতীয় নেতা নিতে পারেন না, যা তার দেশ ও জাতির জন্য বড় ধরনের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। কাজেই বলা চলে ৭ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা না করে বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী নেতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

মুহাম্মদ শামসুল হক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক; সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়