সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের উদ্বেগ

আগের সংবাদ

কেন এত ভবন বিস্ফোরণ? : সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব, সামর্থ্যরে ঘাটতি আছে রাজউকের

পরের সংবাদ

সাইবার হেনস্তার টার্গেট নারী : বুলিং, হ্যাকিং ও পর্নোগ্রাফির শিকার হচ্ছেন নারীরা > ১৮-২৪ বছরের ভিকটিমই ৬০%

প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান : রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাসিন্দা শারমিন আক্তার (ছদ্মনাম)। সদ্য ভর্তি হয়েছেন একটি কলেজে। এরই মধ্যে একই এলাকার বাসিন্দা ফেরদৌসের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। সম্পর্ক চলাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেরদৌসের সঙ্গে আদানপ্রদান হয় বিভিন্ন নগ্ন ছবি। ফেরদৌস মাদকাসক্ত হওয়ায় একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্কে চিড় ধরে। আর এতেই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন ফেরদৌস। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন নগ্ন ছবিগুলো। এ ঘটনায় শারমিন উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। কিন্তু আইনগতভাবে আর সামনে আগাননি শারমিন। পুলিশের কাছে শুধুই ছবিগুলো অপসারণের দাবি জানান তিনি।
শুধু শারমিন নন, সাইবার ক্রাইমের শিকার অধিকাংশ নারীর অবস্থা একই। কেউ অভিযোগ করে পরে পিছিয়ে যাচ্ছেন, আবার অভিযোগ না করে অন্তরালেই থেকে যাচ্ছেন অনেকে। বিশেষ করে টিনএজার বা কিশোরী বয়সের মেয়েরা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, নিজের পরিবারকেই জানাতে চান না কিছু। আবার অনেক শিক্ষিত সচেতন নারীও আইনি ঝামেলার মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে এড়িয়ে যান সাইবার ক্রাইমের ঘটনাগুলো। আবার অনেকে বিভিন্ন ফিশিং লিংকে ঢুকে আইডি হারিয়ে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েও নিজের কপালকে দোষ দিয়ে চুপ করে থাকেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, ভিকটিমের ওপরই দায় চাপানোর মনোভাব, সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকার অভাবের কারণে বেশির ভাগ ভিকটিম কিছু প্রকাশ করেন না। এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সাইবার অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের পরামর্শ তাদের।
এদিকে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, সহজ অ্যাক্সেস ও দিনকে দিন নতুন প্ল্যাটফর্ম আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। বিশেষ করে পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, হ্যাকিংয়ের মতো ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েই চলেছে। আর যারা এসবের শিকার হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই নারী।
পুলিশ সদরদপ্তরের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন শাখার তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ফেসবুক পেজে ৩২ হাজার ১৫টি মেসেজ, হটলাইনে ৬০ হাজার ৯৮৫টি ফোনকল ও ই-মেইলে ৬৯০টি মেইল এসেছে। সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ২৪ হাজার ৯৫৮ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানিসংক্রান্ত প্রতিকার চেয়ে যোগাযোগ করেছেন। যাদের মধ্যে ৮ হাজার ৩০১ জন আইনগত ব্যবস্থা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। মোট অভিযোগকারীদের ১৫ হাজার ৯৮৩ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।
সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন শাখা আরো জানায়, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়ে ২২ হাজার ৩০৪টি। এগুলোর মধ্যে ফেইক আইডিসংশ্লিষ্ট অভিযোগ ৪৪ শতাংশ, আইডি হ্যাক ১২ শতাংশ,

ব্ল্যাকমেইল ১৭ শতাংশ, হয়রানি ১০ শতাংশ, আপত্তিকর কন্টেন্ট ছড়ানো ৯ শতাংশ, অন্যান্য অভিযোগ ৯ শতাংশ। ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জমা পড়া ২ হাজার ৬৫৪টি অভিযোগের মধ্যে হয়রানিমূলক ৩১ শতাংশ, ব্ল্যাকমেইলিং ১৯ শতাংশ ও সাইবার বুলিং ৮ শতাংশ। যারা অভিযোগ করছেন, তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বয়স ১৮-২৪ বছর, ৩৫ শতাংশের বয়স ২৪-৩৫ বছর, ১১ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে ১৭১টি সাইবার মামলা তদন্ত করেছে তারা। এর মধ্যে ২০ দশমিক ৪৬ শতাংশ পর্নোগ্রাফি ধারণ ও অনলাইন হয়রানিসংক্রান্ত- যার ৯৯ শতাংশ ভিকটিমই নারী। মামলাগুলোর ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ ফেসবুকসহ অন্যান্য হ্যাকিংসংক্রান্ত। যার ৯০ শতাংশ ভিকটিমই নারী। মিথ্যা তথ্য ও মানহানিকর বক্তব্য প্রচারসংক্রান্ত মামলা ২১ দশমিক ০৫ শতাংশ। এখানেও বেশির ভাগ নারী। ২০২১ সালে সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ তদন্ত করে ২০৬টি মামলা। যেখানে পর্নোগ্রাফি ও অনলাইন হয়রানি ছিল ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশ। আর মিথ্যা তথ্য প্রচার ছিল ২০ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর দুই ধরনের অপরাধই বেড়েছে।
২০২২ সালে ডিবির এই বিভাগটি ১১৯৯টি সাইবার ক্রাইমসংক্রান্ত সাধারণ ডায়েরি (জিডি) তদন্ত করে ৭৩০টির সমাধান করেছে। সেখানেও বেশির ভাগ ভিকটিম নারী। এদের মধ্যে অনেকে গুরুতর সাইবার অপরাধের শিকার হলেও মামলায় জড়াতে চাননি। বিশেষ করে কিশোরীরা সম্মান বাঁচাতে জিডি করলেও আপত্তিকর কনটেন্ট সরিয়ে ফেলার পর আর আইনগতভাবে অগ্রসর হতে চান না।
সিআইডি সদরদপ্তরের সাইবার ইউনিটের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে সাইবার সেলে ২৩ হাজার ১৯৫টি অভিযোগ এসেছে। সমাধান হয়েছে ১৪ হাজার ৮৯৩টি। অভিযোগ গুরুতর হওয়ায় মামলায় রূপান্তরিত হয়েছে ১৬৫টি ঘটনা। যে অভিযোগগুলো জমা পড়েছে এর ৫৩ শতাংশই নারী। যাদের ৫৫ শতাংশ সাইবার বুলিং, ১২ শতাংশ যৌন হয়রানি ও ১০ শতাংশ আপত্তিকর ম্যাসেজের শিকার হয়েছে।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ২০২২ সালের জরিপ বলছে, ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগ সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, মেসেজ পাঠিয়ে মানসিক হয়রানি অন্যতম। জরিপে দেখা গেছে, সাইবার বুলিংয়ের শিকার ভুক্তভোগী ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ। যা ২০২১ সালে ছিল ৫০ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বেড়েছে অনলাইনে অপপ্রচারের ঘটনা। এছাড়া পর্নোগ্রাফি ও ফটোশপে ছবি বিকৃতি উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। জরিপ বলছে, ভুক্তভোগীদের ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। ১৮ বছরের কম বয়সি ভুক্তভোগী ১৩ শতাংশ। সাইবার মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
সাইবার ক্রাইমের শিকার নারীরা কেন অভিযোগ করতে চান না? জানতে চাইলে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ভিকটিমকেই দোষারোপ করে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হয়। ফলে অধিকাংশ নারী ভিকটিম অভিযোগ করতে চান না। অনেকে অভিযোগ করেও সামাজিক সম্মান ও নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আইনগতভাবে লড়াইটা এগিয়ে নিতে চান না। আবার অপরাধী বিত্তশালী বা প্রভাবশালী হলে ভিকটিম অভিযোগ করার সাহস পায় না। এই অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হলে ভিকটিমের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সাইবার অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইনটেলিজেন্স) মোহাম্মদ রেজাউল মাসুদ ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা সাইবার জগতে সহজেই বিচরণ করছি। কিন্তু সচেতনভাবে বিচরণ না করায় অনেকে সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে। আমাদের একটিই অনুরোধ, সাইবার ক্রাইমের শিকার হলে আইনগত ব্যবস্থা নিন। অবশ্যই পুলিশ তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
ডিবির সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, সাইবার ক্রাইম থেকে রক্ষা পেতে সচেতনতার বিকল্প নেই। এজন্য আমরা প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি কেউ অভিযোগ করলে সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়