সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের উদ্বেগ

আগের সংবাদ

কেন এত ভবন বিস্ফোরণ? : সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব, সামর্থ্যরে ঘাটতি আছে রাজউকের

পরের সংবাদ

কোভিড থেকে শিক্ষা নিয়ে কতটা বদলেছে স্বাস্থ্য খাত : সক্ষমতা বেড়েছে সামান্যই, অব্যবস্থাপনাও রয়ে গেছে

প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তি প্রথম শনাক্তের খবর আসে ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর খবরটি সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম জানায় ১৮ মার্চ। এরপর ক্রমেই সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে থাকে স্বাস্থ্য খাতের অসঙ্গতি, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির চিত্র। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের নানা উদ্যোগে ধীরে ধীর এ চিত্র বদলাতে থাকে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা সফলভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন পর্যায় থেকে ভূয়সী প্রশংসাও পায় বাংলাদেশ সরকার। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও অদৃশ্য এই ভাইরাস যে শিক্ষা দিয়েছে তা থেকে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ বা সরকার কতটা শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারির ৩ বছর পার করছে বাংলাদেশ। এ সময়ে করোনা নিয়ন্ত্রণসহ টিকাদানে সফলতা পেলেও স্বাস্থ্য খাতে প্রকট অব্যবস্থাপনা এখনো রয়েছে। করোনা সংক্রমণ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার আলোকে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদৃশ্য হয়েও কোভিড-১৯ ভাইরাস যে বার্তাটি আমাদের দিয়েছে তা অনুধাবন করতে শুধু বাংলাদেশ নয়; পুরো বিশ্বই ব্যর্থ হয়েছে। কোভিড বুঝিয়েছে অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, অর্থ কিংবা বিজ্ঞানে উন্নত হলেই স্বাস্থ্য খাতের যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করা যায় না। যদি তাই হতো তাহলে আমেরিকা, ইংল্যান্ডকে নাজেহাল হতে হতো না। দিল্লি ও গুজরাটের চেয়ে কেরালা ভালো করত না। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা এবং জনস্বাস্থ্যের

বিষয়গুলোতে যারা গুরুত্ব দিয়েছে তারাই পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে। বিষয়টি থেকে যদি না নেয়া হয় তাহলে ভবিষ্যতে করোনার মতো বড় ধরনের ধাক্কা এলে আগে মতোই নাজেহাল হতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ মনে করেন, এই ৩ বছর আমাদের যে অভিজ্ঞতা হলো সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছি কিনা, যেসব দুর্বলতা ছিল সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি কিনা- সেই দিকটি আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। জরুরি স্বাস্থ্য চিকিৎসার জন্য রোগী এক স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক মনস্কতা নিয়ে আমরা ইমার্জেন্সি হেলথ সিস্টেম যাতে তৈরি করতে পারি সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। যদি তা করতে পারি এটিই হবে আমাদের বড় প্রাপ্তি।
কোভিড সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে যে শিক্ষা দিয়েছে তা বাংলাদেশ কতটা ধারণ করেছে এই বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ। তিনি ভোরের কাগজকে জানান, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের দিক থেকে যদি শুরু করি তাহলে দেখব সেখানে এর প্রতিফলন হয়নি। জনস্বাস্থ্যে বরাদ্দ অধিকাংশে কমে গেছে। অথচ আমরা কোভিডের সময় দেখেছি, জনস্বাস্থ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ক্ষেত্র থেকে যদি বলি তাহলে বলব, সামনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়ও এই শিক্ষার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেনি। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের বিষয়টিও খুব বেশি দৃশ্যমান নয়। যেখানে আইসিইউ বেড ছিল না, অক্সিজেন ব্যবস্থা ছিল না তা হয়তো কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়নি। জনগণকে সম্পৃক্তকরণ বা আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে যেমনটা চলছিল এখনো তেমনটাই চলছে। ডেঙ্গুর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এই সমস্যা সমাধানে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় দরকার। এখানে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের খুব একটা সমন্বয় দেখছি না। ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়নের কথা আমরা বারবার বলছি। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করা যেতে পারত। সামনে নগরায়ণ আরো বাড়বে। ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সুযোগও তৈরি হবে। কিন্তু তা প্রতিরোধে কাজ তো খুব একটা হচ্ছে না। সামনে যদি ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয় তাহলে গতবারের মতো ডেঙ্গু নিয়ে আমরা যে হাবুডুবু খেয়েছি এর চেয়ে বেশি হওয়াটাও বিচিত্র কিছু হবে না।
কোভিড যে বার্তা দিয়েছে তা থেকে শিক্ষা যে একেবারেই নেয়া হয়নি তা ঠিক নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য খাতে আমূল পরিবর্তন হবে বলে যে আশা করেছিলাম তা হয়নি। আইসিইউ, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে টুকিটাকি কাজ হয়েছে। তবে দরকার হচ্ছে মহাপরিকল্পনার। ২০ বা ২৫ বা ৩০ বছর মেয়াদি একটা মহাপরিকল্পনা- যা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছানো যাবে। বিক্ষিপ্তভাবে যে কাজ হচ্ছে এর সুফল আসছে না। অথচ পয়সা খরচ হয়।
প্রতিরোধ স্বাস্থ্যসেবার দুর্বলতা স্বাস্থ্য খাতের বড় দুর্বল বলে মনে করেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। কেন এই দুর্বলতা তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা এবং তা কাটিয়ে উঠতে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন- এর জন্য টাস্কফোর্স করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য বিষয়ে বিজ্ঞ এমন ৪/৫ জনকে নিয়ে এই টাস্কফোর্স করা যেতে পারে। শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে না। স্বাস্থ্য মানে হাসপাতাল, বেড ডাক্তার নার্স, সেবা দেয়া নয়। কারণ স্থানীয় সরকার, যোগাযোগ, পরিবেশ, সমাজকল্যাণ, পানি সম্পদসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই সমন্বয় ঘটাতে রাষ্ট্রের সর্বশক্তি নিয়ে কাজ করতে হবে।
করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক দুর্নীতির চিত্রও সামনে এসেছিল। এক্ষেত্রে করোনার শিক্ষা কতটা প্রতিফলিত হয়েছে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেনাকাটায় দুর্নীতি হচ্ছে। এই দুর্নীতির সঙ্গে ঠিকাদার জড়িত। এসব কাজে আগে যারা অভিযুক্ত ছিল তারা কি বাদ পড়েছেন? আমি তা মনে করি না।
তবে করোনা প্রতিরোধে টিকাদান কার্যক্রমের প্রশংসা পেয়েছে বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের অন্য দেশের মতো ২০২০ সালেই বাংলাদেশ করোনা প্রতিরোধী টিকা ক্রয় এবং বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের বিষয়ে জোর দেয়। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত অক্সফোর্ড এস্ট্রেজেনেকার টিকা দিয়ে দেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। তবে শুরুর দিকেই দেশে টিকাপ্রাপ্তির বিষয়টি হোঁচট খায়। ভারত সরকারের সিদ্ধান্তে চুক্তির কেনা টিকাও দেশে আসা বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই বিভিন্ন উৎস থেকে টিকাপ্রাপ্তির বিষয়ে তোড়জোড় চালায় সরকার। কোভ্যাক্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে দেশে টিকাপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়। বেগবান হয় টিকাদান কার্যক্রম। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে কোভিড টিকার প্রথম ডোজ দেয়া শুরু হয়। একই বছর ৭ এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ, ২৭ ডিসেম্বর তৃতীয় ডোজ এবং ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর চতুর্থ ডোজ দেয়া শুরু হয়।
কোভিড টিকা কার্যক্রম সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, শুরুর দিকে টিকাদান কর্মসূচিতে একটু সমস্যা হলেও সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সংকট কাটিয়ে উঠে চমৎকারভাবে টিকা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ কারণেই দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
১ মার্চ টিকাবিষয়ক এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর সাময়িকভাবে করোনা টিকার তৃতীয় ও চতুর্থ (বুস্টার) ডোজ দেয়া বন্ধের ঘোষণা দেন। নতুন করে টিকা হাতে পেলে আবারো কার্যক্রম শুরু হবে বলেও জানান তিনি। দেশে এখন পর্যন্ত ১৫ কোটি মানুষকে প্রথম ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ১৪ কোটির কাছাকাছি। তৃতীয় ডোজ নিয়েছেন ৬ কোটি এবং চতুর্থ ডোজ নিয়েছেন ৬ লাখের বেশি মানুষ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়