চীন-বাংলাদেশ কালচার এন্ড আর্ট নাইট

আগের সংবাদ

কাতারের উদ্যোক্তাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী : জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান

পরের সংবাদ

প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে পোলট্রি খাতের উৎপাদন বাড়াতে হবে

প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চারদিকে হইহল্লা, ছোটাছুটি। বেশ আনন্দমুখর একটি পরিবেশ। দুই ঘরের মাঝে ফাঁদ। অব্যর্থ চেষ্টা- ওকে ফাঁদে আটকাতেই হবে, না হয় লজ্জার অন্ত থাকবে না। ঘরে নতুন অতিথি। সকাল বেলা কে যেন একটু আগ বাড়িয়ে আজ খোপ ছেড়েছে। তাই তো মা-বোনের ভ্রæকুটিতে চিন্তার ভাঁজ। বেলা গড়িয়ে সূর্য প্রায় মধ্যগগনে। সবাই ব্যস্ত মোরগটাকে ধরতে। আবহমান বাংলার এটি একটি চিরায়ত কর্ম। যা দুই-আড়াই দশক আগেও দেখা যেত। মাছে-ভাতে বাঙালির আতিথেয়তায় থালায় একটু মুরগির মাংস- এটি ছিল যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক একটি ব্যাপার। পরিস্থিতি এখন অনেক পাল্টে গেছে। দেশ উন্নয়নের সঙ্গে প্রাণিজ প্রোটিনের এই উৎসও পরিবর্তিত হয়েছে। দেশি মুরগির স্বাদ মানুষ ভুলেই গেছে। এর স্থলে জায়গা করে নিয়েছে ব্রয়লার মাংস- যা খুবই সহজলভ্য। বাঙালির প্রোটিনের আরেক সহজ উৎস হলো মাছ। বাঙালির মৎস্যপ্রীতির কথা প্রাচীন ইতিহাসেও পাওয়া যায়।
আমরা এমন এক সময় পার করছি- যেখানে একটি আস্ত ইলিশ মাছ কেনাও পরিকল্পনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, গরুর মাংস তো অনেক দূরের ব্যাপার। আর খাসির মাংসের কথা মানুষ দিন দিন ভুলতে বসেছে। তাই তো অবশেষে গরিবের শেষ ভরসা ব্রয়লার মাংস। ঠিক কবে থেকে বাঙালি সমাজে মাংস খাওয়া প্রচলিত হয়, তা সুনির্দিষ্টভাবে ইতিহাসে পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকদের মতে, মাংস খাওয়া বাঙালি সমাজে বিশেষ জনপ্রিয় ছিল না। তবে মুসলমানরা মোরগের মাংস খেতেন এবং মোরগ জবাই করে মোল্লা পয়সা পেতেন। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল এবং বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এই মুরগির মাংসই এখন তুলনার বিচারে সবচেয়ে সস্তা ও মুখরোচকও বটে। এত গরিববান্ধব প্রোটিনের উৎস খুব কমই আছে। আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে পোলট্রি খামার চালু হয় আশির দশক থেকে। ক্রমান্বয়ে এটি একটি কৃষি খাতের উপখাতে পরিণত হয়েছে এবং জিডিপিতে অবদান রাখছে ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আমাদের দেশে ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে ৮০ থেকে ৯০ হাজার পোলট্রি ফার্ম রয়েছে। করোনার আগে সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ১০ হাজারের ওপর। দেশে প্রতিদিন ৪ কোটির বেশি ডিম উৎপাদিত হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। ১০ বছরের মধ্যে এই উৎপাদন তিনগুণের বেশি বেড়েছে। আর বণিজ্যিক ভিত্তিতে দৈনিক মুরগির মাংস উৎপাদিত হয় ৩ হাজার ৫০০ টন। তা এখন দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এতদসত্ত্বেও আমিষ গ্রহণের পরিমাণ বাংলাদেশের মানুষের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। পুষ্টিবিদরা বলছেন, মানবদেহের জন্য দৈনিক ২ হাজার ৪০০ ক্যালরি আবশ্যক। এটা কিন্তু একেবারেই ন্যূনতম হিসাব। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ যারা অধিক কায়িক পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল, তাদের ক্ষেত্রে এই ক্যালরি আরো বেশি প্রয়োজন। আর উচ্চবিত্তের কথা আলাদা, কারণ তারা কায়িক পরিশ্রমে বিযুক্ত। সাধারণত দেখা যায়, গ্রামীণ গরিব খেটে খাওয়া লোকজন জীবনধারণে প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৫৪ শতাংশ পূরণ করে ভাতের মতো শর্করা জাতীয় খাবার খেয়ে। আর শাকসবজির অবদান ৩৩ শতাংশ। মাছ প্রায় ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। মাংস থেকে আসে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। মোট কথা, ক্যালরির চাহিদা পূরণে গ্রামীণ খানাগুলো ভাত বা রুটির ওপরই অধিক নির্ভরশীল এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ মাংস পরিভোগ করে থাকে নামমাত্র। অথচ প্রোটিন ছাড়া মানুষের শরীর স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করতে পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মানবদেহের শক্তির ১০-১৫ শতাংশ আসা উচিত আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে। আর এই আমিষের ২০ শতাংশ আসতে হবে প্রাণিজ আমিষ থেকে।
উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এই আমিষের ৫০ শতাংশ আসে প্রাণিজ আমিষ থেকে। পশ্চিমা দেশের মানুষের গড় আয়ু বেশি। নেদারল্যান্ডসের মানুষ যথেষ্ট লম্বা হয়। চীনের একজন মানুষ ৭০ বছর বয়সেও অনেক বেশি কাজ করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আমাদের গড় আয়ু ৭৪ বছর ৩ মাস। অথচ একজন রিকশাচালকের গড় আয়ু মাত্র ৪৫ বছর। রিকশাচালকের আয়ুর এ করুণ অবস্থা কিন্তু প্রোটিনের অভাবেই। প্রোটিনের অভাব হলে মানুষ অকালেই বার্ধক্যে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এখনো প্রোটিন ঘাটতি অনেক। শুধু চালের উৎপাদন বাড়িয়ে একটি সুস্থ-সবল জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। তাই প্রাণিজ প্রোটিনের সহজ উৎস পোলট্রি খাতে মনোযোগ দিতে হবে। ইতোমধ্যে ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনে একটি বিল্পব ঘটিয়েছে এই শিল্প। প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকা ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান ও আগামীর আপামর মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে এ শিল্প অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ কৃষিভিত্তিক এ খাতটি নানামুখী অবহেলার শিকার। এমনিতেই অতিমারি করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চোট সামলাতেই দিশাহারা এই খাত সংশ্লিষ্টরা। এর ওপর আবার সাম্প্রতিক সময়ে ডলার ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা এই খাতের চলমান সংকটকে আরো গভীরতর করছে। সয়াবিন ও ভুট্টা দিয়ে মুরগির খাবারের ৭০-৭৫ শতাংশ উপাদান তৈরি হয়। আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পণ্যের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য বলছে, পোলট্রিজাত পণ্য, মাছ ও গবাদিপশু উৎপাদনে ব্যবহৃত ১৬ ধরনের কাঁচামালের দাম করোনা মহামারি শুরু অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চ থেকে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত গড়ে ৬৩ শতাংশের মতো বেড়েছে। আট ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ বা এরও বেশি হারে। এই কাঁচামালের দরের ঊর্ধ্বগতি এখনো অব্যাহত আছে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম ও দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের কারণে পোলট্রি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আর খামারিদের বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। বাড়তি এই খরচের অনুপাতে লাভ হচ্ছে কিনা, সেই অঙ্ক এখন আর সরল নেই। খামারিরা যখন এই জটিল অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত, তখন মূল্যস্ফীতির চাপে মাংস কেনায় লাগাম টানতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। ফলে মুরগি সঠিক সময়ে বিক্রি নিয়েও দেখা দেয় এক প্রকার অনিশ্চয়তা। তবে এ শিল্পে সবচেয়ে ধোঁয়াশার জায়গা হলো- বাচ্চা মুরগির দামের অস্থিতিশীলতা। কখনো কখনো এর দাম আকাশছোঁয়া। সরকারের পক্ষ থেকে এর একটি নির্দিষ্ট দর বেঁধে দেয়া হলেও তা মানছে না কেউই। ২৫ থেকে ৩০ টাকার উৎপাদন খরচের একটি বাচ্চা ৪০ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই। আবার দেখা যায়, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ৭০ থেকে ৮০ টাকাও বিক্রি হয়। এই অধিক মুনাফা লাভের প্রবণতাও এই শিল্পে সংকটের অন্যতম বড় এক কারণ। তাই তো হতাশায় জর্জরিত প্রান্তিক খামারিরা নিরুপায় হয়ে পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন।
দেশের মোট মাংস উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশই আসে পোলট্রি খাত থেকে। কিন্তু তা এখন ক্রমান্বয়ে নানামুখী সংকটে সংকুচিত হচ্ছে। এই সমস্যার উৎসমূলে অনুসন্ধানী নজর দিলে দেখা যায়- এখানে যেমন খাবার ও মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট বাণিজ্য কাজ করছে, ঠিক তেমনি খামারিদের খামার ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানসম্মত সঠিক জানাশোনার অভাবের বিষয়টিও সুস্পষ্ট। আর সরকারের কথা বললে বলতে হয়- এই খাতে সরকারি তদারকির অভাব যথেষ্ট লক্ষণীয়। না হয় খাবার তৈরির অন্যতম কাঁচামাল সয়ামিলের দেশে যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এ খাতে ব্যবহৃত পণ্যগুলো আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা যায় কিনা, সেটি ভেবে দেখতে হবে। চলমান সংকট নিরসনে দ্রুত পোলট্রি বোর্ড গঠন করে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে, খামারিদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাসহ বিমার আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এ বিকাশমান বিশাল শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়বে। বেকার হয়ে যাবে হাজার হাজার তরুণ উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্টরা। ফলে কালক্রমে পুষ্টি বা প্রোটিনজনিত ঘাটতির কারণে আপামর জনসাধারণের স্বাস্থ্যহানি ও মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। যা জাতীয় জীবনে একটি বড় সংকট হিসেবে উদয় হবে।

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়