উপাচার্য ড. মশিউর রহমান : সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে অপসংস্কৃতি রুখতে হবে

আগের সংবাদ

সংস্কারের বিরূপ প্রভাব বাজারে : আইএমএফের শর্ত মেনে গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে

পরের সংবাদ

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক ছিল

প্রকাশিত: মার্চ ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সত্তরের নির্বাচনের পরে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিলেন, ফেরার পথে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন যে শেখ মুজিবই প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তখন তিনি (ইয়াহিয়া খান) আর থাকবেন না। বলেই হয়তো খেয়াল হয়েছে যে ওই ভয়ংকর সম্ভাবনাকে ঠেকানো দরকার। সেজন্য তিনি করাচিতে নেমেই ভুট্টোর শরণাপন্ন হয়েছেন। সমস্বার্থের চাপে দুই পক্ষ তখন এক পক্ষ হয়ে গেছে। ভুট্টোও তখন বুঝতে শুরু করেছিলেন যে, খোদা না করুন শেখ মুজিব যদি প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে তাকে হয় তার অধীনে মন্ত্রিত্ব নিতে হবে নয়তো বসতে হবে বিরোধী দলের নেতার অস্বস্তিকর আসনে; যে দুটি সম্ভাবনার কোনোটিই তার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। জাতীয় পরিষদে অবাঙালি সদস্যদের তুলনায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল মাত্র ৫৭টি আসনের। তিনি নিশ্চিত ছিলেন না যে সুযোগের সুগন্ধ পেলে তার দল থেকে কিছু লোক চলে যাবে না। সেক্ষেত্রে দর কষাকষির ভিত্তিটা দুর্বল হয়ে পড়বে। ভুট্টো তাই মুজিবকে শত্রæ হিসেবে দাঁড় করিয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। বিপদগ্রস্ত ভুট্টো নানা রকমের উল্টাপাল্টা আওয়াজ তোলা শুরু করলেন। এমনও বলছিলেন, পাকিস্তানে তিনটি রাজনৈতিক দল রয়েছে, আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সামরিক বাহিনী; তাদের মধ্যে মীমাংসা না ঘটার আগে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটানো যাবে না। আর মীমাংসা হবে গণপরিষদের বাইরে, ভেতরে নয়। শেষ পর্যন্ত এমন কথাও তিনি বলেছেন যে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে দুই পাকিস্তানে দুই মেজরিটি পার্টির কাছে। এসব কথা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল; কিন্তু এগুলো তিনি বলেছেন সামরিক বাহিনীর প্রশ্রয়েই। সেনাকর্তাদের তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে আওয়ামী লীগ একটি বুর্জোয়া দল, এদের পক্ষে কোনো জনবিদ্রোহ করা সম্ভব নয়। সেনাকর্তারা শুনেছেন, কারণ তাদের জন্য আশ্বাসের খুব দরকার ছিল। তবে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কটা যে ভালোবাসার ছিল না সেটা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই জানা গেছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ভুট্টো যখন প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর হয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ইয়াহিয়া খানকে গৃহবন্দি করে ফেলেছেন এবং সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই ইয়াহিয়া ও তার সহকর্মীদের ব্যর্থতার তদন্তের জন্য একটি কমিশন বসিয়ে দিয়েছেন।
যুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন ভুট্টো একটি বই লেখেন ‘দি গ্রেট ট্র্যাজেডি’ নাম দিয়ে; সে-বইতে মহবিজ্ঞের মতো তিনি বলেন, তিনি আশা করেন সেনাবাহিনীর লোকেরা আওয়ামী লীগের শহুরে সদস্যদের নিরস্ত্র করার মধ্যেই নিজেদের কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ রেখেছে, গ্রামের মানুষকে ঘাঁটায়নি; কেননা ঘাঁটালে সত্যিকারের বিপদ ঘটবে। তিনি জানতেন না যে সামরিক বাহিনীর পক্ষে গ্রামের মানুষের ওপর অত্যাচার না করে উপায় ছিল না, কারণ শহর গ্রাম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষ তখন হানাদারদের বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। হানাদারেরা অবশ্য কোনো তত্ত্বের পরোয়া করেনি, তারা সরাসরি গণহত্যায় নেমে পড়েছিল।
ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে প্রহসনের সংলাপ যখন চলছিল তখন ভুট্টোর সঙ্গে মুজিবের একবার দেখা হয়। প্রেসিডেন্ট ভবনেই। মুজিব তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এরা কিন্তু আগে আমাকে মারবে, তারপর তোমাকে।’ ভুট্টো নাকি নাটকীয়ভাবে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি সেনাবাহিনীর হাতে মরব তবু ইতিহাসের হাতে মরব না।’ এ খবর তিনি জানিয়েছেন আমাদের, তার ওই বইয়ের মারফত। তা ইতিহাসের জন্য অপেক্ষা করার দরকার পড়েনি, সেনাবাহিনীর হাতেই তো তিনি প্রাণ দিলেন। সেনাবাহিনী কিন্তু শেখ মুজিবের গায়ে হাত দিতে পারেনি, তাদের উৎকণ্ঠা ছিল তাকে জীবিত অবস্থায় বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারবে কিনা তা নিয়ে। নিতে পেরেছিল দেখে আশ্বস্ত হয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান নিজেই তো ততদিনে ভেঙে গেছে। ২৬ মার্চ পাকিস্তানের মৃত্যুদিবস বৈকি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২৬ মার্চ করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে দেয়ার জন্য। সেদিন ভুট্টো কি সত্যি সত্যি ভেবেছিলেন যে গণহত্যা পাকিস্তানকে বাঁচাবে, নাকি তিনি সেনাবাহিনীর তৎপরতা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন? ভেবেছিলেন কি যে ওই রকমের একটি আওয়াজ না দিলে তাকেও ওই ভগ্নস্তূপে নিক্ষেপ করা হবে? নাকি তিনি ইতিহাসজ্ঞান ও বাস্তববুদ্ধি দুটোই হারিয়ে ফেলেছিলেন, ক্ষমতার লোভে? তবে তিনি যে অস্থিরচিত্ত এক জুয়াড়ি ছিলেন তা মোটেই মিথ্যে নয়। অপরিণামদর্শী ও ক্ষমতাভোগী সেনাকর্তাদের অভিসন্ধির বিরুদ্ধে তিনি যদি শেখ মুজিবের সঙ্গে হাত মেলাতেন তবে ইতিহাস কোন গতিপথ বেছে নিত আমরা জানি না, তবে যে গতিপথে এগোচ্ছিল সেটি ধরে হয়তো এগোতো না।
ভুট্টো প্রতারণা কিছু কম করেননি। পঁয়ষট্টিতে আইয়ুব খানকে তিনি উসকানি দিয়েছেন যুদ্ধে নামতে, অভিসন্ধি ছিল তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায় কিনা সেটা দেখা। একাত্তরে ইয়াহিয়া খানকেও একই উসকানি দিয়েছেন, একই অভিসন্ধির তাড়নায়। বলেছিলেন চীন থেকে সাহায্য এনে দেবেন। চীনে গিয়েছিলেনও, কিন্তু যুদ্ধ বাঁধলে চীন তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে এমন কোনো প্রতিশ্রæতি পাননি এবং পাননি যে সে কথাও ইয়াহিয়াকে জানাননি। পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান নিয়াজী তো চীন আসবে আসবে করতে করতেই শেষ হয়ে গেলেন।
ইয়াহিয়া তখন সর্বশক্তিমান; কিন্তু তিনিও যে স্বাধীন ছিলেন এমন নয়। তার চারপাশে যেসব বাজপাখি ওত পেতে বসেছিল তাদের সম্মতির বাইরে পদক্ষেপ করবেন এমন ক্ষমতা তার ছিল না। কোনো কোনো জেনারেলের সঙ্গে উচ্চাকাক্সক্ষী ভুট্টোর যে ঘনিষ্ঠতা ছিল এ খবরও তার অজানা থাকার কথা নয়। ক্ষমতালিপ্সায় জাতীয়তাবাদী ভুট্টো তখন চরমপন্থি। এক পর্যায়ে তো শেখ মুজিবকেই বলে ছিলেন যে ‘তুম উধার আম ইধার’। ভাবটা অনেকটা ১৯৪৬-৪৭-এ অখণ্ড বাংলার হিন্দু মহাসভাপন্থিদের মতো; ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় যারা বাংলাকে দ্বিখণ্ডি করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। ক্ষমতাই যদি না থাকল তা হলে তাতে দেশে থাকলেই বা কি না-থাকলেই বা কি। মহাসভপন্থিরাও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদী।
ইয়াহিয়া খান ওদিকে বিদ্রোহী বাঙালিদের ভয় করতেন, যে জন্য গণহত্যার হুকুম দিয়ে তস্করের মতো পালিয়েছিলেন এবং বলে রেখেছিলেন যে তিনি নিরাপদে করাচি না পৌঁছার আগে যেন হত্যাকাণ্ড শুরু না করা হয়। তারপর ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই তিনি যুদ্ধে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তখন তিনি এমনকি নিজের দপ্তরে আসাও পছন্দ করতেন না; দুঃখকে ডুবিয়ে মারার জায়গা-জমিন খুঁজতেন। একবার তো রটেই গিয়েছিল যে সেনাপ্রধান আবদুল হামিদ খান ক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন। সাবধানতার প্রয়োজনে হামিদ খানকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাখাটাই পছন্দ করতেন।
শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, বলেছিলেন তাকে শাস্তি না দিয়ে ছাড়বেন না এবং হুঙ্কার দিয়েছিলেন এক ইঞ্চি ভূমিও ছেড়ে দেয়া হবে না। শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই করতে পারলেন না; হামুদুর রহমান কমিশন তার ব্যাপারে তদন্ত করল, তাকে কোর্ট মার্শাল করা দরকার বলে জানাল, কিন্তু কোর্ট মার্শাল হলো না, সেনাবাহিনীর চাপেই হবে। তাছাড়া ক্ষমতায় এসে ভুট্টো তখন নানা ধান্দায় ব্যস্ত আছেন, ভারতে-আটক ৯০ হাজার সৈনিক ফেরত আনা, বাংলাদেশ যে ১৯৫ জনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে বিচারের জন্য ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাচ্ছে তাদেরকে রক্ষা করা, এসবের মোকাবিলা করা সহজ ছিল না। ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিচার করতে গেলে ভুট্টোর নিজের সংশ্লিষ্টতাও বেরিয়ে পড়বে, এমন ভয়ও যে ছিল না তা তো নয়। খুবই ছিল। ইয়াহিয়া খানরা তাই বিচারের হাত থেকে বেঁচে গেলেন, নইলে শেখ মুজিবের পরিবর্তে তারাই রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হতেন। কারণ আঘাত তারাই প্রথমে করেছেন এবং তার প্রতিক্রিয়াতে রাষ্ট্র ভেঙে গেছে। বোঝা গেছে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ জিনিসটা কেমন কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক ছিল এবং তার সশস্ত্র রক্ষকরা কতটা অন্ধ, মূর্খ ও হৃদয়হীন ছিল। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ঘূর্ণিপাকে পড়ে সাতচল্লিশে কত মানুষ যে চরম দুর্ভোগ সহ্য করেছে তার হিসাব নেই; একাত্তরে তারই প্রকোপে আবার কতজন কী যন্ত্রণা সহ্য করল তারও হিসাব করা সম্ভব হবে না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়