উপাচার্য ড. মশিউর রহমান : সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে অপসংস্কৃতি রুখতে হবে

আগের সংবাদ

সংস্কারের বিরূপ প্রভাব বাজারে : আইএমএফের শর্ত মেনে গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে

পরের সংবাদ

খালেদা জিয়াকে নিয়ে চাণক্যের চাল চাললেন আইনমন্ত্রী?

প্রকাশিত: মার্চ ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

খালেদা জিয়া কি রাজনীতি করতে পারবেন? তিনি কি কারাভোগ করছেন? না গৃহবন্দি? না মুক্ত? এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতির অন্দরমহলে। আর এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যকে ঘিরে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নিম্ন আদালতের বিচারকদের এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না তার সাজা স্থগিতের ক্ষেত্রে এমন কোনো শর্ত ছিল না।’ আইনমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই তিনি (খালেদা জিয়া) একজন স্বাধীন মানুষ। তিনি কী করবেন সেটা আমার বলে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।’ আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর খালেদা জিয়া কেন্দ্রিক রাজনীতি নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে। সরকার যেখানে খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও যেতে দিচ্ছে না, চিকিৎসার নামে বিদেশ যাওয়ার আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যান করছে, সেখানে হঠাৎ করে কেন তিনি রাজনীতি করতে পারবেন কি না এমন প্রসঙ্গ এলো! সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশের পর নানা কানাঘুষা চলছে। বিএনপি নেতারা সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন, সরকারের এটা নতুন কোনো চাল কি না! ঝানু আইনজীবী থেকে ঝানু রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের এই বক্তব্যকে কেউ কেউ চাণক্যের চাল বলে মন্তব্য করেছেন। প্রায় ৫ বছর ধরে অন্তরীণ খালেদা জিয়াকে নিয়ে এখন এমন প্রশ্ন উঠল কেন? এ নিয়ে জল্পনার শেষ নেই রাজনৈতিক অঙ্গনে।
একটু পেছনে ফেরা যাক। সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই দণ্ডাদেশ দেন। ওইদিনই তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে। অনেকটা নির্জন কারাগারে, সঙ্গে দেয়া হয় তার একজন গৃহকর্মী ফাতেমাকে। প্রচলিত আইন বা জেলকোডে কোথাও একজন দণ্ডিতের সঙ্গে বিনা অপরাধে আরেকজনের কারাভোগের নজির ইতিহাসে আর আছে বলে মনে হয় না। খালেদা জিয়ার এই দণ্ডের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয় এবং দুই আদালতই তার আপিল খারিজ করে দেন। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিচারিক আদালত খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং মামলার অপরাপর আসামি তারেক রহমানসহ অন্যদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও জরিমানা করেছিলেন। পরে বিচারিক আদালত মামলার প্রধান আসামি হিসেবে খালেদা জিয়ার ৫ বছরের কারাদণ্ড কম হয়েছে এমন যুক্তি দেখিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদক হাইকোর্টে দণ্ড বাড়ানোর আবেদন করেন। অন্যদিকে খালাস চেয়ে খালেদা জিয়ার পক্ষেও আবেদন জানানো হয়। শুনানি শেষে হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার আবেদন খারিজ করে দেন এবং দুদকের আবেদন গ্রহণ করেন, বিচারিক আদালতের রায় সংশোধন করে খালেদা জিয়ার দণ্ড ১০ বছর বাড়ানো হয়। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। ফলে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হয় ১০ বছর। প্রায় দুই বছর কারাগারে থাকার পর সরকার ২০২০ সালের ২৪ মার্চ আকস্মিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা ৬ মাসের জন্য স্থগিত করে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওইদিন আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলন করে জানান, সরকার খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়ার সাজা ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেছে। শর্ত ছিল দুটি। প্রথমটি খালেদা জিয়া বাসায় অবস্থান করবেন এবং দ্বিতীয়টি তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। এই দুই শর্তে ২৫ মার্চ (২০২০) খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে মুক্ত হন এবং তিনি তার গুলশানের বাসায় অবস্থান করেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতা বলে সরকার খালেদা জিয়ার সাজা ৬ মাসের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ফৌজদারি কার্যবিধির এই ক্ষমতা প্রয়োগের এখতিয়ার একান্তই সরকারের। সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। এই প্রক্রিয়ায় আমরা দেখলাম খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে আসে মতামতের জন্য। মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করে। এরপর প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
এবার আমরা দেখে নিই ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় কী রয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, (১) কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয়, সেই শর্তে তার দণ্ড কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারবেন। (২) যখন কোনো দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়, তখন যে আদালত উক্ত দণ্ড দিয়েছিলেন বা অনুমোদন করেছিলেন, সেই আদালতের প্রিসাইডিং জজকে সরকার উক্ত আবেদন মঞ্জুর করা উচিত কিংবা মঞ্জুর করতে অস্বীকার করা উচিত, সে সম্পর্কে তার মতামত ও মতামতের কারণ বিবৃত করতে এবং এই বিবৃতির সঙ্গে বিচারের নথির নকল অথবা যে নথি বর্তমানে আছে, সেই নথির নকল প্রেরণ করার নির্দেশ দেবেন। (৩) যেসব শর্তে কোনো দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করা হয়েছে, তার কোনোটি পালন করা হয়নি বলে মনে করলে সরকার স্থগিত বা মওকুফের আদেশ বাতিল করবেন এবং অতঃপর যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত রাখা কিংবা মওকুফ করা হয়েছিল, সে মুক্ত থাকলে যে কোনো পুলিশ অফিসার তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন এবং তার দণ্ডের অনতিবাহিত অংশ ভোগ করার জন্য তাকে জেলে প্রেরণ করা যাবে। (৪) সেই শর্তে এই ধারার অধীন দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয়, যা যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয়, সেই ব্যক্তি পূরণ করবে অথবা শর্ত এমন হবে যা পূরণে সে স্বাধীন থাকবে। (৪ক) এই বিধি বা অন্য কোনো আইনের কোনো ধারা অনুসারে কোনো ফৌজদারি আদালত কোনো আদেশ দান করলে তা যদি কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করে অথবা তার বা তার সম্পত্তির ওপর দায় আরোপ করে, তা হলে উপযুক্ত উপধারাসমূহের বিধান এই আদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। (৫) প্রেসিডেন্টের অনুকম্পা প্রদর্শন, দণ্ড স্থগিত রাখা বা কার্যকরীকরণের বিলম্ব ঘটানো বা মওকুফ করার অধিকারে এই ধারার কোনো কিছু হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে করা যাবে না।
(৫ক) প্রেসিডেন্ট কোনো শর্তসাপেক্ষ ক্ষমা মঞ্জুর করলে উক্ত শর্ত যে প্রকৃতিরই হোক না কেন, তা এই আইন অনুসারে কোনো উপযুক্ত আদালতের দণ্ড দ্বারা আরোপিত শর্ত বলে গণ্য হবে এবং তদানুসারে বলবৎ যোগ্য হবে। (৬) সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রাখা এবং দরখাস্ত দাখিল ও বিবেচনার শর্তাবলি সম্পর্কে নির্দেশ দিতে পারবেন। উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে সরকার দুটি শর্তেই খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ৪০১(১) ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। এর দুটি শর্ত হলো খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যেতে পারবেন না এবং দেশের যে কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন। এর সঙ্গে খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না এমন কোনো মুচলেকা নেই বা ছিল না। সরকার থেকেও এমন কোনো শর্ত দেয়া হয়নি। ফলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যা বলেছেন সেটাই সত্য। এ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের কিছু নেই।
এখন প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে খালেদা জিয়ার রাজনীতি প্রসঙ্গটাইবা এলো কেন? আর আইনমন্ত্রীই বা এটা সামনে আনলেন কেন? এর পেছনেও হয়তো রাজনীতির কোনো কৌশল রয়েছে। আসলে রাজনীতিতো কৌশলেরই খেলা। বিএনপি এখন নেতৃত্বের চরম সংকটে রয়েছে। তারেক রহমানও দণ্ডিত আসামি। এ অবস্থায় বিএনপির মূল নেতা কে এ নিয়ে চরম শূন্যতা রয়েছে। খালেদা জিয়ার বর্তমান অবস্থানটা কী? এ নিয়ে কথা বলেছিলাম কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। তারা বলছেন খালেদা জিয়া দণ্ডিত এবং সরকারের অনুকম্পায় শর্তসাপেক্ষে তার সাজা স্থগিত রাখা হয়েছে। তিনি নিজ গৃহে অবস্থান করছেন তবে গৃহবন্দি বলা যাবে না আবার বলাও হয়তো যায়। কারণ সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি আবার তার বাসভবনকে সাবজেলও ঘোষণা করেনি। কিন্তু বাসার চারদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রয়েছে কঠোর পাহারা। যে দুই শর্তে সরকার তার সাজা স্থগিত করেছে এই শর্তের কোনো ব্যত্যয় ঘটালে সরকার ফের তাকে কারাগারে নিয়ে যেতে পারবে। অর্থাৎ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর ৩ উপধারা প্রয়োগ করতে পারবে। ফলে শাঁখের করাতের মধ্যে আছেন খালেদা জিয়া। বয়স ও অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়া অনেকটাই চলৎশক্তিহীন। তিনি চাইলেও দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন না। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তাদের মধ্যেও রয়েছে তীব্র বিরোধ। শীর্ষ নেতারাও এ বিরোধে জড়িত। এছাড়া আগামী নির্বাচন নিয়ে রয়েছে নানামুখী চাপ। বিএনপি বলছে বর্তমান সরকার পদত্যাগ না করলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। আবার জাতিসংঘসহ ইউরোপীয় ও পশ্চিমা দেশগুলো চাচ্ছে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সরকার হয়তো কিছুটা ছাড় দেবে। বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করলে সরকার হয়তো বাধা দেবে না। আর এ ক্ষেত্রে কোনো কর্মসূচিতে যদি খালেদা জিয়াকে হাজির করার দরকার হয় সরকার হয়তো গ্রিন সিগন্যাল দেবে। আর বলবে, দেখেন খালেদা জিয়াও জনসভায় অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে রাজনীতিতে নানা রঙের খেলানেলা হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

শংকর মৈত্র : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়