উপাচার্য ড. মশিউর রহমান : সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে অপসংস্কৃতি রুখতে হবে

আগের সংবাদ

সংস্কারের বিরূপ প্রভাব বাজারে : আইএমএফের শর্ত মেনে গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে

পরের সংবাদ

ই-টিকেটের নামে ‘ফাঁকিবাজি’ : টিকেট দিতে অনীহা কন্ট্রাকটরের, টিকেটের বিষয়ে যাত্রীরাও উদাসীন, মনিটরিং ব্যবস্থা অপ্রতুল

প্রকাশিত: মার্চ ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেব দুলাল মিত্র : গণপরিবহনে ই-টিকেট পদ্ধতি চালু হওয়ার এক মাসের মধ্যেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। কাগজে-কলমে ই-টিকেট ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তব চিত্র পুরোপুরি আলাদা। বাসের অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়নি। ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছেই। ই-টিকেটের আওতায় আসা নগরীর অর্ধেকের বেশি বাসে ভাড়া নিয়ে মেশিন থেকে সমমূল্যের টিকেট যাত্রীর হাতে দিতে পরিবহন শ্রমিকদের প্রবল অনীহা দেখা গেছে। যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করার প্রবনতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে বাকবিতন্ডা ও হাতাহাতি পর্যন্ত হচ্ছে। ই-টিকেট পদ্ধতি চালুর সময় পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বিষয়টি নিয়ে সমিতির পক্ষ থেকে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকার কথা জানালেও বাস্তবে তা অপর্যাপ্ত।
তবে পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন, বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকাতে ই-টিকেট পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। শুরুতেই সব শতভাগ সফল হয় না; তবে আমরা হাল ছাড়ছি না। মনিটরিং ব্যাবস্থা আরো জোরদার করতে ৫ মার্চ থেকে নেতারা রাস্তায় নামবেন।
সরজমিনে নগরীর বিভিন্ন রুটে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ বাসের কন্ট্রাকটরের হাতে ই-টিকেটের মেশিন থাকে না। মোহাম্মদপুর-খিলগাও রুটের মিডলাইন পরিবহন, মোহাম্মদপুর-ধুপখোলা রুটের মালঞ্চ পরিবহনের বাসের কন্ট্রাকটরের কাছে ই-টিকেটিং মেশিন দেখা যায় না। টিকিট না দিয়েই যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
ফিরোজ হোসেন ধানমন্ডির শংকর বাসস্ট্যান্ড থেকে মিডলাইন পরিবহনের বাসে ওঠেন। পল্টন যাওয়ার জন্য ২০ টাকা ভাড়া দেন। কন্ট্রাকটর টাকা নিয়ে চলে যায়। টিকিট চাইলেও যাত্রীকে টিকিট না দিয়ে কন্ট্রাকটর কামাল জানান, ‘মালিকরা মেশিন আবার জমা নিয়ে গেছে’। বিভিন্ন সময়ে একই অবস্থা দেখা গেছে রমজান পরিবহন ও মালঞ্চ পরিবহনের বাসে। তরঙ্গ পরিবহনের কোনো বাসে কন্ট্রাকটরদের টিকিট দিতে আগ্রহ দেখা যায়নি। মোহাম্মদপুর থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত অন্য বাসে ২০ টাকা ভাড়া নেয়া হলেও তরঙ্গ ও রমজান পরিবহনের বাসে ২৫ টাকা রাখা হচ্ছে। বিকাশ পরিবহন, শিকড় পরিবহন, প্রজাপতি পরিবহন, বাহন পরিবহনের বাসেও ই-টিকেট পদ্ধতির সুফল মেলেনি। মালিক সমিতির কাছেও অভিযোগ রয়েছে। এসব বাসের মালিকরা তাদের গাড়িটি এখনো দৈনিক চুক্তিতে বাস চালক ও কন্ট্রাকটরের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

টিকেট না দিয়েও কন্ট্রাকটররা সব রুটের যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করে নিচ্ছেন। বাসগুলোতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সরবরাহ করা ভাড়ার নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী ভাড়া নেয়া হয় না। ই-টিকেটে স্থান ও ভাড়ার টাকা নিদিষ্ট করে লেখা থাকলেও এক স্থান থেকে অন্য স্থানের দুরত্ব উল্লেখ নেই। এক কিলোমিটার যেতেও ১০ টাকা নেয়া হচ্ছে, আবার আরো বেশি দুরত্বে যেতেও ১০ টাকা নেয়া হচ্ছে। মোহাম্মদপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা। আবার টাউনহল থেকে আসাদগেট পর্যন্ত স্বল্প দূরত্বের ভাড়াও ১০ টাকাই নেয়া হচ্ছে। হাফ কিলোমিটার দূরত্বের ভাড়া কেন ১০ টাকা নেয়া হবে- তা নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কন্ট্রাকটরের বাকবিতন্ডা থেকে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। রাজধানীর অন্য রুটেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে।
কলেজ শিক্ষার্থী ইসরাত ইয়াছিন নিলয় জানান, লাব্বাইক অথবা লাভলী পরিবহনের বাসে মৌচাক থেকে মগবাজার যেতে তাকে ১০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। অথচ বাসাবো থেকে এসব পরিবহনে কাওরানবাজার পর্যন্ত নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা। শিক্ষার্থীদের হাফভাড়ায় চলাচলের অনুমোদন থাকলেও পরিবহন শ্রমিকরা ১০ টাকার ভাড়া হাফ নিতে নারাজ। এই নিয়েও পরিবহন শ্রমিকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে।
আজিমপুর থেকে মিরপুর রুটের বেশিরভাগ বাসে ই-টিকেট পদ্ধতিতে ভাড়া নেয়া হচ্ছে না। ‘মিরপুর সুপার লিংক’ পরিবহনের বাসে আজিমপুর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত টিকেটে লেখা ভাড়া ২৩ টাকা। আবার কলাবাগান থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। এই অল্প দূরত্বের ভাড়া কেন ২৫ টাকা- তা নিয়ে হাতাহাতির ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বাস কন্ডাকটররা এভাবেই টিকিট না দিয়ে ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে পরিবহন মালিক সমিতি একসময় ‘ওয়েবিল’, ‘সিটিং সার্ভিস’ ও ‘গেইটলক সার্ভিসের’ নামে দীর্ঘদিন ভাড়ার নৈরাজ্য চালিয়ে বেশি ভাড়া আদায় করে নেয়। বিআরটিএ বা সরকারের কোনো সংস্থার এতে অনুমোদন ছিলো না। দীর্ঘদিন ব্যাপক সমালোচনার পর চলতি বছরের প্রথম দিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ এক সংবাদ সম্মেলনে এসব পদ্ধতি না থাকার ঘোষনা দেন। কিন্তু বিভিন্ন সড়কে এখনো ‘ওয়েবিল’ পদ্ধতি বহাল রেখে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে পরিবহন শ্রমিকরা।
জানা গেছে, সড়ক ও গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করতেই ২০১২ সালে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) বাসে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) র‌্যাপিড পাসের মাধ্যমে ই-টিকিট দিয়ে ভাড়া আদায় করে। কিন্তু এই ব্যবস্থা সফল হয়নি। দ্বিতীয় দফায় গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা সড়ক পরিবহন বাস মালিক সমিতি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন রুটের আটটি কোম্পানির দেড় হাজার বাসে ই-টিকিট চালু করে। এরপর ১৩ নভেম্বর থেকে মিরপুর অঞ্চলের ৩০টি কোম্পানির দেড় হাজার বাস ই-টিকিটিংয়ের আওতায় আসে। পরবর্তীতে ১০ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর থেকে ১৫টি রুটে ই-টিকিট ব্যবস্থা চালু হয়। এরপর বিভিন্ন রুটের বাসে ই-টিকেটিংয়ের মাধ্যমে ভাড়া আদায় শুরু হয়। এই রুটে বাসের সংখ্যা ৭১১টি। বর্তমানে সবমিলিয়ে মোট ৫৯টি রুটে ই-টিকেট পদ্ধতি চালু থাকলেও সফলতা খুবই নগণ্য।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া নেয়া বন্ধ করতেই আমরা ই-টিকেট পদ্ধতি চালু করেছি। ৪৫টি কোম্পানির ৭০ থেকে ৭৭ শতাংশ বাসে ই-টিকেট কার্যকর হয়েছে। অনেক বাসই অনিয়ম করছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে। আমরাও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনিয়ম মনিটরিংয়ের জন্য ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির ৯টি ভিজিল্যান্স টিম প্রতিদিন সড়কে কাজ করছে। এ ছাড়া সমিতির পক্ষ থেকে নিয়োগ দেয়া ৯ জন স্পেশাল চেকার প্রতিদিন সড়কে মনিটরিং করছে। আরো ১০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, কোনো কাজ শুরুতেই শতভাগ সফল হয় না, তবে আমরা হাল ছাড়ছি না। দীর্ঘদিনের ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকাতে আরো সময়ের প্রয়োজন। মনিটরিং ব্যাবস্থা আরো জোরদার করতে ৫ মার্চ থেকে আমি নিজেই রাস্তায় নামবো। এক সময় গেইট লক, সিটিং সার্ভিস ও ওয়েবিল পদ্ধতি চালু ছিলো। আমাদের চেষ্টার ফলে এখন তা আর নেই। ই-টিকেট নিয়েও সব অনিয়ম আমরা দূর করবো। এজন্য যাত্রীদেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদেরকে সমমূল্যের টিকেট চেয়ে নিতে হবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, শ্রমিকরা মালিকের সঙ্গে দৈনিক চুক্তির ভিত্তিত্বে বাস চালায়। প্রথমেই সব পরিবহন শ্রমিককে মাসিক বেতনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু লিজ সিস্টেম চালু রেখে ভালো উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতিতে যেতে হবে। ফ্র্যাঞ্জাইজি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে সড়কে অসম প্রতিযোগিতা থাকবে না, বেশি ভাড়াও আদায় হবে না এবং সড়কে বিশৃঙ্খলার অবসান হবে। রাজধানীর বর্তমান পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ই-টিকেট পদ্ধতিতে শতভাগ সফলতা আসবে না। এধরনের ব্যবস্থা চালু করার আগে চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। হাতিঝিল ও গুলশান বড় উদাহরন হয়ে আছে। সব যাত্রীকে ই-টিকেট দেয়া হলে শ্রকিদের পকেটে টাকা যাবে না। সব টাকা তারা মালিককে তুলে দেয়ার মতো মানসিকতায় এখনো আসতে পারেনি, কারণ তারা এখনো মাসিক বেতনে কাজের সুযোগ পাচ্ছে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দেশ উন্নত হচ্ছে কিন্তু পরিবহন খাত নৈরাজ্যের মধ্য দিয়েই চলছে। বাস চুক্তিতে চললে ভাড়া নির্ধারণের শর্ত মানা হবে না। চুক্তিতে চললে গণপরিবহনের শৃঙ্খলা, অসম প্রতিযোগিতা ও ভাড়ার নৈরাজ্য কখনোই বন্ধ হবে না। নৈরাজ্য দূর করতে হলে প্রথমে চালক ও তার সহকারীর মাসিক বেতন ভিত্তিক নিয়োগ এবং কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করতে হবে। এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। চাঁদাবাজি ও চুরি বন্ধ করতে হবে। ই-টিকেটিং চালু থাকলে এগুলো সম্ভব হবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়