মহাখালীতে অভিযান : তিন রেস্টুরেন্টকে তিন লাখ টাকা জরিমানা

আগের সংবাদ

শ্রমবাজারে সম্ভাবনার হাতছানি : সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় সংকট দেখা দিলেও ইউরোপে সম্ভাবনার হাতছানি

পরের সংবাদ

ভয়াবহ ক্ষমতার অপরাধ বিলাস এবং একটি সংবাদপত্র প্রসঙ্গ

প্রকাশিত: মার্চ ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাষ্ট্রের মুদ্রণ ও প্রকাশনা আইন লঙ্ঘন করার অপরাধে ঢাকার একটি সংবাদপত্র ছাপার অনুমতি বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মিথ্যা তথ্যসহ বিভিন্নমুখী আলাপ-আলোচনা চলছে। এ নিয়ে দুটি সংবাদ মাধ্যমে, আল-জাজিরা এবং দ্য গার্ডিয়ান রিপোর্ট করেছে। দুটি রিপোর্টই এজেন্সি ফ্রান্স-প্রেসের (এএফপি) বরাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই রিপোর্ট দুটিতে ১৯৭৩ সালের যে আইনে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল হয়েছিল তার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
আবার জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও এ সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এসব রিপোর্টে বা বক্তব্যে ‘রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন’ করা অপরাধ কি না (?), সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। মন্তব্য একটাই করা হয়েছে, আর তা হলো ‘বিরোধী মতামত’ প্রকাশে বাধা দেয়া হচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০২ সালে দৈনিক দিনকালের প্রকাশক তারেক রহমান ১৯৭৩ সালের আইনের নির্দিষ্ট ধারা অনুসারে যে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন সেই আইন অনুসরণ করেই ডিক্লারেশন বা ঘোষণাপত্রটি ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাতিল করেছেন। ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিবর্গ প্রেস আপিল বোর্ডে আপিল করেছিলেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে ও বিবেচনা করে আপিলটি খারিজ করে দেয় প্রেস আপিল বোর্ড।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিদেশি দুটি গণমাধ্যমের উল্লেখিত রিপোর্ট পড়ে মনে হতে পারে যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন থাকতে নেই! সবকিছু এই সংবাদ পরিবেশনকারীরা এবং যাদের সূত্রে এই সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে তারাই ঠিকঠাক করে দেবেন! অথচ ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দের ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তি অনুসারে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত। এমনকি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং টিকে আছে সদস্যরাষ্ট্রগুলো কর্তৃক পরস্পরের সার্বভৌত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা সংক্রান্ত ওয়েস্টফেলীয় চেতনার প্রতি সম্মতি অনুসারে।
বাংলাদেশের ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন ১৯৭৩-এর যথাক্রমে ১০, ১১, ১৬, এবং ২০(১)(খ) ধারা লঙ্ঘন করায় ঘোষণাকৃত বাংলা দৈনিক ‘দৈনিক দিনকাল’ পত্রিকার প্রকাশকের নামে বিগত ১৬/০৪/২০০২ তারিখে ৭২/২০০২ নং নিবন্ধনমূলে প্রদানকৃত পত্রিকাটির ঘোষণাপত্র (ফরম বি) এবং পত্রিকা মুদ্রণের ঘোষণাপত্র ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাতিল করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের প্রেস আপিল বোর্ডও বাতিলের এই আদেশ বহাল রাখেন।
ক্ষমতা এবং সংবাদপত্র দুটিই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের পরিচালনাকারী অনুষঙ্গ। ক্ষমতার প্রয়োজনে ক্রিয়াশীল থাকে রাজনীতি। আর এই ক্রিয়াশীলতার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান বা মাধ্যম হচ্ছে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম। মানবজাতির জন্য রাজনীতি একটি মৌলিক বিষয়। রাজনীতি ও ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন সংবাদপত্র। রাজনীতি ও ক্ষমতা সবই ক্রিয়াশীল থাকে রাষ্ট্রে। রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সভ্য সমাজে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন আইন-কানুন, নিয়ম ও শৃঙ্খলা। সংবাদপত্র ও ছাপাখানার জন্যও প্রয়োজন আইন। বাংলাদেশের ‘ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণাপত্র ও নিবন্ধিকরণ) আইন, ১৯৭৩-এর ১১ ধারার বিধান মোতাবেক যদি কোনো ঘোষণা প্রদানকারী, মুদ্রাকর বা প্রকাশক ঘোষণা প্রদান করিয়া বাংলাদেশ ত্যাগ করেন তাহা হইলে উক্ত ঘোষণা বাতিল হইয়া যাইবে। যদি না অত্র আইনে ১১(ক) ধারা মতে বাংলাদেশ হইতে উক্ত মুদ্রাকর বা প্রকাশকের অনুপস্থিতির মেয়াদ অনূর্ধ্ব ০৬ মাস হয়।’ দৈনিক দিনকালের ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী তারেক রহমানের দেশান্তর তথা অনুপস্থিতির মেয়াদ অনেক আগেই ৬ মাস অতিক্রম করেছে! আইনের এই ধারা সম্পর্কে এমনকি বিএনপিরও কোনো বিরোধিতা নেই। এমনকি ২০০২ সালে যখন জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল এবং সরকারের সমান সমান বা তার চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান এক্সট্রা-কনস্টিটিউশনাল কর্মক ‘হাওয়া ভবন’ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত (?) তখনই কিন্তু ১৯৭৩ সালের ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন মান্য করে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন তারেক রহমান। ৪৪১/১ তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি পাবলিশিং হাউস কাকরাইল ঢাকা থেকে ২০০২ সাল থেকে মুদ্রিত হওয়া দৈনিক দিনকালে স্বাক্ষরকারী তারেক রহমানের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ‘সরকারের বা রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থি বা কোনো আপত্তিকর বিষয়ে উক্ত ছাপাখানা মুদ্রণে বিরত থাকিবে এবং ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধিকরণ) আইন, ১৯৭৩-এর নিয়মাবলি মানিয়া চলিতে বাধ্য থাকিবে।’ অথচ এখন কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এখনো কি তাহলে এক্সট্রা-কনস্টিটিউশনাল ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনীতি করা হবে (?), যেমনটি ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত হাওয়া ভবনের মাধ্যমে করা হতো!
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সরকার ছিল তাদের কর্মকাণ্ডের ভয়াবহতা স্মরণ করলে এ দেশের মানুষ এখনো আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। জামায়াত-বিএনপি জোটের সরকার কর্তৃক সংঘটিত এসব ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতমগুলো হচ্ছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ১৭ আগস্ট সমগ্র বাংলাদেশের ৫০০ স্থানে একযোগে বোমা হামলা করা, ভারত অভিমুখে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান, সমগ্র বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের হত্যা প্রভৃতি কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রধান কেন্দ্র ছিল ‘হাওয়া ভবন’। তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ‘ক্লিপ্টোক্র্যাট্রিক সরকার এবং সহিংস রাজনীতির’ প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করে, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস তখন এমনকি তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা দেয়ার সুপারিশ করেছিল। প্রকাশিত হওয়া মার্কিন দূতাবাসের একটি কেবল বার্তায় বলা হয়েছে, দূতাবাস বিশ্বাস করে যে তারেক ‘ভয়াবহ রাজনৈতিক দুর্নীতির জন্য দোষী যা মার্কিন জাতীয় স্বার্থের ওপর মারাত্মক প্রতিকূল প্রভাব ফেলেছে’। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা এবং মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা লক্ষ্যগুলোর ওপর, তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি, ৩ নভেম্বর, ২০০৮-এ গোপন কেবলটি ওয়াশিংটনে পাঠান এবং উইকিলিকস ২০১১ সালের ৩০ আগস্ট এটি প্রকাশ করে। মরিয়ার্টি তারেকের বড় দুর্নীতির কয়েকটি উদাহরণ উদ্ধৃত করেছিলেন, কারণ তিনি তারেকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে তার উদ্বিগ্ন ছিলেন।
তারেক রহমান ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন। মরিয়ার্টির সুপারিশের প্রায় ছয় মাস পর, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসি তারেকের বিষয়ে ওয়াশিংটনে আরেকটি কেবল পাঠান। এটি বলেছে যে স্টেট ডিপার্টমেন্ট রাষ্ট্রপতির ঘোষণার অধীনে তার জন্য ভিসা প্রত্যাহার করার জন্য একটি নোট বিবেচনা করছে।
২০০১-২০০৬ সালে তারেকের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করে মরিয়ার্টি লিখেছিলেন, ‘তারেকের এই অপকর্ম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে।’ আজ থেকে ১৭ বছর আগে তারেক রহমান সম্পর্কে মরিয়ার্টির করা মন্তব্য ২০২৩ সালেও প্রযোজ্য নয় কী?
ঢাকায় সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির করা মন্তব্য ছিল, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ঘুষ, আত্মসাৎ এবং দুর্নীতির সংস্কৃতি তৈরি করতে এবং বজায় রাখতে সহায়তা করেছে…।’ সবই করা হয়েছিল এবং এবং এখনো করা হচ্ছে ‘ক্ষমতার’ জন্য। আর ক্ষমতার জন্য করা এসব অপকর্মের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। উন্নয়নের পথে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের চলমান উজ্জ্বল ভাবমূর্তিতে যা কালিমা লেপন করছে! আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘এটি স্পষ্ট, সেই সরকারই সর্বোত্তম যেখানে প্রতিটি মানুষ, সে যেই হোক না কেন, সর্বোত্তম আচরণ করতে পারে এবং সুখে জীবনযাপন করতে পারে।’ ২০০১-২০০৬-এর বিভীষিকাময় দিনগুলো যেন ফিরে না আসে।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়