ফারুক মাহমুদ : মেলায় এখন প্রিয় মানুষদেরই খুঁজে পাই না

আগের সংবাদ

মূল্যস্ফীতি-ডলার সংকটই চ্যালেঞ্জ > ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এক বছর : আমদানিনির্ভর সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী

পরের সংবাদ

ধঅবনিতা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শুক্রবার সকাল বেলা। আমার এক হাতে চল্লিশ সাইজের দুখান এপেক্স সু। অন্য হাতে বগলদাবা করে নেয়া দশাধিক জামাকাপড়। কাজ হলো জুতা দুখান মুচির দোকানে রেখে, জামাকাপড় লন্ড্রিতে দিয়ে আমি বসে পড়ব সেলুনের দোকানে। গালভর্তি দাড়িগোঁফে। এমনকি মাথার চুলগুলোতে ইচ্ছা করলে রাবারে প্যাঁচানো যায়। এজন্য নরসুন্দরের ওখান থেকে নিজে পরিষ্কার হয়ে, ইস্ত্রি করা জামাকাপড় আর মুচির দোকানের কালি করা জুতা নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে।
হঠাৎ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। এই মুহূর্তে মোবাইল রিসিভ করা যে কতটা বিরক্তিকর, তা আমার মতো ভুক্তভোগীরা শুধু জানেন। আমি হাতের জুতা দুখান রাস্তার একপ্রান্তে রেখে ফোনটা ধরলাম।
– বন্ধু, কেমন আছো?
– কেমন আর আছি? ছোটবেলা থেকে বিরক্ত করার সময়টা আর তুই ভুলতে পারলি না।
– কেন? কী হয়েছে? ঘরে তো বউ নাই। বিশেষ কোনো সময়ও তো তোর থাকার কথা না।
– ধুর শালা ফকির কোথাকার। আমার এক হাতে জুতা আছে। আয় দুইটা চটকানি দিয়ে দেই। অন্য হাতে একগাদা কাপড়চোপড়। লন্ড্রিতে যাচ্ছি।
– বন্ধু, তুই সাতক্ষীরা ডেয়ারিতে একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি।
– ঢাকা থেকে ফিরলি কবে?
– এই তো গাড়ি থেকে এখনো নামতে পারিনি। তুই পাঁচ মিনিট দাঁড়া। আমি দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসব। হাহাহা।
ফোনটা কেটে দিল। ফকির কোথাকার।
ফোনটা ছিল বন্ধু সেফায়েত ফকিরের। ও এখন ঢাকার একটা বেসরকারি এয়ারলাইন্সে জব করে। টাকা-পয়সায় সে যেন ফুলে-ফেঁপে উঠছে। ওকে এই মুহূর্তে ফকির বলাটা আমার সত্যিই ভুল হয়েছে। আমি ফোনটা পকেটে রাখতে না রাখতেই দেখি, একটু দূরে বসে আমার এক পাটি জুতা কামড়াচ্ছে একটা বাচ্চা কুকুর। ওকে অন্য জুতাটা দেখিয়ে তেড়ে আসতেই জুতা ফেলে দিল দৌড়।
সাতক্ষীরার ঘোষ ডেয়ারিতে ঢুকতেই চোখে পড়ল, সাড়ে পাঁচ ফিটের উপরে লম্বা সুশ্রী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। কাপড়চোপড়গুলো রাখলাম হাঁটুর উপরে। হাতের জুতাজোড়া রাখলাম টেবিলের কর্নারে। এরই মধ্যে ডেয়ারির একটা ছেলে আমাকে এক প্লেট দই দিয়ে গেল। বলা নাই, কওয়া নাই, অর্ডার নাই- তবুও ওর দই দেয়া দেখে আমি একটুও বিচলিত হলাম না। কারণ আমি এখানে মাসে অন্তত দুবার আসি। ওদের বলতে হয় না। ওরা আমাকে এক প্লেট দই দেয়। এখানে কাপদইও রয়েছে। ওটা দেয় না। আমি দই খেয়ে বিল মিটিয়ে প্রতিনিয়ত চলে যাই।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- নিজের সইলেও প্রতিবেশীর সয় না। জানি না এই প্রবাদটি কী কারণে তৈরি হয়েছিল। আমি অকপটে খাচ্ছি দেখে ওই লম্বা মেয়েটা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো সে হিসাবে মেলাতে পারছে না। নয়তো ভাবছে আমি ওর বাপের টাকায় খাচ্ছি। নতুবা অন্য কিছু। আমার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে আমিও তার আপাদমস্তকে আরো একবার চোখ বুলাতে গেলেই সে মুখ ফিরিয়ে নিল। ওড়নাটা এঁটেসেঁটে টেনে ঠিক করে নিল। মেয়েদের ওড়না পরা দেখে আমার কলেজ জীবনের এক বন্ধুর কথা মনে পড়ল। ও বলত- ‘কাম নাই তাই ওড়না ঠিক কর।’ এই মেয়েটি আসলেই বর্ণনাতীত সুন্দরী। আমি নিশ্চিত এই মেয়ের স্বামী বাসর রাতে ওর পূর্ণিমার রূপ দেখে নির্ঘাত প্রথমে মূর্ছা যাবে। এই মুহূর্তে মনে মনে আমি মেয়েটির নামকরণ করলাম। আমি তার নাম দিলাম অবনিতা। এরপর আমি আবারো দই খাওয়ায় মন দেই।
অবনিতা ছয় কেজি মিষ্টি কিনেছে। ওর সঙ্গে একটা বাচ্চা রয়েছে। দেখেই বোঝা যায় নিজের না, অন্যের। নয়তো দত্তক নেয়া। পাশে বসে ওদের কথার আলোকে বুঝতে পারছি মেয়েটা অবিবাহিত। আর বাচ্চাটা তার আপন বড় বোনেরই মেয়ে। সঙ্গে অবনিতার মা-বাবাও আছেন। তারা বাজার করতে গিয়েছেন বলে, ছয় কেজি মিষ্টির বড় বোঝার মতোই অবনিতা ও তার বোনপোকে মিষ্টির দোকানে রেখে গেছেন। হয়তো যাওয়ার সময় তারা মিষ্টির মতোই অবনিতাকে প্যাকেটজাত করে অথবা আমার দশাধিক জামাকাপড়ের মতোই বগলদাবা করে নিয়ে যাবেন। এমা! এত বড় ধাড়ি মেয়ে কি বগলদাবা করা যায়? আমার জানা নাই। ভগবানই ভালো জানেন।
আমি তখনো সেফায়েতের জন্য অপেক্ষায়। কারণ সেফায়েত এখনো এসে পৌঁছায়নি। আমি হাতঘড়িটার দিকে তাকালাম একবার। এমন সময় অবনিতার বাবা ও মা এসে উপস্থিত। অবনিতার মা আমাকে প্রথম দেখেই যেন আশ্চর্য হওয়ার মতোই কিছু মনে করলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। আর অবনিতা তার মা-বাবাকে পেয়ে যেন রেগেমেগে আগুন।
– বাজারে এত সময় কী করছ?
– কত কিছু কিনলাম। সময় তো একটু লাগবেই। জবাব দিলেন মা।
– কোনো কমনসেন্স নাই তোমাদের। তোমরা থাকো, আমি চললাম।
– মনোজকে একটু ফোন কর। দেখ, গাড়ি নিয়ে শহরে আছে কিনা।
– তুমিই করো। আমি চললাম।
অবনিতা তার মাকে যতই ঝামটি মারুক, তবুও মনোজকে ফোন করল। অটোচালক মনোজ শহরে নেই। অবনিতা অন্য একটা গাড়ি রিজার্ভ করে ব্যাগ, মিষ্টি, আনাজপাতি নিয়ে গাড়িতে উঠল। এরপর তারা সবাই রৌদ্রোজ্জ্বল আলোর সামনে থেকেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
সেফায়েত যখন সাতক্ষীরায় এসে পৌঁছল, তখনো আমি ওখানেই বসা। সেফায়েত আমাকে দেখে অবাক হয়। সে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলে- বন্ধু মনে আছে, অনার্সে পড়াকালীন প্রতিদিন আমি যখন তোকে প্রাইভেটে ডাক দিতাম, তখন তুই থাকতি মেসের বাথরুমে। আমি ওর মুখের কথা থামিয়ে ওকে মিষ্টি খাওয়ালাম। তারপর কিছুক্ষণ খোশগল্প করেই উঠে দাঁড়ালাম। হাতে বহু কাজ জমে আছে। তবুও আমি চুল-দাড়ি কেটে, জামাকাপড় ইস্ত্রি সেরে, জুতায় কালি করে যখন বাসায় ফিরলাম, তখন বেলা একটা।
এত ব্যস্ততার কারণ একটাই। বিকালবেলা ঘটকমশাই আমাকে একটা পাত্রী দেখাতে নিয়ে যাবেন। বিকাল তিনটায় আমাকে চৌরাস্তার মোড়ে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। মূলত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আবার ব্যস্ততাও কম না। ছোটখাটো যাই হোক চাকরি একটা থাকলেও সেখানে বাড়তি ছুটি নাই বললেই চলে। শুক্র-শনি দুদিন যদিও আমার ছুটি, কিন্তু এই মেয়ের পড়াশোনা ঢাকায়। সে ঢাকা ভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। পরীক্ষা শেষে বাড়িতে এসেছে। দু-একদিন থেকেই চলে যাবে। তাছাড়া মেয়ের মা সন্ধ্যার পর মেয়ে দেখাতে চাচ্ছেন না। বৈদ্যুতিক আলোতে নাকি মেয়েদের লাবণ্যতা হারায়। এমন নানা মুনির নানা অজুহাতে আমার আজকের এই ব্যস্ততা।
আমি প্রতিদিনের মতোই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যাই মেয়ে দেখতে। ঘটক একটা ভাড়ার মোটরসাইকেল নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন চৌরাস্তায়। আমি সে মোটরসাইকেলে বসতে না বসতেই চালক দিলেন টান। এমা, পড়ে যাচ্ছিলাম তো! তবু আমাদের গাড়ি থামল না। সামনের কোনো হার্ডব্রেকে আমি ঠিক হয়ে বসলাম। গাড়িটা আশির বেগে ঘণ্টাখানেক চলার পর আমরা পৌঁছলাম মেয়ের বাড়ির সামনে। আমরা নামতেই ড্রাইভার চলে গেল চায়ের দোকানে। আমরা পৌঁছে গেলাম কন্যাগৃহে।
বিকাল পাঁচটা। সন্ধ্যা সন্নিকটে। মেয়ের বাবা বাড়ির ভেতরেই আছেন। হয়তো কোনো কাজকর্ম করছেন। মেয়ের মায়ের ছোট ছোট কথা শোনা যাচ্ছে ঘরের ভেতর থেকে। এক ষোড়শী বালিকা আমাদের ড্রয়িংরুমে অভ্যর্থনা জানাল। পরিচয় পর্বে জানতে পারলাম এই ষোড়শীই মেয়ের ছোট বোন। মেয়ে দেখাতে কোনোক্রমে রাত করবে না বলেই সে দ্রুত আমাদের খাবার পরিবেশন করে। এরপর পাত্রীকে নিয়ে আসা হলো আমাদের সামনে।
এই মুহূর্তে ঘর থেকে মেয়েকে বের করার সময় মেয়ের পা দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য রকম সুন্দর সে পা। ছোটবেলা মা বলতেন ‘ল²ীর পা’। ঠিক যেন এই মেয়ের পা সেই ল²ীর পা। এবার মেয়ের পা ছাপিয়ে তার নীল রঙের লেহেঙ্গার কভার দেখা যাচ্ছে। এভাবেই আস্তে আস্তে মুখটা উঁচু করে তার মুখের দিকে তাকাতেই পুরোপুরি অবাক হলাম। নিজের হাতে নিজে চিমটি কেটে স্বপ্ন নাকি বাস্তব- একবার চেখে নিলাম। হ্যাঁ, আজকের এই ঘটনা প্রবাহের সবটুকু বাস্তব। এতক্ষণে মেয়েটি আমাদের সামনের চেয়ারে বসে মিষ্টি হেসে আমাকে প্রশ্ন করল, কেমন আছেন? আমাকে চিনেছেন?
– আপনাকে না চেনার দুঃসাহসী বিস্মৃতি আমার এখনো হয়নি।
– তবে কী আপনি কোনো কারণে বিচলিত?
– না না। আমি মোটেই বিচলিত নই। (এমন সময় ভেবেছিলাম প্রশ্ন করব, আপনার নাম কী? কিন্তু এর মধ্যেই মেয়েটি আমাকে আবার প্রশ্ন করল।)
– সকালবেলা আমার কী নাম রাখলেন ?
– অবনিতা।
– অবনিতা? অর্থাৎ পৃথিবী?
– হ্যাঁ। কিন্তু আমি আপনার নাম রেখেছি জানলেন কেমন করে?
– মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা আমার। কতদূর কী শিখতে পেরেছি! তাই একবার ঝালাই করে দেখলাম। কোনো প্রশ্ন করবেন?
– হ্যাঁ, না। আমতা আমতা সুরে বললাম আমি।
– কেমন লেগেছে আমায়?
– মিষ্টি… খাব। মিষ্টি লাগছে বলতে গিয়ে কথা গুলিয়ে ফেললাম।
– আপনি অপেক্ষা করুন, আমি সাতক্ষীরার ঘোষ ডেয়ারির মিষ্টি অবনিতাময় কোনো একটা প্লেটে ঢেলে দিচ্ছি। মুচকি হেসে বলল মেয়েটা।
– আমাকে ভালো লাগেনি আপনার? নার্ভাস হয়ে জানতে চাইলাম।
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অবনিতা বলল- একটা মিষ্টি দুজনে খেলে কি আপনার কোনো আপত্তি আছে?
– কিন্তু মিষ্টি তো ছিল ছয় কেজি।
– আপনি দুষ্টু একটা। সে আমি সকাল বেলা দেখেই বুঝেছি। বাবা-মা আসছেন। আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি।

অনির্বাণ চক্রবর্তী : শিকারপুর, পিরোজপুর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়