জি এম কাদের : ইভিএম ভোট চুরির আধুনিক মেশিন

আগের সংবাদ

বিকৃতির ঝুঁকিতে বাংলা ভাষা

পরের সংবাদ

ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা : শেখর ভট্টাচার্য

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। কোনো রাখঢাক নাই, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বক্তব্যকে কুয়াশাচ্ছন্ন করার প্রচেষ্টা ছিল না তার। সরাসরি তিনি তার বক্তব্য তুলে ধরেন এভাবে, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’ ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার এই ঐতিহাসিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সত্যিকার রূপটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে ভাষার প্রশ্নে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল সে বিষয়ে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি এ সময়ে ‘…নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে জনগণ প্রমাণ করবে যে তারাই রাজা, উপাধিধারীদের জনশোষণ আর বেশি দিন চলবে না। বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের ওপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে।’
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অনুমান অনুযায়ী অনেক চেষ্টাই চলেছিল। অনেকে অনেক তত্ত্ব, অনেক উপায় বাতলে দিয়েছিলেন। ভাষার প্রশ্ন যখন সংস্কৃতির অভ্যন্তরে প্রবেশ করল তখন উদ্ভট অনেক প্রচেষ্টা চলেছে। সা¤প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে হাস্যকর সব পরীক্ষা, নিরীক্ষা শুরু হয়। উর্দু এবং রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টা ছিল সবচেয়ে অদ্ভুত। সাংস্কৃতিক সংকট তৈরির জন্য পাকিস্তান সরকার এবং পূর্ববঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধিতাকারীরা নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ এর মার্চে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হলে পাকিস্তান নিয়ে বাঙালির যে স্বপ্ন ছিল সে স্বপ্নটির অপমৃত্যু ঘটে। এই দহন কালে হতাশ নাহয়ে বাঙালি তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের শেকড়ের অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আত্মানুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার যে প্রবণতা, তা যে শুধু ব্রিটিশশাসিত ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তানশাসিত অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক যুগে স¤প্রসারিত হয়েছিল তা নয়। এর বহু আগে থেকে, বিশেষ করে তুর্কি শাসনের সময় থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপ ধারণা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। মধ্যযুগে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকল্পে কবি আবদুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণী’ শীর্ষক এক কবিতায় লিখেছেন : ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জনম নির্ণয় ন জানি।’ এটি যে শুধু একটি ব্যঙ্গার্থক কথোপকথন বা কোনো রচনার পঙ্ক্তি ছিল তা নয়, এই কবিতাটি ছিল অপশাসন এবং বাংলা ভাষা অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের সহজ প্রকাশ। মধ্যযুগ থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশ, ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে যখন বাঙালি স্বপ্নের স্বভূমি পাকিস্তানে প্রবেশ করে তখন রাষ্ট্রের সা¤প্রদায়িক চরিত্র দ্রুত বাঙালির সামনে উন্মোচিত হয় ভাষার প্রশ্নে। পাকিস্তান নামক অলীক স্বপ্ন ভঙ্গ এবং জাতিসত্তার ঐতিহ্য অন্বেষণের পরে বাঙালি সাংস্কৃতিকভাবে স্বভূমে ফিরে আসে। বাঙালি জাতি সত্তার স্বরূপ স্ফটিক স্বচ্ছভাবে নিজেদের সামনে উপস্থিত হওয়ার ফলে জাতি হিসেবে বাঙালি আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। জাতিসত্তার গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ফিরে আসাকেই ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন বাঙালির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বাস্তবতা যে চেতনার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি ছিল বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার একপর্যায়ে ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব ও ভাগ্যকে জুড়ে দেয়া হয়েছিল কৃত্রিম ও সা¤প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে। তদানীন্তন পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা ৭ জনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাঙালি সংস্কৃতির উদারতা, অসা¤প্রদায়িকতা, বিশ্বজননীতার মতো এর কুঠোরে আছে আত্মপরিচয়কে নিরাপদ রাখার এক অপূর্ব শক্তি। সে শক্তি থেকেই জোরালো হয়ে ওঠা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জত হয়, রাষ্ট্রভাষার দাবি। দাবি মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে জোর করে পাকিস্তানিকরণের চেষ্টা চালানো হয় নানাভাবে। সা¤প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের সহযোগী বাঙালি লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। নজরুলের রচনাকে আংশিক ও খণ্ডিতভাবে গ্রহণের হীন পদক্ষেপও তারা নিয়েছিল। এসব হীন তৎপরতার বিরুদ্ধে তখন আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছে ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য রক্ষার ওই আন্দোলনের অর্জন ছিল বাঙালির অনির্বাণ প্রেরণা।
প্রশ্ন হলো, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সংস্কৃতিগতভাবে বাঙালি যে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিল, এই প্রত্যাবর্তনকে কতটুকু মহিমান্বিত করা গেছে এ পর্যন্ত। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সংকীর্ণ ধর্মাচ্ছন্নতাকে ছাপিয়ে জেগে ওঠেছিল জাতিগত চেতনা। সেই চেতনা আমাদের এই মর্মে সচেতন করেছে যে, আমরা বাঙালি। আমরা জেনেছি, বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গীকার, বাংলাদেশ আমাদের দেশ। ভাষা আন্দোলন থেকে উৎসারিত চেতনার বলেই আমরা আমাদের বায়াত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলাম ধর্মনিরপেক্ষতা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধান থেকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসন দেয়া হয় এবং নতুন করে সা¤প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর ধর্মনিরপেক্ষতা আবার সংবিধানে স্থান পায়। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও পঁচাত্তর পরবর্তী সা¤প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাবে জাতির মধ্যে কিছুটা হলেও সা¤প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। একইভাবে সা¤প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধান থেকে ছেটে ফেলে জাতিকে বিভক্ত করার জন্য বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই জাতীয়তাবাদ যারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাদের অবচেতন মনে পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরিয়ে নিয়ে আসার একটি সুস্পষ্ট ইচ্ছা ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানে আবারো বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রত্যাবর্তন ঘটে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জাতির মধ্য বিভক্তি সৃষ্টি করা। দীর্ঘদিন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতাসীন থাকায় জাতির মধ্যে যে বিভক্তি দেখা যায়, সে বিভক্তির ফলেই জাতীয় ঐক্য অনেকাংশেই আজ ক্ষুণ্ন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে যে খুব সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। মাতৃভাষা পরিত্যাগের নানামুখী তৎপরতা সমাজ জীবনে মোটা দাগে দেখা যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাক্রমে ৩টি পৃথক ভাষা বিদ্যমান। সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঔপনিবেশিক ইংরেজি ভাষা নির্ভর শিক্ষাক্রমে। অপরদিকে প্রান্তিক-হতদরিদ্র শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করছে দেশের কোনে কোনে ছড়িয়ে থাকা মাদ্রাসাগুলোতে। যেখানে আরবি ভাষাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের প্রয়োগ হচ্ছে, বাংলা ভাষা সেখানে হয় আরোপিত না হয় অবহেলায় গৃহীত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধু সাধারণের জন্য বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করার ব্যবস্থা আছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই যে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খল অবস্থা, তা কিন্তু আমাদের ভাষা আন্দোলনের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রæতির সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ভাষা আন্দোলনের প্রতিশ্রæতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অনেক নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। এ ধরনের কার্যক্রমের ওপর জাতীয় চেতনা বিকাশের প্রশ্ন জড়িত। একইভাবে বাংলা ভাষাকে শিক্ষা কার্যক্রম এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গণে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং দৃঢ়তা দুটোরই প্রয়োজন আছে। এসব কার্যক্রম যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৃণমূলকে যুক্ত করে সম্পাদন করা হয় এ বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। মনে রাখতে হবে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সমগ্র বিশ্বে আজ এই দিনটি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয়। একুশের এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে নিজ দেশে সফলভাবে বাস্তবায়নের নৈতিক দায়কে আরো জোরালো করে তুলেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মাতৃভাষাকে সর্বস্তরে ব্যবহার করা ছিল ভাষা শহীদদের প্রতি জাতির অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমে আমরা জাতীয়ভাবে যেমন এগিয়ে যেতে পারি একইভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সূতিকাগার হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তিকে সারাবিশ্বের সামনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেতে পারি। এসব কর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব যদি আমার আবার বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় নিজেদের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়