জি এম কাদের : ইভিএম ভোট চুরির আধুনিক মেশিন

আগের সংবাদ

বিকৃতির ঝুঁকিতে বাংলা ভাষা

পরের সংবাদ

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ : ফরিদ আহমদ দুলাল

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘বিকেন্দ্রীকরণ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা মোটেই অপরিচিত নই। কয়েক যুগ ধরে বঙ্গদেশে বিকেন্দ্রীকরণ শব্দটি হামেশাই শুনতে পাই; সে বিকেন্দ্রীকরণ ক্ষমতার, দায়িত্বের বা কর্তৃত্বের; এবং শব্দটির প্রতি আমরা মোটেই অনীহ নই। শব্দটিকে যারা চাউর করেছেন, তাদের লক্ষ্য ইতিবাচক হতেই পারে; কিন্তু তারা যে জনগণকে আশ্বস্ত করার দুরভিসন্ধি নিয়ে শব্দটি প্রচার করেছেন, সে কৌশলও কেউ কেউ বুঝতে পেরেছেন ধারণা করি। যদিও তাদের কৌশলপত্রের বিরোধিতা করার অবকাশ থাকে না আমাদের কাছে; কিন্তু যখন বলা হয় ‘বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ’ তখন সামান্য খটকা লাগে বৈকি! তবে কি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে উন্মুল করার নীলনকশা কোনো? আপাতদৃষ্টিতে সে জিজ্ঞাসা জন্ম নিলেও এ বিকেন্দ্রীকরণে শুভ প্রবণতার প্রগাঢ় উদ্ভাবনী আছে মনে হয়। নব ধারার সেই উদ্ভাবনটি অনুসন্ধান এবং আবিষ্কার করাই বর্তমান রচনার উদ্দেশ্য।
উদ্ভাবনীর সৌন্দর্য আবিষ্কারের আগে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যাক। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে সারস্বত সমাজকে পাঠ দেয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই, সে বিষয়ে আমি যথেষ্ট সতর্ক আছি; তার পরও ‘বিকেন্দ্রীকরণের’ সাথে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে যুক্ত করার উদ্ভাবনীকে সমন্বয়ের স্বার্থে জানা বিষয়েও সামান্য কথা উচ্চারণ করতে চাই; তা না হলে বিষয়ের আবশ্যিকতা প্রমাণের কর্মপদ্ধতিতে ছেদ পড়তে পারে।
মানুষের মনোভাব প্রকাশের ধ্বনিময় অভিব্যক্তির পরিচয় ভাষা। আমাদের ভাষার বৈচিত্র্য নান্দনিক। সে বৈচিত্র্যে আছে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা, পাশাপাশি আছে প্রমিত ভাষা; এছাড়া আছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা। আঞ্চলিক ভাষার কোনো কোনোটি এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সব ভাষাই সর্বব্যাপী বোধগম্য নয়, আবার কোনো কোনো অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার কোনো কোনো শব্দ দেশের সর্বব্যাপী পরিচিত নয়; এমন বাস্তবতায় বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রমিত ভাষাই কি ছড়িয়ে দেয়া হবে সাধারণের মুখে? নাকি সাধারণের ভাষাই আদৃত হবে নাগরিক মানুষের মুখে- এসব প্রশ্নের মীমাংসা চাই। ভাষা বিষয়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, প্রতিটি ভাষার অন্যতম উৎস সে অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ু। ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং পরিপার্শ্বের স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ভাষা উচ্চারণের স্বরাঘাত পল্লবিত হয়। আঞ্চলিক ভাষার ‘টান-টোন’ শুনেই আমরা সে ভাষার চারিত্র্য আবিষ্কার করতে পারি; সুতরাং ভাষাকে স্থানান্তর করা গেলেও ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ু আর পরিপার্শ্বকে কি স্থানান্তর করা সম্ভব? নাটক-সিনেমায় যখন এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে অভিনয় করেন, আমরা কিন্তু তার উচ্চারণের ‘টান-টোন’ শুনেই বুঝতে পারি, তিনি নকল। ভাষার এই ‘টান-টোন’-টা লিখে উপস্থাপন সহজ নয়; এর স্বরলিপিও জটিল।
মানুষের কল্যাণচিন্তায় শুভ প্রবণতার পক্ষে আবেগ-অনুভব-সত্য ও বাস্তব প্রকাশের শিল্পিত ভাষিক উপস্থাপন হলো সাহিত্য। সাহিত্যেরও আছে লোকসাহিত্য ধারা এবং আধুনিক সাহিত্যের ধারা।
আধুনিক ধারার সাহিত্য আজকের মূলধারা বলে বিবেচিত হলেও বাংলার লোকসাহিত্যের ধারা কিছুতেই অপাঙক্তেয় নয়। আমাদের লোকসাহিত্যের ধারায় আছে লোকছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, লোকধাঁধা ও শিলুক, লোকসংগীত (কীর্তন, পালা গান, যাত্রা-ঢপযাত্রা, হাইট্টারা গীত, গাইনের গীত, ঘাডুগান, বাউলগান, বিয়েরগান, মেয়েলী গীত, সারিগান, আলকাপ গান, গম্ভীরা, সঙের গান, বৃষ্টির গান, বারোমাসী গান, জারিগান, কবিগান) ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে আধুনিক সাহিত্যকে লোকসমাজে ছড়িয়ে দিয়ে আমরা কি লোকসাহিত্যকে বিস্মৃত হবো? নাকি লোকসাহিত্যের ধারায় নিজেদের যুক্ত করে আধুনিক ধারা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেব? কোনো জনপদের শিল্প-সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশ যদি পরম্পরা নির্ভর হয়, সে বিকাশের স্বতঃস্ফূর্ততার শক্তির সঙ্গে প্রতিস্থাপিত সাহিত্য ধারা টিকতে পারে না; এ সত্যটি মনে রেখেই ভাবব ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ ভাবনা। সংস্কৃতির দুটি শাখা; একটি ঝঢ়রৎরঃঁধষ অন্যটি গধঃবৎরধষ; চেতনাগত-ভাবগত এবং বস্তুগত। সংস্কৃতির চেতনাগত ও ভাবগত শাখাকে ’বিমূর্ত’ এবং বস্তুগত শাখাকে ‘মূর্ত’ শাখা হিসেবে আলোচনার প্রয়াস থাকবে বর্তমান রচনায়। লোকসাহিত্যের ধারায় যেসব অনুষঙ্গের কথা বলা হলো, সেগুলো লোকসংস্কৃতির বিমূর্ত ধারার অনুষঙ্গ। আমাদের লোকসংস্কৃতির বিমূর্ত ধারার আরও কিছু অনুষঙ্গ হলো- লোকজ মেলা, লোকচিকিৎসা, লোকজ উৎসব-অনুষ্ঠান, মানব জীবনচক্র ঘিরে উৎসব-অনুষ্ঠান (সীমন্তন্ন, সাধ, শিশুর জন্ম, ষষ্ঠি, আকিকা, অন্নপ্রাশন, সই ও দুস্তি পাতানো, ভাইফোঁটা, রাখিবন্ধন, দোল উৎসব, বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান), বর্ষপরিক্রমায় উৎসব-অনুষ্ঠান (নববর্ষ পালন, বর্ষায় নৌকা বাইচ, অঘ্রাণে ধান মাড়াই-ঘুড়ি ওড়ানো-নবান্ন, চৈত্র সংক্রান্তি, বর্ষপরিক্রমায় অন্যান্য আয়োজন), ধর্মীয় আচারভিত্তিক উৎসব-অনুষ্ঠান, লোকজ খেলা ইত্যাদি। অন্যদিকে সংস্কৃতির মূর্ত শাখায় আছে বস্তুগত অনুষঙ্গ, যেমন- ভাদ্রে তালের পিঠা, পৌষে পিঠাপুলি, গৃহ নির্মাণ ও গৃহসজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যসামগ্রী, কৃষিকাজ ও কৃষিব্যবস্থায় ব্যবহৃত নানান অনুষঙ্গ, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার নানান অনুষঙ্গ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, বস্ত্রশিল্প-তাঁতশিল্প, ধাতুশিল্প, মৃৎশিল্প, কাষ্ঠশিল্প, বাঁশ-বেত-পাতাশিল্প, দুগ্ধজাত ও মিষ্টান্নশিল্প, নকশী কাঁথা, ভেষজ চিকিৎসা, ঘানিশিল্প, সূচিকর্ম ইত্যাদি; এছাড়া আছে লোকজীবনের নানান আবশ্যিক অনুষঙ্গ। আলোচনার বিস্তৃতিতে যাবার আগে স্মরণ করে নিতে চাই, ভাষা-সাহিত্য কিন্তু সংস্কৃতির বাইরের অনুষঙ্গ নয়; সুতরাং ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ কিছুতেই সহজ আলোচনা নয়; একে অনুধাবনের চেয়ে উপলব্ধি করা জরুরি।
বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সরল বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সহমত হওয়ার সুযোগ আপাতদৃষ্টিতে না থাকলেও উপলব্ধির অনুভবে চেতনার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চয়ই হতে পারে; সেই সত্য উচ্চারণের লক্ষ্যে বাঙালির সংস্কৃতিচর্চার সুখ-দুঃখের কথা সামান্য উপস্থাপনের চেষ্টা করে মীমাংসার দিকে যেতে চাই।
আমরা জানি, উৎকট-উগ্র সংস্কৃতির আগ্রাসী চারিত্র্য প্রায়শ শিষ্ট-সংস্কৃতিকে বিপন্ন করতে চায়, কিন্তু শিষ্ট-সংস্কৃতি সহজে পরাভব মানে না; এর একটাই কারণ, শিষ্ট-সংস্কৃতির শিকড় প্রোথিত থাকে আপন মৃত্তিকায়। মানুষের সংস্কৃতির যোগ যখন মৃত্তিকার সঙ্গে সংযোগ হারায় তখনই ঘটে বিপর্যয়; তখনই অপসংস্কৃতি-বিজাতীয় সংস্কৃতির উৎকট-উগ্র প্রভাব ভাসিয়ে নিয়ে যায় দীর্ঘদিনের লালিত মূল্যবোধকে, ডুবিয়ে-ভাসিয়ে তছনছ করে দিতে চায় আবহমানকালের লালিত সংস্কৃতিকে। এ সত্য কেবল সংস্কৃতিকর্মী বুঝলেই হবে না, বুঝতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও। বঙ্গবন্ধু এ সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন বলেই বাঙালিকে দিশা দিয়ে বিজয়ের মোহনায় পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু সব সময়ই বাংলার মাটি ও মানুষের কথা, বাঙালির নিজস্ব শিল্প-সাহিত্য-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির কথা বলেছেন, তিনি যে মনে-প্রাণে একজন বাঙালি সে কথা সগৌরবে উচ্চারণ করেছেন।
আর একজন মানুষের যাবতীয় আচার-আচরণ মনোজাগতিক বহিঃপ্রকাশই হলো সংস্কৃতি। নাগরিক জীবনের নিত্যদিনের সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশকে আমরা কি বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে লোকজীবন-সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত করতে চাইব? নাকি গ্রামীণ জীবনের সংস্কৃতিকে নগর জীবনে ছড়িয়ে দিতে পারব? ধরা যাক, আমাদের গ্রামীণ জীবন-সংস্কৃতিতে কার্তিক শেষে মশা-মাছি তাড়ানো এবং নতুন ফসলের মঙ্গল কামনা করা হয়। কার্তিকের শেষ দিন বাড়ি থেকে অশুভ তাড়াতে খড়ের ‘বুইন্দা’য় আগুন দিয়ে বাড়ির চারপাশে প্রদক্ষিণ করে খড়ের ‘বুইন্দা’টি নিজের ধানি জমিতে পুঁতে দেয়া হয়। বুইন্দা নিয়ে প্রদক্ষিণের সময় চিৎকার করে বলা হয়- ‘বালা আয়ে বুড়া যায় মশা-মাছির মুখ পুড়া যায়’। মানুষের ধারণা এই ধোঁয়ার মাধ্যমে মশা-মাছি-অশুভ পতঙ্গ বিনাশ হবে এবং ক্ষেতে অধিক শস্য ফলবে। গ্রামবাংলার মানুষের ধারণা বছরের প্রথম দিন ভালো কাটলে সারা বছর ভালো কাটবে। নববর্ষে একজন অন্যের বাড়িতে গেলে সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে আপ্যায়িত করে, মিষ্টিমুখ করায় এবং পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করে। সাম্প্রতিক সময়ে নববর্ষ উপলক্ষে শহরে বৈশাখী মেলার আয়োজন, মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন ইত্যাদি সাড়ম্বরে পালিত হলেও গ্রামের অনুষ্ঠানের আয়োজন কিন্তু ভিন্নমাত্রার। নববর্ষ উপলক্ষে গ্রামে কবাডি খেলা, দাড়িয়াবাঁধা খেলা, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি খেলার আয়োজন হয়। গৃহস্থ বাড়িতে গৃহপালিত প্রাণীদের ¯œান করানো হয়, কলকিতে রং লাগিয়ে গরু-ছাগলের গায়ে নকশা আঁকা হয় এবং ঘর-দুয়ার-উঠান-আঙ্গিনা পরিষ্কার পরিপাটি করা হয়। নববর্ষ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা হালখাতার আয়োজন করে। হালখাতার প্রস্তুতি চলে দু’দিন আগে থেকেই। দোকানপাট দু’দিন আগে থেকেই ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয় এবং দোকানের মালামাল পুনর্বিন্যাসের পাশাপাশি পুনর্মূল্যায়িতও হয় নববর্ষে। হালখাতার অনুষ্ঠানকে গ্রামে বলা হয় পুণ্যি। পুণ্যি অনুষ্ঠানে নিয়মিত ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করানো হয়। লোকজীবনের এ সংস্কৃতিকে নগর জীবনে প্রচলনের সুযোগ কোথায়?
বাঙালি জাতির স্বপ্নের অঙ্কুরোদ্গম আর বিস্তৃতির উৎস যদি খুঁজতে চাই, বারবারই আমার দৃষ্টি আটকে যায় ১৯৭১-এর ৭ই মার্চে, রেসকোর্স ময়দানে। বাঙালির স্বাধীনতা আর মুক্তির আকাক্সক্ষা অঙ্কুরিত হয়েছিল সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে। সেদিনই বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নটি জাতির চেতনায় সেটে দিতে পেরেছিলেন; এর আগের সবটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নজাগরণ পর্ব। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের স্বপ্ন যখন আজ সময়ের বিবর্তনে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস দেখি, তখন তার মুক্তির আকাক্সক্ষাকে কিছুটা বিচিত্র কৌণিক অবস্থান থেকে মূল্যায়ন করে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করি; এবং সে লক্ষ্যেই ‘সংস্কৃতি বিকেন্দ্রীকরণের’ অনুষঙ্গটিকে বিবেচনায় আনতে চাই।
সংস্কৃতি বিষয়ে আমি আজ ভিন্ন আঙ্গিকে সামান্য ক’টি কথা নিবেদন করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, আমার এ নিবেদন প্রত্যেকেরই পড়া আবশ্যক; পড়ার পর কেউ চাইলে আমার সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ অথবা ভিন্নমত প্রকাশের উদ্যোগ নিতেই পারেন; তবে যদি আমার পাঠক আমার বক্তব্যের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেন, তাহলে পাঠকের কাছে আমার একটা নিবেদন আছে, আমি চাই প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান আর সামর্থ্য নিয়ে আমার প্রস্তাব বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবেন। আর যদি আপনি একমত হয়েও ভূমিকা না রাখেন, তাহলে জানবেন আপনি নিজের সঙ্গে, পরিবার-সমাজ-দেশ এবং পৃথিবীর সঙ্গে প্রতারণা করলেন। যে প্রতারণার জন্য আমি, সমাজ বা রাষ্ট্র আপনার জন্য কোনো শাস্তি বিধান হয়তো করতে পারব না; কিন্তু আপনি নিজে নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবেন। আজ অথবা আগামীকাল নিজের বিবেকের দংশনে অনুতপ্ত হবেন নিজে, অনুতাপের অনলে নিজেই পুড়বেন।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের সমাজে যারা নিজেকে সংস্কৃতিমান বলে পরিচয় দেন, তাদের অধিকাংশেরই ‘সংস্কৃতি’ অভিধাটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। সমাজের বিপুলাংশের ধারণা গান-বাজনা-নাটক-আবৃত্তি-নৃত্যকলা-চিত্রকলা ইত্যাদিতেই ‘সংস্কৃতি’ সীমাবদ্ধ; আবার অনেকেই আছেন, যাকে সংস্কৃতি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রায় সঠিক উত্তরটিই দেবেন, কিন্তু তার মেন্টাল সেটআপটা পূর্বোক্তদের মতোই; সঙ্গত কারণেই সংস্কৃতি বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয় সংকট। ফলশ্রæতিতে সংস্কৃতির বিশাল সমুদ্র আটকে যেতে চায় ক্ষুদ্র ডোবায়। প্রশ্ন হচ্ছে, সংস্কৃতিকে ক্ষুদ্র ডোবার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেবে কে?
ধরা যাক একটা সংগঠন, হতে পারে সেটি স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়, একজন জনাব ‘ক’কে সেখানে সাংস্কৃতিক সম্পাদক বা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী নির্বাচন করা হলো; এই নির্বাচন অথবা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ নির্ধারণ, সর্বত্র ‘থোক’ প্রথা প্রচলিত। ভাবখানা এই যেন, ‘ও তো সাজের লাঠি-ঢাকের বাঁয়া, সমাজের অনুৎপাদনশীল আঙিনা; ওখানে অতটা যোগ্য মানুষ না হলেও চলবে, বনসাই-এর মতো স্বল্প জল বরাদ্দ হলেই চলবে।’ অনুগত-বনসাই জাতীয় একজনকে নির্বাচন করে দেয়া হলো সাংস্কৃতিক সম্পাদক অথবা সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হিসেবে; এটা শুধু সরকার বা সরকারি দলে নয়, সরকারবিরোধী দলেও নয়, বরং সমস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য এবং আমাদের এই ভুল চিন্তাই পশ্চাদপদ করে রাখছে জাতিকে। যাকে নির্বাচন করা হলো সাংস্কৃতিক সম্পাদক অথবা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী, তিনি নিজে সংস্কৃতি বিষয়ে কতটা প্রজ্ঞাবান খোঁজ নেয়ার প্রয়োজনই বোধ করেননি। এই বাস্তবতায় আমরা থেমে থাকলেও সময় কিন্তু থেমে থাকছে না। যারা সাংস্কৃতিক সম্পাদক অথবা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী নির্বাচিত/মনোনীত হচ্ছেন তাদের আমি দোষ দেখছি না; দোষ তাদের যারা নির্বাচিত/মনোনীত করছেন।
সংস্কৃতি একটি জাতির জন্য হৃদস্পন্দন; বৃক্ষের বেঁচে থাকা- বেড়ে ওঠার জন্য শিকড় যেমন প্রাণের উৎস, তেমনি একটি সমাজ-জাতির বিকশিত হওয়ার জন্য প্রধানতম শর্তটি হচ্ছে সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠা। জাতি কতটা সভ্য, কতটা মানবিক গুণসম্পন্ন, কতটা প্রাগ্রসর তা পরিমাপ করার মানদণ্ড হচ্ছে তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতি একটা জাতির দর্পণ; যে দর্পণ দেখে বিশ্ব অনুমান করে নেয় জাতির আর্থসামাজিক উন্নয়নের উচ্চতা। এসব সত্য জানার পরও কেন যে আমরা সংস্কৃতি বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকি, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। দেশে খুন-ধর্ষণ-দুর্নীতি-অনাচার-অবিচার-দুঃশাসন-স্বেচ্ছাচারিতা যখন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে, তখন সঙ্গত কারণেই নানান প্রশ্ন সামনে এসে যায়; তখন সমাজের নীতিনির্ধারকদের নিয়ে জনতার মনে বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়।
যারা নেতৃত্বের জন্য নেতা নির্বাচিত/মনোনীত করছেন, তারা নিশ্চয়ই পড়েছেন জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতাটি, যার বাণীস্বত্ব ইতোমধ্যেই কালের গণ্ডি পেরিয়ে মহাকালের পথে চলেছে। আসুন আমরা ছোট্ট সে কবিতাটি পাঠ করি মনোযোগে-
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
(অদ্ভুত আঁধার এক \ জীবনানন্দ দাশ)
সত্যিই আমরা যেন জেনে গেছি অন্ধ-হৃদয়হীনের সুপরামর্শ ছাড়া আমাদের পৃথিবী অচল, আমরা যেন বুঝে গেছি সৎ-নির্লোভ-বিশ্বাসীরা আজ পৃথিবীতে অযোগ্য; সচল কেবল স্তুতি-স্তাবকতা। কিন্তু বড় সত্য এই, স্তুতি-স্তাবকতায় সাময়িক প্রসাদলাভ ঘটলেও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নিজেদের সংস্কৃতির মান উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক; সমস্যা হচ্ছে, কী করে সেটা সম্ভব? যখন আমাদের সংস্কৃতির স্বরূপসন্ধান করাই হয়নি; যখন আমাদের জানাই নেই সংস্কৃতি কোন দিঘির জল, কোন সমুদ্রের ঢেউ? যখন আমরা বুঝতেই পারিনি সংস্কৃতি কোন কাননের ফুল, কোন আকাশের মেঘ; যখন আমাদের দেখাই হলো না সংস্কৃতি কোন বাথানের গাই, কোন পাহাড়ের ঝরনা, কোন শ্রাবণের রাত, কোন দিগন্তের জলপ্রপাত; তখন সংস্কৃতির মানোন্নয়ন কীভাবে সম্ভব, কে বলবেন?
ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি যখন কোন ব্যক্তি-পরিবার-গোষ্ঠী-সমাজ-দেশের প্রাগ্রসরতার পরিচায়ক, তখন সংস্কৃতি বিষয়টাকে আমলে আনতে হবে বৈকি। প্রাগ্রসরতা কে না চায়? অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার পথে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশের পরিচিতি পাচ্ছে, উন্নয়নের মহাসড়কে যখন দেশ অপ্রতিরোধ্য বিবেচিত হচ্ছে; তখন কি এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করা উচিত নয়? উন্নয়ন অগ্রযাত্রার যারা নিশানবরদার তাদের কি শিষ্ট-সহিষ্ণু আর সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করা উচিত নয়?
আজ থেকে সত্তর-আশি বছর আগে জীবনানন্দ দাশ যে কথা তার কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন, আজকের সমাজবাস্তবতায় আমাদের মূল্যবোধ আর মানবিক রুচির স্তর যে কতটা নিচে সে কথা কি কাউকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন আছে? তাহলে আজ যারা সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তাদের কি সে বাস্তবতা উপলব্ধি করা উচিত নয়? যারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নেতৃত্বে আছেন, তারা সৎ হবেন-দেশপ্রেমী হবেন; তারা নির্লোভ হবেন- সব ধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকবেন; এমনটি কি মানুষ প্রত্যাশা করতে পারে না? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মানুষ তাদের কাছ থেকে তেমনটি পাচ্ছে না; এবং সঙ্গত কারণেই মানুষের বুকে সঞ্চিত হচ্ছে ক্ষোভ আর ঘৃণা; যে ঘৃণা আর ক্ষোভ একদিন বিস্ফোরণ ঘটাতে বাধ্য; কিছুতেই মানুষের ক্ষোভ আর ঘৃণা থেকে মুক্তি পাবে না জাতি। উন্নয়ন আর ঘৃণার সমন্বয় সহজ হবে না; এবং সমন্বয়হীনতা আমাদের সমস্ত শুভ অর্জনকে ধুলিস্মাৎ করে দিতে পারে। সুতরাং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সংস্কৃতির শিখাটিকে আলোময় করে তুলতে দ্রুততার সঙ্গে আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া আবশ্যক আজ।
একবার একটু বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে ভাবুন, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে, অর্থবহ করতে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে অর্থবহ করে তোলা আবশ্যক নয়? আমার বিশ্বাস অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনে সাংস্কৃতিক মুক্তি নিশ্চিত করাটা অনিবার্য; এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের সব স্তরে সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে সমন্বয় করা জরুরি। সে বিবেচনায় দেশের মাঠপর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়, কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে চিন্তা ও আকাক্সক্ষার স্বপ্নটি; এবং সেখানেই বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণের সৌন্দর্য লুক্কায়িত। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ তখনই অর্থবহ হবে, যখন লোকবাংলার শুভপ্রবণতার চেতনা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে লোকমানস থেকে নীতিনির্ধারকদের কাছে; বিকেন্দ্রীকরণের আসল শক্তি দেশপ্রেমে; দেশমাতৃকার বন্দনায় নিজেকে নিবেদনের চেতনায়; এ সত্যটি পাঠ করা যাবে বঙ্গবন্ধুর জীবন-সংগ্রামের দীপ্তি থেকে। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশকে ‘থোক’ বরাদ্দ দিয়ে করুণার স্তরে রাখা আত্মঘাতী- এ সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে; আর যতক্ষণ তা না করা হবে, ততক্ষণ জাতির ‘মুক্তি’র আকাক্সক্ষা দুঃস্বপ্ন; আর ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ বিপর্যয়ের অনুপান মাত্র।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়