জি এম কাদের : ইভিএম ভোট চুরির আধুনিক মেশিন

আগের সংবাদ

বিকৃতির ঝুঁকিতে বাংলা ভাষা

পরের সংবাদ

আমাদের সন্তানেরা হোক বাংলা ভাষায় দক্ষ : কুমার প্রীতীশ বল

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘আমার সন্তান থাকুক দুধে ভাতে’- আত্মবাক্যের মতো একটি নির্দোষ মানবিক প্রত্যাশা হলো, আমাদের সন্তানেরা হোক বাংলা ভাষায় দক্ষ। কারণ একজন মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন অনস্বীকার্য। আমরা বিশ্ব ইতিহাসে যেসব মানবিক মানুষের কথা জানি, তারা সবাই মাতৃভাষায় দক্ষ। তাদের মাতৃভাষায় ব্যুৎপত্তি প্রশ্নাতীত। আবার বাঙালির মাতৃভাষার সঙ্গে সম্পর্কটি অনেক বেশি আবেগের। পৃথিবীতে বাঙালি একমাত্র জাতি, যাদের মাতৃভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা এক ও অভিন্ন অর্থাৎ বাংলা। একটি সফল রক্তাক্ত ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আসনে আসীন করা সম্ভব হয়েছে। তখনই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে, যা পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। বাংলা ভাষার অধিকার আন্দোলনের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল। তারপর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীন বাংলা নামের দেশটি অর্জিত হয়েছে। এ ইতিহাস আজ আর কারো অজানা থাকার কথা না।
বেদনার কথা, হতাশার কথা হলো, আমাদের সন্তানেরা সে বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর যে পরিসংখ্যান দেয়, তাতে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারি না। আমাদের দেশের অর্ধেকেরও বেশি, ক্ষেত্র বিশেষে চার ভাগের তিন ভাগ বাঙালি শিশু মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষায় দুর্বল। ২০১৫ সালের জাতীয় কৃতি অভিক্ষা (এনএসএ) বেইজ লাইন তথ্য অনুসারে, বাংলা পঠন দক্ষতা অর্জন করেছে-তৃতীয় শ্রেণিতে ৪১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৪৫ শতাংশ। বহুমাত্রিক গুচ্ছ জরিপ বা মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ অনুযায়ী দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদর মধ্যে বাংলা পঠনের ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন করেছে ২৫.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। (বাংলাদেশ অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০২০ দ্রষ্টব্য)। ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়ার হার কম হওয়ার কারণ হিসাবে কর্তৃপক্ষ বলেছেন, শিক্ষার্থীদের কাছে কঠিন হিসেবে পরিচিত বাংলা এবং ইংরেজিতে তুলনামূলক খারাপ করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০১৪ সালের সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলা বিষয়ে ‘দক্ষতা অর্জনে উন্নতির জন্য শিক্ষার্থীদের চিন্তার দক্ষতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন।’
চিন্তার দক্ষতা অর্জনের জন্য দরকার শিশুর পঠন দক্ষতা অর্জন। শিশুর পঠন দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে ‘পড়তে শেখা’ ও ‘পড়ে শেখা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পঠন দক্ষতা অর্জনের জন্য সাবলিলভাবে পড়তে পারার পাঁচটি উপাদান আছে। এগুলো হলো ধ্বনি সচেতনতা, বর্ণ জ্ঞান (স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, কারচিহ্ন, যুক্তবর্ণ), শব্দভাণ্ডার, সাবলীলতা ও বোধগম্যতা। এই পাঁচটি উপাদানের সমন্বয়ে শিশুকে পড়তে শেখা রপ্ত করানো প্রয়োজন। এই পাঁচটি উপাদানকে সাবলিলভাবে পড়ার পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিশুকে স্বাধীন পাঠক হিসেবে তৈরি করতে শিশুকে অবশ্যই পড়তে শেখার এই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান চর্চা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাহলেই শিক্ষার্থীদের কাক্সিক্ষত ‘চিন্তার দক্ষতা’ অর্জন সহজতর হবে। সেভ দ্য চিলড্রেন রিড প্রকল্পের মাধ্যমে গবেষণা করে প্রমাণ করেছে, যদি কোনো শিশু বাংলায় একটি বর্ণও না চেনে, তবে সে কখনো স্বাধীন পাঠক হতে পারবে না। কেননা, ঐ না পারা বাংলা বর্ণটি কোনো শব্দে আসলেই সে আটকে যাবে। শুধু একটি ‘কার চিহ্ন’ না জানার কারণে শিশু একদিনের বাংলা পাঠে ২০-২৫ বার আটকে যায়। সঠিকভাবে পড়তে পারবে না। হোঁচট খাবে। তাই শুধু স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ চিনলে হবে না। কার চিহ্নগুলোও ভালোভাবে জানতে হবে।
আমাদের দেশে এক শ্রেণির উচ্চ শিক্ষিত ইংরেজি জানা মানুষ আছেন, যাদের সন্তানেরা ইংরেজি একসেন্টে বাংলা বলেন। উচ্চ পর্যায়ের আড্ডায় গর্ব করে তারা আবার বলেন, ‘আমি ল্যাবটপে বাংলা টাইপ করতে পারি না।’ উচ্চ শিক্ষিত ঐ সব মানুষেরা মত প্রকাশ করেন, ‘বাংলা ভাষায় ‘র’,‘ড়’,‘’ি, ‘ী’, ‘স’ এবং ‘শ’ ব্যবহার করে পাঠক, লেখকের মধ্যে ভ্রান্তির পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছে।’ তাদের কে বুঝাবে, ‘বারি’ আর ‘বাড়ি’ এক জিনিস না। কিংবা ‘বেশি’ আর ‘বেশী’ এক অর্থ বহন করে না। কে তাদের বুঝাবে ‘প’-এর আগে ‘সা’ যোগ করলে হয় ‘সাপ’ আর ‘প’এর আগে ‘শা’ যোগ করলে ‘শাপ’ হয়ে যায়। মুশকিল হলো, এ সমস্ত মানুষ সাধারণত সাপের কামড়ে মরে না, বরং তাদের কারণে বাঙালি জাতির কাঁধে অভিশাপের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ সংগীতে
‘ভালোবাসি’ শব্দে ‘ল’-এর সঙ্গে ওকার চিহ্নটি খুব একটা শখ করে বসাননি। তিনি জানতেন, ‘ভাল’ আর ‘ভালো’-এর অর্থ ভিন্ন। যারা অভিন্ন করতে চান ওরা সেই অভিশপ্ত মানুষের সঙ্গেই বসবাস করেন। কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদ নামে একটি প্রতিষ্ঠান মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ইকবাল দিবস পালনের সময়ে সভায় বক্তৃতাকালে মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াসিন সাহিত্যরতœ বলছিলেন, ‘বাবারা, বাঙালি আরবি, উর্দু, ইংরেজি যে ভাষাতেই পাণ্ডিত্য লাভ করুন না কেন, তারা চিরদিন স্বপ্ন দেখবেন বাংলায়। মাতৃভাষাই মানুষের প্রাণের ভাষা’। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। বিজ্ঞানী সত্যেন বোস তো আর না জেনে, না বুঝে বলেননি, ‘বাংলা ভাষা চর্চা করতে হবে। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা করতে হবে।’ অথচ এখন বিপিএলে (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) একদিন বাংলা ধারাভাষ্য প্রদান করে আমরা খুশিতে বাক-বাকুম করছি। উচ্চ আদালতে একটি রায় বাংলায় প্রদান করে আমরা পত্রিকার শিরোনাম করেছি। ভাবা হচ্ছে, এর মাধ্যমে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। মোটেই তা নয়। এসব একদিনের চর্চা না। পত্রিকায় শিরোনামেরও বিষয় না। জাতির জনক বহু আগে জাতিসংঘে বহু আগেই বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বাংলার আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর পরে তার সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করেছেন। এরপরে একদিনের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আত্মস্লাগার আর কোনো কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না। বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদানের মাধ্যমে বাংলার শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করেছেন। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক ধরনের হীনম্মন্যতা লক্ষণীয়। তারাও নিজেদের অক্ষমতাকে দক্ষতা হিসাবে প্রচারে সচেষ্ট থাকেন।
এখন দরকার প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষা চর্চা। শিশুদের মধ্যে বাংলা পাঠাভ্যাস সৃষ্টি করতে হবে। বাংলা ভাষা ভালো জানলে অন্য ভাষাও যে ভালো পারা যায়, তা পরীক্ষিত সত্য। আমাদের দেশে যারা বাংলা ভাষায় দক্ষ, তারা মূলত ইংরেজিতেও দক্ষতা প্রকাশ করেছেন। অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ড. অনুপম সেন প্রমুখ নিকটতম সময়ের উদাহরণ।
আমাদের সন্তানদের বাংলা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হলে সর্বাগ্রে নীতিনির্ধারকদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। তাদেরও বাংলা বিষয়ে প্রখর জ্ঞান থাকা জরুরি। তা না হলে বারে বারে ভুলে ভরা বই প্রণীত হবে। সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঠ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে গিয়ে দেখেছি, একাধিক প্রধান শিক্ষক দলীয় কাজে পোস্টার পেপারে ‘দুর্যোগ’, ‘দুর্লভ’ বানান লিখেছেন দীর্ঘ-উকার ব্যবহার (‘দূর্যোগ’, ‘দূর্লভ’) করে। এক্ষেত্রে আমরা কী আশা করতে পারি? এর মধ্যে আমাদের সন্তানেরা বাংলায় দক্ষ না হওয়ার কারণ নিহিত রয়েছে। যারা দক্ষ করে তুলবেন, তাদের মধ্যেই গলদ আছে।
বাঙালি বাংলা জানে না। এটা শুধু দক্ষতার বিষয় না। এটার সঙ্গে মানসিকতারও সংযোগ আছে। কারণ ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির নিবিড় মেলবন্ধন আছে। আমাদের সাংস্কৃতিক দেওলিয়াত্ব আমাদের বাংলা ভাষা শিক্ষার অগ্রগতি সাধন করতে দিচ্ছে না। বিষয়টা চেতনাগত। আমাদের ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা, কূপমণ্ডূকতা আমাদের বাংলা শিক্ষার পশ্চাৎপদতার কারণ। এ কারণে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না।
আমাদের সন্তানদের বাংলায় দক্ষ করে তুলতে হলে বাংলায় বিষয়ে শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাঠাভ্যাস গড়ে উঠলে শিশুরা ধীরে ধীরে স্বাধীন পাঠক হিসেবে গড়ে উঠবে। এজন্য তাদের নিয়মিত বইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নানান ধরনের ভ্রমণ কাহিনী, গল্প, কবিতা ছড়া, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি পড়তে দিতে হবে। বাংলা পাঠ্য বই বাঙালি শিশুদের মননের বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করবে।
বিদ্যালয় শিশুর বাংলা পঠন দক্ষতা বৃদ্ধির প্রধান কেন্দ্রস্থল হতে পারে। শিক্ষক হবে তার প্রধান সহায়ক। যদিও পরিবারেরও একটা বড় ধরনের ভূমিকা আছে। তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের এখনো পরিবারের প্রধানেরা প্রথম বা দ্বিতীয় জেনারেশনের শিক্ষিত প্রতিনিধি। শিক্ষার ক্ষেত্রে তারা এখনো নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পুরোপুরি পালন করতে পারছেন না। বেশিদিনের কথা শিশুদের জন্ম সাল ঠিক করে দিতেন শিক্ষকরা। আজো শিক্ষার্থীরা পড়া-লেখার ক্ষেত্রে শিশুরা শিক্ষকের নির্দেশনাকে বেশি অনুসরণ করে। আজো অভিভাবকরা সন্তানের শিক্ষার চাইতে বিয়ের বিশেষ করে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে বেশি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। তাই বিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিদ্যালয়ে এ জন্য লাইব্রেরি থাকতে হবে। যথেষ্ট পরিবারে বইয়ের জোগান থাকতে হবে। নিয়ম করে বই পাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রেণি পাঠদানে এর প্রতিফলন থাকা দরকার।
আমাদের সন্তানদের সার্বিক অর্থে বাংলায় দক্ষ করে তুলতে সার্বিক অর্থে একটি সাংস্কৃতিক গণজাগরণও গড়ে তুলতে হবে। আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যের ধারাকে প্রবাহমান রাখতে হবে। বর্তমানে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের ধর্মান্ধতা আর কূপমণ্ডূকতার কারণে। বাংলা পাঠদানে হীনম্মন্যতা, ভাষার অধিকার আন্দোলনের অজ্ঞতা আমাদের সন্তানদের কূপমণ্ডূক করে তুলছে।
মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায় করতে গিয়ে অনেক রক্ত ঝড়াতে হয়েছে। তাই ভাষা আন্দোলনকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। তা না পারলে সার্বিক অর্থে আমাদের সন্তানদের বাংলায় দক্ষ করে তোলা সম্ভব হবে না। বর্তমান সময়ের ব্যর্থতাও কিন্তু হৃদয়ে ধারণ করতে না পারার কিংবা না করার ফলাফল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়