প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩ , ১২:২১ পূর্বাহ্ণ
ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম কালজয়ী কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র অমর স্রষ্টা মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৪৬ সালে তার লেখা পুস্তিকা ‘বিপ্লব’ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র কংগ্রেসের কর্মী হিসেবে তিনি ব্রিটিশবিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং প্রত্যক্ষ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ‘সীমান্ত’ নামে তার সম্পাদনায় প্রগতিশীল মাসিক প্রতিবাদী সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে পত্রিকাটির দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা দুই বাংলার প্রগতিশীল আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করে। ১৯৪৮ সালে ‘সীমান্ত’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম ‘সংস্কৃতি বৈঠক’ গঠিত হয়। পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে তার সক্রিয় প্রচেষ্টায় গঠিত হয় প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ। ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম নজরুল জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় মাহবুব উল আলমের নেতৃত্বে। এটিই ছিল চট্টগ্রামের সর্বপ্রথম নজরুলজয়ন্তী, যা ছিল দাঙ্গাবিরোধী। অনুষ্ঠানের শেষে দাঙ্গাবিরোধী মিছিল বের করা হয়। ইতোপূর্বে তারই নেতৃত্বে ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হয়। দুই অনুষ্ঠানেই দুই কবির ছবি টাঙানো হয় তথাকথিত পাকিস্তান ভক্তদের চরম প্রতিবাদ উপেক্ষা করে।
সীমান্ত পত্রিকা যখন বের করা হয় তখন এই ভাষাসংগ্রামীর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। সীমান্তে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, পুস্তক পরিচয়, পাঠকের মতামত, বিশ্ব শান্তির ওপর ফিচার ও দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান লেখকদের মূল্যবান লেখার অনুবাদ প্রকাশিত হতো। অনুবাদ করতেন শওকত ওসমান, আহমদুল কবীর, সানাউল হক, মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রমুখ। পাবলো নেরুদা, খাজা আহমদ আব্বাস, ইছমত চুঘতাই, নাজিম হিকমত, কৃষণ চন্দর, ক্রিস্টোফার করডোয়েল প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য লেখকের অনুবাদ প্রকাশিত হতো। সীমান্ত ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী পত্রিকা। লেখালেখির বাইরেও দেশ এবং বিশ্ব শান্তির জন্য কাজ করেছে এই পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠান। ১৯৫০ সালে পারমাণবিক বোমা নিষিদ্ধকরণের দাবিতে চট্টগ্রামে সীমান্তের উদ্যোগে ‘বিশ্ব শান্তি’ পরিষদ গঠন করা হয়। সে সময় এই শান্তির পক্ষে সাত লাখ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়, যা বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের প্রধান কার্যালয় সুইডেনের স্টকহোমে পাঠানো হয়। সেই বছরই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে সীমান্তের শিল্পী-সাহিত্যিকরা রফিকউদ্দিন সিদ্দিকীকে সভাপতি ও মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে সম্পাদক করে শান্তি সম্মেলন নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তরুণদের নিয়ে শান্তিফৌজ গঠন করা হয়, যাদের কাজ ছিল পাড়া-মহল্লায় শান্তির বাণী প্রচার করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা। ওই বছরেই দাঙ্গার বিরুদ্ধে সীমান্ত বিশাল আকারে দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা প্রকাশ করে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সীমান্তের প্রায় ৪৮টি সংখ্যা বের করা হয়। এর মধ্যে তিনটি বিশেষ সংখ্যা বের করা হয়। ১) দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা, ২) চট্টগ্রামে ১৯৫১ সালের ১৬-১৯ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে বিভিন্ন সুশীল মানুষের বক্তব্য নিয়ে প্রকাশ করা হয় সাংস্কৃতিক সংখ্যা, ৩) আনবিক বোমা নিষিদ্ধকরণের দাবি সংখ্যা, যাতে চট্টগ্রামের খ্যাতিমান ব্যক্তি, লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক পেশাজীবীদের স্বাক্ষরসংবলিত একটি আবেদন ও প্রকাশ করা হয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরী সীমান্তকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশের পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেতনতামূলক একটি পত্রিকা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রমনা ময়দানে ইংরেজিতে সদম্ভে বলেছিলেন- ‘উর্দু একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ পূর্ব বাংলার মানুষ সেদিন ‘নো নো’ উচ্চারণে জিন্নাহকে জবাব দিয়েছিল। ভাষাসংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরী ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে সীমান্তের দ্বিতীয় সংখ্যায় দুঃসাহসিক সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে মাহবুব উল আলম ও সীমান্ত ইতিহাসের এক অনন্য দলিল, প্রতিবাদ ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল, যার সূতিকাগার চট্টগ্রাম।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিচারণ করে মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছেন- ২০ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন এলাকায় সভা সমাবেশ করে যখন অফিসে আসলাম তখন আমার গায়ে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর এবং গায়ে জলবসন্ত। কাজের উত্তেজনায় আমি এসব কিছু অনুভব করতে পারিনি। অসুস্থতার কারণে আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে আসেন সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তিনি একজন বড় সাংবাদিক। তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় ঢাকায় যোগাযোগ করে জানতে পারেন ছাত্র জনতার মিছিলের ওপর গুলি চলেছে এবং এতে অসংখ্য লোক মারা গেছে। আমি বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় যখন ঢাকার গুলির খবর শুনলাম তখন ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শ্রæতি লিখনের মাধ্যমে লিখে ফেললাম। ইতিহাস রচনা করে চট্টগ্রাম। কবিতাটি আন্দরকিল্লাহ কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে ছাপা হয়। মূল্য ছিল দুআনা। কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে পুলিশ হানা দেয়। প্রেসের করিৎকর্মা কর্মচারীরা কবিতার প্রæফ ও ম্যাটার দোতলায় লুকিয়ে রাখেন। তখন কবিতা ছাপানো হয়ে গেছে। পরদিন দুপুরের মধ্যে কবিতাটির মুদ্রিত ১০ হাজার কপি বিতরণের জন্য তৈরি হয়ে যায়। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় লালদীঘির জনসমুদ্রের সামনে চৌধুরী হারুনুর রশীদ দৃপ্ত কণ্ঠে কবিতাটি পাঠ করেন। সেøাগান, করতালি ও বিক্ষোভে প্রকম্পিত লালদীঘি। ওই দিনই সরকার কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কবিতা পড়ার অপরাধে ২৪ ফেব্রুয়ারি চৌধুরী হারুনুর রশীদ গ্রেপ্তার হন। ইতিহাসের পাতায় মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নাম উজ্জ্বল অক্ষরে লিখিত হয়ে যায়।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।