শিমুর মেয়েকে বাবা : ‘মা ভুল করেছি মাফ করে দিও’

আগের সংবাদ

স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি : যে ফর্মুলায় স্মার্ট বাংলাদেশ

পরের সংবাদ

বধির হওয়ার ঝুঁকিতে রাজধানীবাসী! নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দে অতিষ্ঠ মানুষ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আয়েন উদ্দীন : হাইকোর্ট বিভাগের বিজয় ৭১ এর একটি বেঞ্চে বিচারকাজ চলছে। বিচারপতি যখন একটি মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, একই সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সমাবেশ চলছে। এ অবস্থায় প্রচণ্ড শব্দ আসে কোর্টের ভেতরে। দরজা বন্ধ করে দেয়ার পরও উচ্চ শব্দ আসে আদালতের ভেতরে। ওই বেঞ্চের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে তলব করেন। ওই আদালতে শুনানি করতে যাওয়া আইনজীবী ফারুক হোসেন ও ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনও বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। ফলে বিচারকাজ দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকে। ঘটনাটি ঘটে চলতি মাসের ২ জানুয়ারি। শুধু আদালতই নয়, শব্দ দূষণের কারণে স্কুল-কলেজ-হাসপাতালে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক কার্যক্রম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে রাজধানীতে স্কুল-অফিস-আদালত ও হাসপাতালসহ জনসমাগম এলাকায় বিকট শব্দে সাধারণ শ্রবণশক্তি হারানোর ঝুঁকিতে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে নগরবাসীর বড় একটি অংশ বধির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানা যায়, শব্দ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। এই সংস্থার মতে, শব্দ দূষণের কারণে বয়স্ক, গর্ভবতী নারী ও শিশুরা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় ট্রাফিক বিভাগে কর্মরতদের ৫৬.৪% পুলিশ কানে কম শোনেন। এর মধ্যে শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে হারানোর পথে ৯.৫%। প্রায় ৮% পুলিশ কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর উচ্চ রক্তচাপ, মেজাজ খিটখিটে, মানসিক চাপ, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াসহ ক্লান্তিতে ভোগেন। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের অকুপেশনাল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সাইকা

নিজামের গবেষণা মতে, কানে কম শোনার সমস্যায় ভুগছেন ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ রিকশাচালক। ট্রাফিক পুলিশের ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং লেগুনাচালকের ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ একই সমস্যায় ভুগছেন।
রাজধানীর মতিঝিল, শাহবাগ, ধানমন্ডি, সংসদ এলাকা, মিরপুর-১২, কাকরাইল এলাকায় দায়িত্বরত একাধিক ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে ভোরের কাগজের আলাপ হয়। তারা সবাই কানের সমস্যায় ভোগার কথা বলেন। নাম প্রকাশ না করে শাহবাগ ট্রাফিকের এক সদস্য বলেন, কোনো কথা জানতে চাইলে প্রথমবার বুঝতে পারি না। একাধিকবার জিজ্ঞেস করতে হয়। জোরে না বললে শুনতে পাই না।
ভয়ংকর শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা না হলে রাজধানীর ৮০ শতাংশ মানুষ বধির হয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান। তিনি বলেন, এখন নতুন আরেকটা নিয়ম চালু হয়েছে। তরুণ ছেলেরা বিকট শব্দে মোটরসাইকেল চালায়। এতে আশপাশে থাকা শিশুদের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়। বৃদ্ধরাও আতঙ্কিত হয়ে যান। যারা হৃদরোগে আক্রান্ত তাদের জন্য এটি আরো ভয়ংকর। শব্দ দূষণের কারণে গর্ভবতী নারী ও শিশুরা আরো বেশি ঝুঁকিতে।
শব্দ দূষণে শীর্ষে ঢাকা
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) শব্দ দূষণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস এন্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রথম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। রাজশাহী রয়েছে তালিকার চতুর্থ স্থানে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, আবাসিক এলাকার জন্য গ্রহণযোগ্য শব্দের মানমাত্রা ৫৫ ডেসিবেল এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। সেখানে ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণের বেশি মাত্রার শব্দ সহ্য করছে রাজধানীবাসী।
সংস্থার মতে, ৩০টি কঠিন রোগের জন্য দায়ী ১২ রকম দূষণ, যার মধ্যে শব্দ দূষণ একটি। শব্দ দূষণের কারণে কানে কম শোনা, মাথাধরা, অনিদ্রা, হাঁপানি, খিঁচুনি, লেখাপড়া এবং কাজকর্মে অনীহাসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। অপ্রত্যাশিত বা আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশি সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘœ সৃষ্টি করে। শব্দ দূষণের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আইনে যা আছে
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ এর বিধি ৭ মতে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো এলাকার শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবে না এবং বিধি ৮ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি মোটর, নৌ বা অন্য কোনো যানে অনুমোদিত শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী হর্ন ব্যবহার করতে পারবে না এবং নীরব এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোনো প্রকার হর্ন ব্যবহার করা যাবে না। বিধিমালা অনুযায়ী শব্দের মাত্রা নীরব এলাকায় দিবাভাগে ৫০ এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকায় দিবাভাগে ৫৫ এবং রাতে ৪৫ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাভাগে ৭০ এবং রাতে ৬০ ডেসিবেল, শিল্প এলাকায় দিবাভাগে ৭৫ এবং রাতে ৭০ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হয়। এই বিধিমালায় শাস্তির কথাও উল্লেখ করা হয়। প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনা দেন। নির্দেশনায় ঢাকায় গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন ও উচ্চ শব্দযুক্ত হর্ন ব্যবহার বন্ধে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ ও এই হর্ন আমদানি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে; বাজারে থাকা সব হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করার বিষয়ে বলা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর অপর এক আদেশে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারকারী যান জব্দ ও হর্নগুলো জমা দিতে সময় বেঁধে দেয়া হয়। এরপর এক সম্পূরক আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট উচ্চ শব্দের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব সড়কে সার্ভিল্যান্স টিম গঠন করে তদারকির নির্দেশ দেন। সংশ্লিষ্ট সড়কগুলো হলো, রাজধানীর কাকরাইল-ভিআইপি সড়ক হয়ে মগবাজার, মৎস্য ভবন-শাহবাগ-সায়েন্স ল্যাবরেটরি-সংসদ ভবন হয়ে গাবতলী পর্যন্ত। তবে গত কয়েক দিন শাহবাগ-সায়েন্স ল্যাব-মালিবাগ ঘুরে কোনো সার্ভিল্যান্স টিমের তদারকি দেখা যায়নি।
তবে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট অব্যাহত রাখে পরিবেশ অধিদপ্তর। সংস্থাটি ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৩৯৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। এতে ২ হাজার ৪৪টি মামলা দায়ের করা হয়। জরিমানা করা হয় ২২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। হর্ন জব্দ করা হয় ১ হাজার ২৬টি।
এ বিষয়ে আবু নাসের খান বলেন, শুধু মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে শব্দ দূষণ বন্ধ করা যাবে না। পরিবেশ আদালতেও মামলা করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাছাড়া পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ের মাধ্যমে ভয়ংকর শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়