শিমুর মেয়েকে বাবা : ‘মা ভুল করেছি মাফ করে দিও’

আগের সংবাদ

স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি : যে ফর্মুলায় স্মার্ট বাংলাদেশ

পরের সংবাদ

গাইবান্ধার দুই ভাইয়ের সাফল্য : ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা থেকে বৃহৎ দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠানের মালিক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ফেরদৌস জুয়েল, গাইবান্ধা থেকে : গাইবান্ধার শ্রীকলা গ্রামের মোস্তফা শেখ (৩৬)। তার ছোটভাই জরিফ শেখ (৩৩)। দুই ভাইয়ের গল্পটা অন্যরকম। দুজনই জেলা শহরের বাসায় বাসায় দুধ বিক্রি করতেন। প্রতিদিন তিন লিটার দুধ বেচাকেনাই ছিল ভরসা। এখন বাসায় বাসায় দুধ বিক্রি করতে হয় না। ঘরে বসেই তারা প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার লিটার দুধ কিনছেন। তাদের দুধ দিচ্ছেন বিভিন্ন এলাকার প্রায় আড়াই হাজার খামারি। তিন হাজার লিটার দুধ নিজেদের কারখানার কাজে লাগাচ্ছেন। বাকি ১০ হাজার লিটার দুধ বিভিন্ন কোম্পানিতে বিক্রি করে আয় করছেন তারা। এজন্য তিনবিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। সেখানে তৈরি করছেন দই ও নানা প্রকার মিষ্টি। উত্তরাঞ্চলের মধ্যে ব্যক্তি মালিকাধীন বৃহৎ দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করণ খামার করে দুভাই এখন স্বাবলম্বী। তাদের খামারে ১৭৫ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
গাইবান্ধা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে সাদুল্লাপুর উপজেলার তরফবাজিত এলাকা।

এখানে গড়ে উঠেছে ‘শেখ দই ঘর’ নামে দুধ কেনাবেচা ও দুগ্ধজাত পণ্য বহুমুখীকরণ কেন্দ্র। কেন্দ্রটি সাদুল্লাপুর-মাদারগঞ্জ সড়ক ঘেঁষে অবস্থিত। ছোট পরিসরে ২০১২ সালে গড়ে ওঠে কারখানাটি। তা আস্তে আস্তে তিনবিঘা জমিতে পরিণত হয়। এই কারখানার দই মিষ্টি গাইবান্ধাসহ আশপাশের জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কেন্দ্রে ঢুকতেই মিষ্টি ও দইয়ের দোকান। এরপর বড় বড় চিলিং প্লান্টে (দুধ শীতলীকরণ প্রক্রিয়া) রাখা দুধ। এখানে খামারিরা গ্রাম থেকে দুধ এনে বিক্রি করেন। ভেতরে তৈরি হচ্ছে দই, ঘি ও নানা প্রকারের মিষ্টি। শ্রমিকদের কেউ দই তৈরি করছেন, কেউ মিষ্টি, কেউ সেগুলো বিক্রি করছেন।
যেভাবে শুরু : শ্রীকলা গ্রামটি সাদুল্লাপুর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত। গ্রামের সচ্ছল কৃষক ছিলেন আবু বকর শেখ। তার দুই ছেলে মোস্তফা শেখ ও জরিপ শেখ। ছোটবেলায়ই দুভাই বাবা আবু বকরকে হারান। তাই তাদের লেখাপড়া হয়নি। মোস্তফা শেখ অষ্টম এবং জরিপ শেখ ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব পড়ে দুভাইয়ের কাঁধে। বাধ্য হয়ে মোস্তফা শেখ শুরু করেন দুধের ব্যবসা। তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর। নিজের একটি গাভী ছিল। সেই গাভীর দুধ হতো আধা কেজি। বাকি আড়াই কেজি গ্রামের কৃষকের কাছ থেকে পাইকারিতে কিনেন। প্রতিদিন তিন কেজি দুধ নিয়েই বাইসাইকেলে চেপে বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গাইবান্ধা জেলা শহরে যান। তারপর শহরের বাসায় বাসায় দুধ বিক্রি করতেন। পরে তিনি ২০০৬ সালে একটি দুধের কারখানায় চাকরি পান। এরপর ছোটভাই জরিফ শেখ ১৬ বছর বয়সে বড় ভাইয়ের ব্যবসা শুরু করেন।
বর্তমান অবস্থা : মোস্তফা ও জরিফ শেখ ছিলেন ভ্রাম্যমাণ দুধ বিক্রেতা। সংসারে অভাব অনটন লেগেইছিল। পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে এখন তারা স্বাবলম্বী। ২০১২ সাল থেকে ঘরে বসেই দুধ কিনতে শুরু করেন। বর্তমানে তারা প্রতিদিন ১৩ হাজার লিটার দুধ কিনছেন। প্রায় আড়াই হাজার খামারি তাদের দুধ দেন। তিনবিঘা জমিতে দুধ কেনাবেচা ও দুগ্ধজাত পণ্য বহুমুখীকরণ কেন্দ্র। সেখানে দই, ঘি ও নানা প্রকার মিষ্টি তৈরি করছেন। তিন হাজার লিটার দিয়ে দই ও মিষ্টি তৈরি করছেন। বাকিটা বিভিন্ন কোম্পানিতে বিক্রি করছেন। এ থেকেও আয় হচ্ছে। তাদের অধীনে বর্তমানে ১৭৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন। দুই বিঘা বসতভিটায় পাকা বাড়ি ও প্রয়োজনীয় জমির মালিক হয়েছেন।
শেখ দই ঘর নামে দুধ ক্রয়-বিক্রয় ও দুগ্ধজাত পণ্য বহুমুখীকরণ কেন্দ্রে কর্মরত সাদুল্লাপুরের শ্রীকলা গ্রামের রানু মিয়া (৩০) বলেন, আগে দিনমজুরের কাজ করতাম। এখন মিষ্টি তৈরির কাজ করছি। আমার সংসারে অভাব নেই। রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকার সুজন মিয়া (২৫) বলেন, দই তৈরির কাজ করে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পাচ্ছি। এখানে কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে। সাদুল্লাপুর উপজেলার কলোনি এলাকার খামারি রাশেল মিয়া (৫০) বলেন, আগে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে দুধ বিক্রি করেছি। হাজার হাজার টাকা বাকি পড়েছিল। এখন ওই কেন্দ্রে প্রতিদিন ১০০ লিটার দুধ নগদ টাকায় বিক্রি করছি। একই উপজেলার পাটানোছা এলাকার খামারি এরশাদ মিয়া (৪৫) বলেন, আগে দুধ বিক্রি নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। এখন মোস্তফা ও জরিফ শেখের কেন্দ্রে প্রতি কেজি ৪৬ টাকা হিসেবে প্রতিদিন ১৫০ লিটার দুধ নগদে বিক্রি করছি।
এসব বিষয়ে মোস্তফা শেখ বলেন, ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থের চেয়ে খামারিদের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। তাদেরকে দুধের ন্যায্য দাম দেয়া হয়। ফলে খামার ব্যবসায় তারা লাভবান হচ্ছেন। দুধের ন্যায্য দাম পাওয়ায় স্থানীয়ভাবে খামারি বেড়েছে। জরিফ শেখ বলেন, কেজিপ্রতি এক টাকা লাভে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে আমরা দুধ বিক্রি করছি। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে দুগ্ধজাত পণ্য বহুমুখীকরণ কেন্দ্রটি মডেল হিসেবে গড়ে তোলা হবে। যাতে গরুর খামার স্থাপনে মানুষের আগ্রহ বাড়ে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
যৌথ পরিবরের গল্প : মোস্তফা ও জরিফের ১৫ সদস্যের সংসার। মোস্তফা শেখ তিন সন্তানের বাবা। বড়ছেলে রিয়াজ মিয়া সপ্তম ও বড়মেয়ে মুরশিদা প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে মুনিয়ার বয়স দুই। স্ত্রী রনজিলা বেগম গৃহিণী। জরিফ শেখেরও তিন সন্তান। বড়ছেলে রিফাত সপ্তম ও ছোটছেলে শাহজালাল প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে জান্নাতির বয়স তিন বছর। স্ত্রী সাথী বেগম গৃহিণী। মোস্তফা ও জরিফের বৃদ্ধ মা জরিনা বেগম (১০১)। তাদের দুই বোন আছমা ও মিনারা বেগম। তারা সবার বড়। তাদের বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে আছমা বেগম তিন সন্তান নিয়ে ভাইদের সংসারে থাকেন। এক হাড়ির রান্নায় সবার খাওয়া-দাওয়া চলে।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের ভূমিকা : প্রাণিসম্পদ বিভাগ প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ, সংগৃহীত দুধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ এবং দুগ্ধজাত পণ্য বহুমখীকরণে ভূমিকা রাখছে। গাইবান্ধা জেলায় দুধের বাজার ব্যবস্থা নিয়ে প্রাণিসম্পদ বিভাগকে বেশি ভাবতে হয় না। সাদুল্লাপুরের মোস্তফা ও জরিফ দুধের বাজার তৈরি করেছেন। জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মো. মাছুদার রহমান সরকার বলেন, দুই ভাইয়ের কারণে জেলায় দুধের উৎপাদন ও গরুর খামারের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি জেলার দুধের চাহিদা মেটাতে তারা অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। তাদেরকে সার্বক্ষণিক প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়