হাইকোর্টে বিএনপি নেতা খোকন ও মিলনের জামিন

আগের সংবাদ

ভোটের আগাম প্রচারে আ.লীগ : সভা-সমাবেশে উন্নয়ন তুলে ধরে নৌকায় ভোট চাওয়া হচ্ছে

পরের সংবাদ

শ্যাওড়া গাছের ভূতটা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অনেক অনেক কাল আগের কথা। তালপুকুর গ্রামে তুলসীগঙ্গা নদীর তীরে ছিল এক শ্যাওড়া গাছ। কালচে সবুজ ঝাঁকড়া ঘন ডালপালার গাছতলায় দিনের বেলাতেও অন্ধকার, গা ছমছমে ভাব। গাছের মগডালে থাকে গ্রামের ছোট-বড় প্রায় সবার চেনা ২০০ বছর বয়সি ঝালুমবুড়ো ভূতটা।
নদীর অন্য তীরে ছোট গাঁয়ে কুঁড়েঘরে মায়ের সঙ্গে বাস করে ৯ বছরের তোতা। বাবাকে কখনো দেখেনি সে, দুনিয়াতে নেই, দেখবে কোত্থেকে? শুনেছে বাবার সঙ্গে তার চেহারার ভীষণ মিল। তাই গোসলের সময় নদীর পানিতে নিজের ছায়া দেখে ভাবে বাপজান বুঝি এমন ছিল? পানির আয়নার ছায়া খানখান হয় মুহূর্তেই। দেখে সাধই মেটে না। গরিব মানুষ তারা। কাঠের কাঁকই চিরুনি থাকলেও ঘরে আয়না নেই।
টাকা উপার্জনের জন্য যথেষ্ট কষ্ট, পরিশ্রম করতে হয় তোতার মা জমিরনকে। তবুও নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ঘরসংসারের কাজকর্ম শেষে সারা দুপুর কাঁথা সেলাইয়ের কঠিন ধৈর্যের কাজ করে। নকশী কাঁথা সেলাইয়ে তোতার মায়ের হাত যশ, সুখ্যাতি পাঁচ গ্রামের মানুষ জানে। সাধারণত পরিষ্কার উঠানেই কাঁথা পেতে নেয় জমিরন। এরপর নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তোলে নানারঙের সুতার কারুকাজে ফুল, গাছ, লতা-পাতা। মায়ের সাহায্য হবে বলে পুরনো শাড়ির নানা রঙের পাড় থেকে তোতাও সুতা তুলে বাঁশের সরু কাঠিতে জড়ায়, সুঁচে সুতা পরিয়ে দেয়।
জমিরন পাড়া-পড়শিদের মাটির ঘর, উঠান তকতকে করে লেপতেও সিদ্ধহস্ত। গরুর গোবর দিয়ে অন্যদের চুলার জ¦ালানি ঘুটে নির্দ্বিধায় বানিয়ে দেয়। চৈত্র, বৈশাখে বাঁশের চাটাই ভরে বুড়ো সাদাটে চালকুমড়া, নানা জাতের মশলা মিশিয়ে মাশকলাই ডালের বড়ি দেয়া, সারা বছর খইমুড়ি ভাজা, ছাতু বানানো, ঢেঁকিতে আটা কোটা- যখন যে কাজ পায় তাই করে। কিন্তু এই অল্প টাকায় মা-ছেলের অভাব যায় না, বরং অভাব নিত্যসঙ্গী।
এর মধ্যে শীত কুয়াশায় মোড়ানো অগ্রহায়ণ মাসে মাঠে মাঠে ধান কাটা সারা। সোনা ধান উঠানে রোদে শুকানো শেষে সারা বছর ব্যবহারের জন্য গোলা ভরেছে সচ্ছল গেরস্ত। পৌষ, মাঘের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা উত্তরে বাতাসের সঙ্গে কনকনে শীত পড়লে গাঁয়ের এ বাড়ি ও বাড়িতে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে। স্বাভাবিকভাবে ছোটমানুষ তোতারও পিাঠ খাওয়ার সাধ হলো। মায়ের কোল ঘেঁষে আবদার করে- মা পিঠা খামু। মায়ের স্নেহ জিজ্ঞাসা- কী পিটা খাবু ক্যা বাপো?
তোতার চটপট উত্তর- তেল পিঠা খাবার মনাচ্চে মা।
তাই সই। ছেলের আবদারে মা পরদিন পড়শি বাড়ির ঢেঁকিতে ছোট্ট এক কাঠা নতুন সুগন্ধি চালের আটা কোটে। খুলুপাড়ার নগেনকাকার মোটাতাজা গরু দিয়ে টানা কাঠের ঘানির সরষের, তিলের তেল আধাপোয়া করে কেনে। গলায় দড়ি বাঁধা সরু লম্বাটে ছোট কাঁচের শিশিতে ভরে হাতে ঝুলিয়ে মা ও ছেলে বাড়ি ফেরে বিকেল বিকেল। পড়শি দবিরমামু সাপ্তাহিক হাট থেকে পোয়াখানিক খেজুরের গুড় এনে দিলে সেই রাতেই তোতার পিঠা খাবার সাধ হয়- মা হামার যি এখনই পিঠা খাবা ইচ্চা হচ্চে।
মা ছেলের জন্য পিঠার আয়োজনে ব্যস্ত হয়। লোহার ছোট্ট কড়াইয়ে ডুবো তেলে ভাজা ফুলকো পিঠার ম-ম গন্ধ। ঘরের বাইরেও ছড়িয়েছে নলেন গুড়ে তৈরি তেলপিঠার সুঘ্রাণ।
শীতের কনকনে বাতাস হেঁসেলের বেড়ার ফাঁকফোকর গলিয়ে ভেতরে ঢুকছে। মাটির মেঝেতে চটের মোটা বস্তা বিছিয়ে ল্যাটা পেড়ে বসেছে তোতা। বান্দর টুপিতে কান-মাথা ঢেকে, চাদরে গা মুড়ে আয়েশ করে পিঠা খায় সে। কুপিবাতির মৃদু আলো-আঁধারে চালের আটার ঘন গোলা পিতলের ডাব্বু চামচে ভরে গরম তেলে ছাড়ছে জমিরন। সঙ্গে সঙ্গে গোল ফুলের মতো পিঠা ভেসে উঠছে। অল্প ছোট এলাচ থেতো মেশানো পিঠা খেতে দারুণ মজা। সেই মজা যেন বুঝতে পেরেছে শ্যাওড়া গাছের ভূতটা। বেড়ার ফাঁক দিয়ে লোমশ কালো রঙের ময়লা হলদে বড়বড় নখঅলা দুটি হাত ঢুকিয়ে বাইরে থেকে নাকি স্বরে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো ভূতটা আবদার করে- তোঁতার মাঁ, ওঁ তোঁতার মাঁ, এঁকটা পিঁঠা দেঁ, খাঁই।
বড়সড় একটা পিঠা দিয়ে জমিরন জানায়- দাদু আবা আসিস না। অল্প কয়ডা পিটাই বানাসি যি মোনা। গরিব মানুষ হামরা।
কিন্তু এতে কিচ্ছু লাভ হয় না। লিকলিকে যেন তালগাছ লম্বু ভূতটা তখুনিই পাটকাঠির মতো শীর্ণ লোমশ হাতটা বাড়িয়ে আবার পিঠা চায়। বেড়ার ফাঁকে ভূতের লম্বা লকলকে জিব, ড্যাবডেবে গোল চোখে ঘরের ভেতরে দেখার চেষ্টা করছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দ্বিতীয় পিঠা দিতেই হলো। মা, ছেলে এবার আশ্বস্ত হয়, নদীর ওই পাড় থেকে ফের আসবে না বুড়ো নচ্ছার ভূতটা। কিন্তু এলো। একইভাবে দুই হাত বাড়িয়ে ঘ্যানঘ্যান আবদার করল- আঁরেকটা পিঁঠা দেঁনা।
লোবড়া, ছ্যাঁচড়াটা এত অত্যাচার করছে ইদানীং। রাতবিরাতে পোষা হাঁস-মুরগি, কবুতর চুরি করে নিয়ে যায় প্রায়। সেদিন নিয়ে গেছে আদরের বকরি ছানাটা। জমিরন ঋণ নিয়ে কিনেছে। অনেক যতœ-মমতার ছাগল তোতার। তাই মন খারাপ করে রেগে টং তোতা ঘোষণা দেয়- ও মা, হামি অক কোল পিটামু। কঞ্চি ভাংমু অর পিঠোত। ভূত হোসে তো কি হসে?
জমিরন হাসে- হয় হয়, বুজিসি, ভাংবুই তো! তুই যি বীরপুরুষ, সাহসী ছোল হামার!
ভূতটা আজ রাতে বেশিই বিরক্ত করছে পিঠার গন্ধে। তাই ভূতকে তাড়ানোর ফন্দি আঁটে নিরুপায় তোতার মা। আগুন ভয় পায় ভূতেরা। তাড়ানোর অন্য উপায় না জানায় জমিরন চুলা থেকে জলন্ত খড়ি তুলে এদিক-ওদিক নাচায়। জোরে বলে, তোর দুই হাতোত চ্যাপা ধরনু কিন্তুক! গেলু মরার ভূত? এবার ভয়ে কাবু ভূতটা গগনবিদারী চিৎকার করে, হাপুস নয়ন কাঁদে- তোতার মাঁ আঁর পিঁঠা খাঁবো না। ছ্যাঁকা দিঁস না। আঁঁগুন ভঁয় পাঁই।
খড়ির আগুন দেখিয়ে কাজ হলো। এই সুযোগে জমিরন অনুরোধ জানায়- আচ্চা দাদো ছ্যাকা দিমু না। কিন্তুক লদীর এই পাড়োত আর আসপু না বাপু, কয়্যা থুচ্চি।
ভূত রাজি, সে মানুষের দেশেই থাকবে না আর। প্রায় শত বছর হলো এখানে, এবার নিজের ভূতরাজ্যেই ফিরবে।
তার এই সঠিক সিদ্ধান্তের পুরস্কার হিসেবে আরেকটা তেল পিঠা দিল জমিরন। নিমেষেই অদৃশ্য হয় ভূত। তোতারাও রক্ষা পায় রাত দুপুরে ভূতের উটকো উপদ্রব থেকে। সেই যে চলে গেল আর কখনো আসেনি, ভূতটা প্রতিশ্রæতি রেখেছে।
– মাশ্হুদা মাধবী

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়