প্রধান শিক্ষককে পিটুনি : আ.লীগ নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি

আগের সংবাদ

ভোক্তা অধিদপ্তরের মতবিনিময় সভা : আমদানি স্বাভাবিক না থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে

পরের সংবাদ

শীতের কম্বল

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে শিমু! রাতটা তার একরকম খুব কষ্টে কেটেছে। ঘরে একটাই জীর্ণশীর্ণ কাঁথা আছে মাত্র, কিন্তু সেটাও জড়িয়ে দিয়েছে তার অসুস্থ মায়ের শরীরে। অবশ্য তাতেও লাভ হয়নি। কারণ ভাঙা কুঁড়ে ঘর থাকলেও, নেই সে ঘরে ভালো চালা! তাই তো ছাউনির ফাঁকে গলে পড়েছে শীতের শিশির। শীতকালেও সেই আষাঢ়ের মতো টপ টপ করে শিশিরে ভিজে গেছে ছেঁড়া কাঁথা আর বালিশ। আসলেও ওদের কাছে শীত-গ্রীষ্ম সবই সমান!
এবার হুক্কুর হুক্কুর কাশতে কাশতে জরিনা বেগম শিমুকে বলল, ‘মারে আমারে একটু চুলা থাইকা গরম কয়লা আইনা দিবি, অন্তত একটু হাত-পাগুলা ছেঁক দিতাম। ঠাণ্ডায় সব অবশ হয়া গেছেরে মা!’
‘ঠিক আছে’, বলেই আবার চিন্তার ভাঁজ পড়ল মেয়ের কপালে। কারণ চুলোয় তো আজ দুদিন ধরে হাঁড়ি চাপেনি! তাহলে কয়লা আসবে কোথা থেকে? গতকাল মায়ের মুখে যে এক টুকরো পাউরুটি তুলে দিয়েছিল শিমু, সেটাতো নিজের অষ্টম শ্রেণির বইগুলো কেজি দরে বিক্রি করেছে ওই বারী মিয়ার দোকানে। সেই টাকাতেই কিনেছিল ওটুকু। এছাড়া তার আর কিছু করারও ছিল না। সারাবছর মতিন মাতুব্বরের বাড়ি কাজ করে তার পড়ার খরচ চালিয়েছে জরিনা বেগম। ধানের বস্তা তুলতে গিয়ে মাজায় ব্যথা পেয়ে এক মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছে সে। আর বাবা তো শিমুকে রেখে চলে গেছে সেই ছোট্ট বেলায় সড়ক দুর্ঘটনায়। তাই তো দিনে তিনবার বেলতলায় কবরটা দেখে আসে, কাঁদে এবং দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। আজ আবার মাও অসুস্থ! ডাক্তার বলেছে, আর সেভাবে কাজকর্ম করতে পারবে না জরিনা বেগম। তাই তো শিমুও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে- আর স্কুলে যাবে না। মায়ের পাশে থাকবে, মায়ের সেবা করবে। কারণ সে ছাড়া তো তার মায়ের আর কেউ নেই! মাকে সে আর কষ্ট দিতে চায় না।
যাইহোক মায়ের কথা রাখতে ম্যাচটা হাতে করে বাইরে গেল শিমু। যদিও পা তার চলছে না, মনটাও চাইছে না এই শীতে হাঁটতে। তবুও মায়ের আবদার বলে কথা। কিন্তু সে কী! সমস্ত খড়ি শিশিরে ভিজে আছে। তাই সেভাবে আগুন ধরাতে পারল না শিমু। রাগে ম্যাচটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিল। এদিকে ঘরের ভেতরে হুক্কুর হুক্কুর করে কাশছে জরিনা বেগম! আর বলছে, ‘কইরে শিমু মা আগুনটা আন?’ এ কথা শুনেই মুখে ওড়না চেপে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো শিমু! ভাবতে লাগলে কী করবে, কী জবাব দেবে সে!
ঠিক এর ফাঁকে কানে ভেসে আসলো মাইকের সুর, ‘একটি বিশেষ ঘোষণা। আজ সকাল ১০টায়, মতিন মাতুব্বর তার নিজস্ব বাসভবনে দুস্থদের মাঝে কম্বল বিতরণ করবেন…।’
শুনেই লাফিয়ে উঠে দৌঁড়ে মায়ের কাছে গেল শিমু। ‘মা কোন কয়লা লাগবো না। তোমার না কম্বল গায় দেয়ার খুব শখ। আজকা মাতুব্বর চাচার বাড়িত কম্বল দিব। আমি অহনি গিয়া একটা কম্বল নিয়া আইতেছি।’
শুনে মাও খুব খুশি হলো। বললো, ‘যারে মা যা, তাড়াতাড়ি লইয়া আয়। মাতুব্বর সাহেব কইছিল গতবার দিবার পারে নাই। এইবার আমগোরে ঠিকই একটা কম্বল দিব।’
মায়ের কথা শুনে দৌঁড়ে চিলের মতো ছুটে গেল মাতুব্বরের বাড়ির উদ্দেশে। চোখেমুখে একটিমাত্র কম্বলের হাতছানি। পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা শতভাগ। কারণ তার মা এ বাড়িতেই কাজ করতে গিয়ে আহত হয়েছে। তাকে কম্বল না দিয়ে পারবেই না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও অন্তত একটি কম্বল অবশ্যই দেবে…।
বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভিড়। সবাই একে একে কম্বল নিয়ে হাসিমুখে ফিরছে। শিমু অবাক হলো- এখানে এমন লোককেও বিতরণ করা হলো, যাদের কেনার সামর্থ্য আছে। দেয়াও প্রায় শেষ। তবে আরো কয়েকটি কম্বল আছে। কী সুন্দর দেখতে! এমন একটা কম্বলই তার মায়ের পছন্দ। যাইহোক শেষমেষ মতিন মাতুব্বরের কাছে গিয়ে আমতা আমতা গলায় শিমু বলল, ‘চাচা মায়ের শরীরটা খুব খারাপ। শীতে খুব কষ্ট পাইতাছে। যদি একখান কম্বল দিতেন।’
মাতুব্বর বললেন, ‘ও এই কথা। আরে এই কম্বলের তো লিস্টি হয়া গেছে। লিস্টি অনুযায়ী বিতরণ করমু। আর এই লিস্টিত তো তোমার মায়ের নাম নাই। ঠিক আছে, তোমার মায়রে আগামী বছর একটা দিমুনে। ওহন যাও। আমার মেলা কাম আছে।’
এ কথা শুনে আর একটি কথাও বলল না শিমু। চোখ দুটো তার টলমল করতে লাগল। অবশেষে লজ্জায়, হতাশায়-অসহায়ের মতো ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আবার বাড়ির পথ ধরল। এখন শিমুর গতি একদম পিঁপড়ের মতো। যার চোখে ভাসছে শুধু অসুস্থ মায়ের মুখ! আর পেছনে ফেলে আসা কম্বল!

মো. আব্দুর রহমান
বালিয়াডাঙ্গা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়