পদ্মা সেতু : মোটরসাইকেল চলাচল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

আগের সংবাদ

আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ : বিশ্বকাপে অপ্রতিরোধ্য টাইগ্রেসরা

পরের সংবাদ

স্মাইল সেলার

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রতিদিন পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে শেষ বিকালটা আমি পাপড় ভাজার মতো চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। তারপর যখন সোডিয়াম লাইটগুলো জ্বলতে শুরু করে, তখন আমিও রাজকীয় পায়ে বুদ্ধিজীবীর ভঙ্গিমায় হেঁটে যাই গেটের দিকে। মনিরের দোকান থেকে একটা বিড়ি নিয়ে ধুমসে সুখটান দেই। আজকাল এই সুখটান দিলেই নিজেকে সম্রাট আকবর আকবর লাগে। একটা ভাব আসে। এই ঢাকা শহরকে নিজের সাম্রাজ্য ভাবতে ভালো লাগে। ক্যাম্পাসটাকে নিজের রাজপ্রাসাদ মনে হয়। একদিন ক্যাম্পাসে না এলে যেন আমার পেটের ভাত হজম হয় না!
আমি একটা নামি পত্রিকার ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছি। তাও বছর দশেক হবে। এই শাহবাগ, আজিজ সুপার মার্কেট, চারুকলা, ছবিরহাট, টিএসসি, কলাভবন, হাকিম চত্বর সবই আমার প্রাক্তন। তাই প্রাক্তনের প্রতি সেই মায়াটা এখনো রয়ে গেছে। সুতোয় টান পড়লেই ছুটে আসি। মাঝেমাঝে ক্যামেরার ল্যান্স ঘুরিয়ে দু’একটা ছবি তুলে গল্প জমা রাখি স্টোরেজে। আমি শৌখিন ফটোগ্রাফার না। ছবি বেচে পেট চলে। একলার পেট খুব ভালোই চলে। ক্যামেরার হাত আমার বরাবরই ভালো। সেটা ক্যাম্পাসের শেষের দিকে মিথিলাও স্বীকার করেছিল। তার সবচেয়ে প্রিয় ছবিগুলো আমারই হাতে তোলা। অথচ তাকে সেই নবীনবরণ অনুষ্ঠানে দেখেই তার জীবনের সেরা ছবিটা আমি গোপনে তুলে আমার বুকে বাঁধাই করে রেখেছিলাম। অথচ কোনোদিন সেই কথা জানতেও পারেনি সে। পারবেও না। কিছু কিছু চাওয়া থাকে যা অপ্রকাশিত। আর আমি তো তখন চাইতেও সাহস করিনি। মিথিলা এখন ভালোই আছে। সুখে আছে।
সন্ধ্যার ঠিক আগে ছবিরহাটের গেটের পাশে বসে খেলছে মিতু। বয়স ৪/৫ হবে হয়তো। তার হাতে স্মাইল ইমোজির একটা হলুদ বেলুন। কিছুক্ষণ আগে কিশোরী একটা মেয়ে কিনে দিয়ে গেল। বেলুনটার ভেতরে লাল-নীল বাতি জ্বলছে। বেলুনটা পেয়ে তো মিতু দারুণ খুশি। সেটা নিয়েই খেলছে। অদূরে মা জরিনা বানু ফুল বিক্রি করছে। চারুকলার এদিকটায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনেক গাড়িওয়ালা মানুষ আসে। ছবির হাটে বসে। আড্ডা দেয়, গান গায়। কেউ কেউ কলকিও টানে। তাই শাহবাগের সিগন্যাল ছেড়ে সন্ধ্যায় এদিকেই ফুল বেচে জরিনা। এইদিকে ফুল বিক্রির প্রতিযোগিতা কিছুটা কম। জরিনা শাহবাগে পেরে ওঠে না। তার ওপর মিতুকে নিরাপদে রাখার চিন্তা। নিয়তির হাতে মিতুর এই বেড়ে ওঠা। আমি মিতুকে বেশ ভালো করেই চিনি। ওর জন্মের রাত থেকেই চিনি। মিতুর মা জরিনা বানু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা পলিথিনে মোড়া ঘরে একা একা কাতরাচ্ছিল। কোথাও পড়েছিলাম- প্রসব ব্যথা নাকি সত্তরটা হাড় একসঙ্গে ভাঙার মতোই যন্ত্রণাময়! তখন সেই হাড়গুলোই ভাঙছিল জরিনার। ফুটপাত থেকে হঠাৎই আমার কানে আসে তার গোঙানির শব্দ। পরে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাই। হাসপাতালে নেয়ার কিছু সময় পরই মিতুর আগমনী চিৎকার। চোখ মেলে সে প্রথম আমাকেই দেখে। সেইদিন থেকে আমি মিতুকে চিনি। মিতুও আমাকে চেনে। একটা মায়া পড়ে আছে মেয়েটার প্রতি। মিথিলার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে হয়তো মিতুর মতো একটা মেয়ে থাকত। মিথিলা সেই কবেই বেলা বোস হয়ে গেছে আর আমি সেই অঞ্জন। বেকারত্ব- তুমুল ও জমাট প্রেমকেও সহসাই তরল করে দিতে পারে। তখন যে কোনো পাত্রে সেই প্রেমকে রাখা যায়। মিথিলাও বুদ্ধি করে ব্যবসায়ী ছেলের ক্যালকুলেটরে প্রেমের গুণ অঙ্ক কষে!
ছবিরহাটের বটতলায় বসে চা-টা খাচ্ছিলাম। গেটে একটা লাল টকটকা এলিয়ন গাড়ি এসে থামে। গাড়িটা একদম নতুন। গাড়ি থেকে একটা দম্পতি নেমে আসে। পা বাড়ায় শিখা চিরন্তনের দিকে। জরিনা দৌড়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ফুল নেয়ার জন্য খুব অনুনয়-বিনয় করে। কিন্তু সেই দম্পতিটার মন গলাতে পারে না। জরিনার হাসিমুখটা দ্রুতই ফ্যাকাশে হয়ে যায়। দম্পতি যেই সামনে হাঁটা শুরু করল হঠাৎই তাদের সঙ্গে থাকা পরীর মতো ছোট্ট মেয়েটা সেই রকম কান্না শুরু করে দেয়। গাড়িওয়ালা দম্পতি তো দারুণ মসিবতে পড়ল। মেয়েটা মুখে কিছু বলছে না। শুধু আঙুল দিয়ে ইশারা করে কান্না করছে। মেয়েটার বাবা বুঝতে পারল- তার কোলের পরীটা মিতুর হাতের স্মাইল ইমোজির সেই বেলুনটার জন্য কাঁদছে। মেয়েটার বাবা চারপাশে ভালো করে তাকাল। না। কোথাও কোনো বেলুন বিক্রেতাকে দেখা যাচ্ছে না। পরী মেয়েটার কান্নার গতি ক্রমশ আপার স্কেলে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে মিতুর দিকে এগিয়ে যায় গাড়িওয়ালা বাবা। জরিনা মিতুর কাছেই বসা। আজ বেচা-বিক্রি ভালো না। তাই তার মন কিছুটা খারাপ। লোকটা মিতুর দিকে একশ টাকার একখানা কড়কড়ে নোট এগিয়ে দিয়ে বলল- ‘এই নাও, পিচ্চি। তোমার বেলুনটা খুব সুন্দর। বেলুনটা আমাকে দিয়ে দাও।’
কথাটা শুনেই মিতু তার হাসিমাখা মুখটা হঠাৎই কালো করে ফেলল। ঈশান কোণে মেঘ করার মতোই। সে কিছুটা ঘুরে বসে বেলুন নিয়ে আপন মনে খেলছে। ইতোমধ্যে গাড়িওয়ালা বাবার কোলের পরীর কান্না মাত্রা আরো উচ্চ ধাপে পৌঁছে গিয়েছে। লোকটা আরো একটা নোট মিতুর দিকে এগিয়ে দিল। কিন্তু মিতু সাড়া দিচ্ছে না। এতক্ষণ জরিনা পাশে বসে চুপচাপ সব দেখছিল। একশ টাকার দুটি নোট জরিনার চোখে খুশির ঢেউ তোলে। কড়কড়ে নোট দুটি থেকে যেন সে গরম ভাতের গন্ধ পাচ্ছে। জরিনা খপ করে লোকটার হাত থেকে ২শ টাকা নিয়ে বলল, ‘স্যার, আরেকটা নোট দেন। আমি আপনেরে বেলুনডা দিতাছি।’
গাড়িওয়ালা সেই দম্পতির পরীর মতো মেয়েটা হাসছে। বেলুনটাতে লাল-নীল বাতি জ্বলছে। পরী মেয়েটা আপন মনে বেলুনটা নিয়ে খেলছে। এদিকে হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে মিতু। পরীর মতো মেয়েটার গলার চেয়েও উচ্চস্বরে কাঁদছে সে। জরিনার কাছে কান্না খুবই বিরক্তিকর লাগে। তাই সে রাগে মিতুর গালে দুটি বসিয়ে দিল। মিতু থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর আরো তিন চার পাঁচ গুণ জোরে সে কাঁদতে লাগল। আমিও ক্যামেরার ল্যান্সের ভেতর দিয়ে সবকিছু দেখছি। পাশেই কাপে বরফ ঠাণ্ডা চা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সোডিয়ামের লাইটের কিছু আলো কাপের ভেতর পড়তেই মনে হলো কাপে অবশিষ্ট চা আমাকে নিয়ে উপহাস করছে! যাক ছবিগুলো তুলে রাখলাম। আমার বাক্সে জমা হলো আরো কিছু গল্প। এই শহরে আমি তো গল্প বেচেই খাই…

রফিকুল নাজিম
মাধবপুর, হবিগঞ্জ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়