ঢাকা-ওয়াশিংটন : রোহিঙ্গা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা

আগের সংবাদ

একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি : শিক্ষার্থী পায়নি ২০০ প্রতিষ্ঠান

পরের সংবাদ

পাখিদের ঘরবাড়ি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সকাল থেকেই ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। তিনটা বড় বড় বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে ডুপ্লেক্স বাড়িটা। দুই কোটি টাকা খরচ করে টুকুর বাবা বাড়িটা বানিয়েছেন চার মাসও হয়নি।
টুকু পাশের বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে দেখছে ভাঙার দৃশ্য। এই বাড়িটা টুকুর বড় চাচার। ভাঙার নোটিস পাওয়ার পর ওরা বড় চাচার বাড়িতে ওঠে। টুকুদের প্রিমিও গাড়িটা বড় চাচার গ্যারেজে রাখা হয়েছে।
পর পর দুবার বাড়ি ভাঙার জন্য চিঠি দিয়েছিল রাজউক। বাবা ভাঙেনি। তাই রাজউকই উদ্যোগী হয়ে বাড়িটা ভাঙছে। ভাঙার খরচটাও টুকুর বাবার কাছ থেকে নেবে রাজউক।
যে জায়গায় ডুপ্লেক্সটা তৈরি করা হয়েছিল সেখানে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল- ‘প্রস্তাবিত শিশুপার্ক’। ছয়-সাতটা বড় বড় আমগাছ কেটে টুকুর বাবা বাড়িটা করেছিলেন।
টুকুর মনে আছে বাবা বড় চাচাকে বলেছিলেন, ‘দাদা আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, আমার অনেক উপরে যোগাযোগ আছে। একসময় টাকা-পয়সা খরচ করে পেছনের তারিখ দিয়ে জায়গাটা আমার নামে লিখে নেব।’
বড় চাচা বাবাকে নিষেধ করেছিলেন। বাবা শোনেননি বড় চাচার কথা।
টুকুদের টাকা-পয়সার অভাব নেই। এ রকম বাড়ি আরেকটা করতে কষ্ট হবে না। কিন্তু অনেক সুন্দরভাবে ডুপ্লেক্সটা তৈরি করা হয়েছিল। ভেতরের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনও করা হয়েছিল চমৎকারভাবে। সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে বুলডোজার। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। পুলিশও এসেছে অনেক। অনেক উৎসাহী মানুষ মোবাইলে ভাঙার দৃশ্য ধারণ করছে। কেউ কেউ হয়তো ফেসবুকে দেবে। ভাঙার দৃশ্য ভাইরালও হয়ে যেতে পারে।
টুকুর বাবা বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছেন- বুলডোজার কীভাবে আঘাত করে তার পছন্দের ডুপ্লেক্সটা ভাঙছে। প্রতিটা আঘাত যেন তার বুকে এসেই লাগছে।
এখানে একসময় আম বাগান ছিল। আমগাছের ডালে কত পাখি এসে বসত। বাসা তৈরি করত। আমের মৌসুমে আশপাশের বাড়ির মানুষ আম পেড়ে খেত। টুকুরা থাকত বড় চাচার এই বাসার নিচতলায়। রাতেরবেলা টুপ করে পাকা আম পড়লে দৌড়ে যেত টুকু কুড়িয়ে আনার জন্য। ছুটির দিনে আমগাছের নিচে বসে চাচাতো ভাইবোনদের সঙ্গে গল্প করত টুকু। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইত। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে সকালে ঘুম ভাঙত টুকুদের। সেই আম বাগানের সব গাছ এক এক করে টুকুর বাবা লোক দিয়ে কেটে ফেললেন। নিজে অনেক ক্ষমতাবান, কেউ কিছু বলবে না- এ রকম একটা দম্ভ নিয়েই গাছগুলো কেটেছিলেন।
টুকুর খুব খারাপ লাগছে, চোখ ভিজে যাচ্ছে নিজের অজান্তেই। দুপুরের খাবার খেতে বড় চাচি ডাকছেন টুকুকে। কিন্তু খেতে ইচ্ছা করছে না।
টুকু মিরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ে। ইশকুলের বন্ধুরা কী বলবে এখন! যারা প্রায়ই আসত ওদের ডুপ্লেক্স বাড়িটা দেখার জন্য। সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতো। ওরা এখন যদি জানতে চায় কেন ভেঙে ফেলা হলো ডুপ্লেক্সটা? কী বলবে টুকু তখন? বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই ভেবে মন খারাপ হচ্ছে। চোখ ফেটে যেন কান্না বেরুতে চাচ্ছে।
বারান্দার গ্রিলে একটা পাখি এসে কিচিরমিচির শব্দ করছে। কী পাখি ওটা? টুকু একবার তাকায় পাখিটার দিকে। ময়না নাকি শালিক?
পাখিটার দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে না টুকুর। ঘরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে।
গ্রিলে বসা সেই পাখিটা একসময় কথা বলে ওঠে। টুকুর ঘুম ভেঙে যায়। ঘরের জানালা দিয়ে পাখিটার দিকে তাকায়।
পাখিটা বলল, ‘টুকু তোমার মনে আছে তোমাদের ডুপ্লেক্সটা যেখানে তৈরি করা হয়েছিল সেখানে অনেক আমগাছ ছিল?’
‘হ্যাঁ মনে আছে।’ টুকু আস্তে করে জবাব দিল।
‘ওইসব গাছে আমাদের অনেক বাসা ছিল। আমরা সেখানে থাকতাম। তোমার বাবা এক এক করে আমগাছগুলো কেটে ফেলেন। গাছে আমাদের বাসাগুলোতে ডিম থেকে ফোটা অনেক ছানাও ছিল। সেগুলো তখনো ওড়া শেখেনি। গাছ কেটে ফেলায় মা পাখিরা মুখে করে ছানাদের নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সময়টুকুও পায়নি। ধুপধুপ করে গাছ কেটে ফেলায় আমাদের অনেক ছানা মারা যায়। আমাদের কেমন খারাপ লেগেছিল তখন, একটু চিন্তা করে দেখ।’
টুকু কিছু বলতে পারছে না পাখির কথা শুনে। ওর মনে পড়ছে ধারালো করাত দিয়ে এক এক করে আমগাছ কাটা হয়েছিল। তারপর ডালপালা ছেঁটে ট্রাকে গাছগুলো অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। পাখির কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে টুকুর।
পাখিটা আবার বলল, ‘এই জায়গাটা ছিল সরকারের। এখানে একসময় শিশুপার্ক করার কথা ছিল। শিশুরা এখানে খেলবে সে রকম ব্যবস্থা হতো। ঢাকা শহরে এ রকম জায়গা খুব কমই আছে। কত আমগাছ ছিল। কত আম ধরত। তোমরা খেতে পারতে। দৌড়ঝাঁপ করতে পারতে বাগানে। সেই পার্কের জায়গায় ডুপ্লেক্স বানানো হলো। এটা কি ঠিক হয়েছে টুকু?’
টুকুর মুখে কোনো কথা নেই। কী বলবে? পাখি যা বলছে সব সত্য।
পাখি আবার বলল, ‘আমাদের বাসাগুলো কত কষ্ট করে বানিয়েছিলাম। সেগুলো সব ভেঙে পড়েছিল এই মাটিতে। তোমরা ফিরেও তাকাওনি আমাদের দিকে। তোমার বাবা অনিয়ম করেছেন। অনিয়ম করে বেশিদিন ভালো থাকা যায় না।’
টুকু বলে উঠল, ‘আর ওসব কথা বলো না পাখি। আমার বাবা ভুল করেছেন। অনিয়ম করেছেন। আমি তার হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।’
পাখি বলল, ‘তোমার জন্য খুব খারাপ লাগছে। অনেকক্ষণ ধরে দেখছি তুমি কাঁদছ। আমরাও কেঁদেছিলাম। কেউ আমাদের সান্ত¡না দেয়নি। যাও, তোমার চাচি এসে তোমাকে দুপুরের খাবার খেতে ডেকে চলে গেছেন। খেয়ে নাও। আমি গেলাম।’ বলেই পাখি গ্রিল থেকে ফুড়–ৎ করে উড়ে গেল।
টুকুর ঘুম হঠাৎ করেই ভেঙে গেল। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এলো। গ্রিলের কোথাও সেই পাখিটা নেই। বারান্দার একপাশ থেকে আরেক পাশে এসে দেখল। না নেই। পাখিটা সত্যিই চলে গেছে।
পাখিটার সঙ্গে তা হলে এতক্ষণ স্বপ্নে কথা বলেছে টুকু? একটু খিদে পেয়েছে। বিকাল হয়ে গেছে। বুলডোজার ওদের ডুপ্লেক্স বাড়িটা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
টুকুর মনে পড়ছে পাখির কথা। ওদের অনেক সদ্য ফোটা ছানা মাটিতে পড়ে মারা গিয়েছিল, আমগাছগুলো যখন কাটা হয়। ছানাগুলোর মায়েদের তখন কী কষ্টই না লেগেছিল! শুধু কি গাছগুলো ধ্বংস করা হয়েছে? কতগুলো প্রাণও কেড়ে নেয়া হয়েছিল সে সময়।
টুকুর মনে হচ্ছে ইট-সুড়কি নয়, যেন এক একটা আমগাছ সারি সারি পড়ে আছে ওদের ডুপ্লেক্স বাড়ির জায়গায়। বুলডোজার গুঁড়িয়ে দিয়েছে ওদের বাড়ি। আর ওর বাবার নির্দেশে কাটা হয়েছিল আমগাছগুলো। নিরীহ প্রাণী বলেই ছানাদের সরিয়ে নেয়ার সময়ও পায়নি মা পাখিরা। আর মানুষ বলে আগেভাগেই অন্যত্র সরে এসেছে টুকুরা।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশে তাকায় টুকু। একঝাঁক পাখি কিচিরমিচির শব্দ করে সারি সারি উড়ে যাচ্ছে। এই পাখিদের ঘরবাড়ি কোথায়? টুকুর মনে প্রশ্নটা জাগল।
টুকুর এই মুুহূর্তে খুব মনে পড়ছে গ্রিলে বসা সেই পাখির কথাটা- ‘তোমার বাবা অনিয়ম করেছেন। অনিয়ম করে বেশিদিন ভালো থাকা যায় না।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়