‘রেজা বাহিনী’ থেকে রেহাই চান হোটেল ব্যবসায়ী

আগের সংবাদ

২৭ দফাই হবে ভোটের ইশতেহার : বিএনপির ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’ ঘষামাজার কাজ চলছে > নেয়া হবে সব স্তরের মানুষের মত

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ এর ৭ জানুয়ারির রাতে জীবনের শেষ পাকিস্তানের কারাভোগ শেষে মুক্ত স্বদেশ বাংলাদেশের উদ্দেশে চাকলালা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ১০ তারিখ দুপুর ১.৪১ মিনিটে তিনি ঢাকা বিমানবন্দর স্পর্শ করেন। গোটা বাংলাদেশ সঙ্গে সঙ্গে যেন আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে। প্রিয় নেতা জনগণের মধ্যে ফিরে এসেছেন- যাদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই লড়াই সংগ্রাম করে বারবার জেলে গেছেন। জনগণকে পরাধীন পাকিস্তানের অধীনে নয়, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকৃত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের বোধ, আকাক্সক্ষা এবং সচেতনতা তৈরি করেছিলেন। ২৬ মার্চ এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তিনি ঘোষণা দেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন…।’ তার এই ঘোষণার পর মানুষ ৭ মার্চে দেয়া তার ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবে রূপ দিতে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাকে পাকিস্তানি জান্তারা ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এটি কি তার জীবনের জন্য কারাবাস হবে নাকি মৃত্যু হবে, সেটি তার নিজের যেমন জানা ছিল না, দেশের মানুষেরও কোনো ধারণা ছিল না। তবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী বন্দি, যাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতায় বিচার করা পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের পক্ষে মোটেও সহজ কাজ ছিল না। কারণ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই পরিচিত হয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন গোটা জাতি যখন পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত এবং গণহত্যার শিকার হতে শুরু করে তখনই। কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার মতো নয়, বরং লড়াই, সংগ্রাম এবং যুদ্ধ করার মতো প্রস্তুতি নেয়া এক জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সূচিত জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের জন্য। সে কারণে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ তারিখে বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘শাস্তি’ পেতে হবে বলে দম্ভ করার পরও কি শাস্তি তিনি দেবেন সে কথা বলতে পারেননি। চেষ্টা করেছিলেন আগস্ট মাসে তাকে ট্রাইব্যুনালে তুলে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে গোপনে বিচার করতে, কিন্তু পারলেন না। ডিসেম্বরে যখন পাকিস্তানের পরাজয় অবধারিত, তখন আবার ইয়াহিয়া ট্রাইব্যুনাল বসালেন কারাগারের অভ্যন্তরেই। ১৬ ডিসেম্বর যখন ঢাকায় নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে, তখন ট্রাইব্যুনাল বন্দি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এক রায় প্রদান করেছিল বলে জানা যায়। কবরও খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে স্বয়ং ইয়াহিয়ার গদিই নড়েচড়ে যায়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ওই পরাজয়ের দায় ইয়াহিয়ার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া শুরু হয়। সুতরাং ইয়াহিয়ার সময় ছিল না স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতির কারাগারের অভ্যন্তরে তথাকথিত বিচারের রায় কার্যকর করা! স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে তখন গণতান্ত্রিক বিশ্ব দাঁড়ায়। কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির পক্ষে তখন সারাবিশ্বই নয়, এমনকি পাকিস্তানের জনগণও মুক্তির দাবি করে নতুবা পাকিস্তান এক নতুন সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো, রাজনৈতিক দল ও জনগণ উপলব্ধি করতে শুরু করে। সেখান থেকেই ভুট্টো ৩ জানুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রকাশ্যে প্রথম বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা উচ্চারণ করেন। ৭ জানুয়ারি রাতে ভুট্টো তাকে মুক্ত মানুষরূপে পাকিস্তানের বিমানে তুলে দেয়। অবসান ঘটল বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের ২৪ বছরের রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বশেষ ৯ মাস ১৩ দিনের বন্দিজীবন।
বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ বন্দিজীবন পূর্ববর্তী কারাভোগের জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। এখানে তার মৃত্যুর আশঙ্কা যেমন ছিল, আবার তার কারাজীবনকে কেন্দ্র করে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ছিল একদিকে চরম উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, আবার স্বাধীনতার মন্ত্রদাতার এক বিশেষ মহিমায় আসীন নেতার অবস্থানও। তার এই বন্দিজীবন আমাদের সত্যি সত্যি স্বাধীনতা দিয়েছিল। দুর্ভাগ্য আমরা তার এই ৯ মাস ১৩ দিনের কারাজীবনের অনেক কিছুই আজো জানতে পারিনি। ১০ জানুয়ারি আমরা তার ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ হিসেবে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করি। কিন্তু অনেক রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী এবং সমর্থকরা নীরব থাকে। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে না তখন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এমনকি কথাবার্তাও হয় না। তবে তারাও দাবি করে থাকেন, তারা নাকি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক দল। মেজর জিয়াউর রহমানের একটি বেতার ঘোষণাই বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষণার’ নামে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় তখন বারবার উচ্চারিত হতে থাকে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থান ১৯৭৫ এর পর থেকে আমরা দেখে আসছি, পৃথিবীও দেখে আসছে। এই অবস্থার অবসান কবে হবে?
বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গ্রেপ্তার করা থেকে মুক্তি দেয়া এবং ’৭২ এর ১০ জানুয়ারি ঢাকা ফিরে আসা পর্যন্ত ৯ মাস ১৫ দিনের ইতিহাস আমরা খুব কমই জানি। জানার চেষ্টা আমরাও তেমন একটা করিনি। তেমন উদ্যোগও এ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জাতিগতভাবে আমাদের ইতিহাস সচেতনতার অভাবই এর প্রধান কারণ। অথচ বিদেশিরা বেশ কিছু তথ্য তখনই উদ্ধার করেছেন, ইতিহাস রচনাও করেছেন। এরা হলেন- মার্কিন ইতিহাসবিদ ঝঃধহষবু ডড়ষঢ়বৎঃ- তঁষভর ইযঁঃঃড় ড়ভ চধশরংঃধহ:ঐরং ষরভব ধহফ ঃরসবং, ইংরেজ ইতিহাসবিদ ও লেখক জড়নবৎঃ চধুহব- গধংংধপৎব: ঞযব ঞৎধমবফু ধঃ ইধহমষধ উবংয ধহফ ঃযব চযবহড়সবহড়হ ড়ভ গধংং ঝষধঁমযঃবৎ ঞযৎড়ঁমযড়ঁঃ ঐরংঃড়ৎু, ভারতীয় বাঙালি কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক ব্যানার্জী ভারত, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান (অজানা তথ্য)। বাংলাদেশের দু’একজন কূটনীতিবিদের সাক্ষাৎকার ও লেখায় কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার এবং এইচ টি ইমামের দুটি বইতেও কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সবার দেয়া তথ্যানুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৯৭১ এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে সরাসরি সেনানিবাসে নিয়ে আসা হয়। এখানে অজ্ঞাত স্থানে তাকে রাখা হয়। ২৮ মার্চ তাকে প্রথমে করাচি, পরে সেখান থেকে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ এবং সেখান থেকে মিয়ানওয়ালি কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। সেখানে তার কারাজীবন সম্পূর্ণরূপেই গোপন রাখা হয়েছিল। তাকে মিশতে দেয়া হয়নি অন্য কোনো কারাবন্দির সঙ্গে। পত্রপত্রিকা পড়া তার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কারাকক্ষেই তিনি অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকতেন। গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করাই ছিল সরকারের মূল ইচ্ছা। কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের ইচ্ছাই পালন করেছিল। ১৯৭১ এর আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে বিচারের একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। এটি কিছুটা জানাজানি হলে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ওপরে চাপ আসতে থাকে। সেটিকে আরো বৃদ্ধি করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে বের হন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার এবং গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর তিনি বঙ্গবন্ধুর বিচারের নামে প্রহসন বন্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে সবাইকে অনুরোধ করেন। বলা চলে সেই সময় ইন্দিরা গান্ধীর একক প্রচেষ্টাতে পশ্চিমা দুনিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সরকার গোপনে বিচারের নামে যে প্রহসন করছিল, সেটি অনেকটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এ সময় রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলাযুদ্ধ এবং জনগণের জনযুদ্ধ চারদিক থেকে বেগবান হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহা বাড়িয়ে দেয় এবং পাকিস্তানের সরকারকে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাগণ সেই হুঁশিয়ারির কথা বারবার জানাতে থাকেন। নভেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ আরো সুসংগঠিত হতে থাকে। ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনী গঠনের চুক্তি করে। এর ফলে পাকিস্তান ভারতের প্রতি তাদের বৈরী আচরণ আরো বাড়িয়ে দেয়। ৩ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের পক্ষে ভারতের সরকার ও জনগণের পাশে থাকার কথা উল্লেখ করেন। তিনি জনসভাতে জানতে পারেন যে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা করেন। পাকিস্তান চেয়েছিল বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যে যুদ্ধ চলছিল সেটিকে আড়াল করতে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে তাদের উদ্দেশ্য ভিন্নভাবে সফল করতে। কিন্তু সেই সুযোগ পাকিস্তানের হয়নি। বাংলাদেশের সরকার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর মিলিত শক্তি মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে সুসংহত করতে আবেদন জানায়। ভারত ৬ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে সর্বত্র পর্যুদস্ত করতে থাকে এবং ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর নিকট পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। ঠিক সেই সময়েই ইয়াহিয়া খানের গঠিত সামরিক ট্রাইব্যুনাল মিয়ানওয়ালি কারাগারে শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ডে রায় প্রদান করে, তার জন্য সেখানে কবরও খোঁড়া হয়। কারাগারের ডিআইজি রহমান সেই সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে তার সম্মতিতে গোপন আরেকটি কক্ষে সরিয়ে রাখেন। রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আগে থেকেই সুসম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধুকে অন্য কক্ষে সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে রহমান তাকে জানান যে ঢাকায় নিয়াজীসহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করার বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় এখানকার মানুষজন নিয়াজীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে কারাগার আক্রমণ করতে পারে। সুতরাং তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য রহমান তাকে সরিয়ে রাখতে চান। বঙ্গবন্ধু এর মাধ্যমেই ঢাকার সুসংবাদটি বুঝে ফেললেন। ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের পর সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক বিদ্রোহ সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়। ইয়াহিয়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে নড়বড়ে হয়ে যায়। সেই অবস্থায় তিনি সামরিক এবং জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করলে ভুট্টো ২০ তারিখ তা গ্রহণ করেন। ভুট্টো ক্ষমতাগ্রহণ করেই ইয়াহিয়াকে গৃহবন্দি করেন এবং ৭ জন উচ্চপদের জেনারেলকে চাকরিচ্যুত করেন। ২১ ডিসেম্বর তারিখে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এমন একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই প্রথম বঙ্গবন্ধুর জীবিত থাকা নিয়ে কোনো সংবাদ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তার মুক্তির ব্যাপারে তখন চারদিক থেকে ভুট্টোর ওপরও চাপ আসতে থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোও তখন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে মুক্তি দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। ভুট্টো ২৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঢাকা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা তথ্য দেন। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে জানান যে ঢাকা ভারতীয় ও সোভিয়েত সেনাবাহিনী দখল করে রেখেছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন, ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা গ্রহণ করতে রাজি আছেন। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর কোনো কথারই তেমন কোনো জবাব দেননি এবং তিনি ঢাকা সম্পর্কে কিছুটা অবহিত আছেন সেটিও তাকে বুঝতে দেননি। ভুট্টোকে শুধু তিনি দ্রুত ঢাকায় যেতে চান সে কথাই জানান। ভুট্টোকে বঙ্গবন্ধু কামাল হোসেনকে তার কাছে রাখার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। ২৮ তারিখ কামাল হোসেনকে গেস্ট হাউসে থাকার জন্য নিয়ে আসা হয়। ধারণা করা হয়ে থাকে ২৯ তারিখে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি কনফেডারেশন গঠন করার বিষয়ে আলোচনা করতে গেস্ট হাউসে আসেন। বঙ্গবন্ধু এসব কথায় কোনো সম্মতি প্রদান না করে ঢাকায় দ্রুত আসার তাগিদ দেন। ভুট্টো চেষ্টা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে সিহালা গেস্ট হাউসে রেখে কনফেডারেশন গঠনের মতো তেমন কিছু আদায় করে নিতে। কিন্তু ততক্ষণে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য চারদিক থেকে চাপ বাড়তে থাকে। ৭ জানুয়ারি রাতে ভুট্টো চাকলালা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু ও ড. কামালকে পিআইর একটি বিমানে তুলে দেন। তখনো তিনি বঙ্গবন্ধুকে কনফেডারেশনের পক্ষে অনুরোধ জানান। পিআইর বিমানটি লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে ৮ তারিখ ভোরবেলা অবতরণ করে। ততক্ষণে বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে পৌঁছানোর খবর পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি হোটেল ক্ল্যারিজে ওঠেন। সেখানে অসংখ্য বাঙালি এবং বিদেশিরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওইদিনই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তার দপ্তরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় আনার জন্য জন্য ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের একটি বিমানের ব্যবস্থা করে। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগটি হাতছাড়া করেননি। এর মাধ্যমে ব্রিটেনের স্বীকৃতির মনোভাব প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ড. কামাল হোসেন এবং ভারতীয় লন্ডনস্থ কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক ব্যানার্জী ছিলেন। ব্যানার্জীর সঙ্গে বিমানে ১৩ ঘণ্টা ভ্রমণকালে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের অনেক কিছু যেমন অবহিত হন, একইসঙ্গে বাংলাদেশে তিনি ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় পদ্ধতি চালু করতে আগ্রহী, তিন মাসের মধ্যে ভারতের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেয়াসহ নানা বিষয়ে শশাঙ্ককে অবহিত করেন। দিল্লি বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাকে অভ্যর্থনা জানান, সেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধীর মনোভাব শশাঙ্ক ব্যানার্জীর মাধ্যমে জানানো হয়, দিল্লি বিমানবন্দরে তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। এরপর তিনি ওই বিমানে ঢাকায় ফিরে আসেন। লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে ঢাকা শহর, সেখানেই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মঞ্চের আদলে তৈরি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ১৭ মিনিট এক আবেগঘন বক্তৃতা প্রদান করেন। তাতে তিনি তার জীবনের স্বপ্ন পূর্ণ হওয়ার কথা যেমন জানিয়েছেন, একইভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নীতি কি হবে তা জানান দেন, সব গণতান্ত্রিক সরকার এবং জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ভুলে যাননি ভুট্টোকে বলে দিতে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু এই রাষ্ট্র বিনির্মাণে তার পরিকল্পনার কথা জানান।
বঙ্গবন্ধু যদি ফিরে না আসতে পারতেন তাহলে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা শক্তি ১৬ ডিসেম্বরে অর্জিত বিজয় নস্যাৎ করে দিতে বিন্দুমাত্র দেরি করত না। দেশের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করতে অনেকেই ওত পেতে ছিল। সেই পরিস্থিতিতে তার শারীরিক উপস্থিতি সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যেমন অপরিহার্য ছিল, সেটি ঘটেও ছিল। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতায় বাংলাদেশ টিকে থাকার অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠতে থাকে। মানুষ ৯ মাসে হারানো বেদনা, ক্ষত ভুলে গিয়ে নেতা বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। এখানেই নেতা ও জনতার ঐতিহাসিক মেলবন্ধন, রাষ্ট্র নির্মাণের প্রধান শর্ত পূরণ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেটি বাংলাদেশেও ঘটেছে। ইতিহাসের এই সত্যকে মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করতেও হবে, শিখতেও হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়