প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরি মেলা

আগের সংবাদ

গুচ্ছের ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়নি : অনিশ্চয়তায় ২১ হাজার শিক্ষার্থী

পরের সংবাদ

কোনো এক জোছনায়

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশ এখন ঝাঁট দেওয়া উঠানের মতোই পরিষ্কার। গুরুদয়াল কলেজের মাঠে জনমানবের বিস্তৃত ঢেউ। কেউ এসেছে পুরো পরিবার নিয়ে, কেউ এসেছে প্রেমিকা নিয়ে। সবাই এসে মিলিত হয় মাঠলাগোয় মুক্তমঞ্চের গোল চত্বরে। এর পাশেই আকাশছোঁয়ার প্রত্যয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আটতলাবিশিষ্ট ওয়াচ টাওয়ার। সেই টাওয়ারের নিচে প্রতি বিকেলে তৈরি হয়ে অসংখ্য যুগলের জটলা। সবাই যে কেবল টাওয়ারের নিচেই জড়ো হয় ব্যাপারটি সে রকম নয়। অনেকে অনেক দূরত্বের জিনিস দেখবে বলে সিঁড়ি ভেঙে উঠে যায় সবচেয়ে উপরের তলায়। বিদিতা আজ দূরের জিনিস দেখবে না। তাই সে নিচতলাতেই দাঁড়ায়। অপেক্ষা করে মাহমুদের জন্য।
আজই শেষ দেখা মাহমুদ-বিদিতার। এরপর বিদিতার চলে যাওয়ার দিন। বিপন্ন মাহমুদ কেমন করে এক সমুদ্র দুঃখকে আঁজলা ভরে পান করবে, তাই এখন ভাবছে বিদিতা। কী সুন্দর একটি স্বপ্নজমিন ছিল তাদের; প্রণয় সুধায় ভরে থাকতো সে জমিন, জমিনের আল! অথচ আজ সেই জমিন ঘিরেই রচিত হতে যাচ্ছে এক কবরখানা। ‘আহ্, মাহমুদের একটা চাকরি হয়ে গেলেই হতো’- বিদিতার চোখে জল। ওড়না দিয়ে অবাধ্য সেই চোখের জলকে মুছতে গেলেই অশ্রæতে-কাজলে মাখামাখি হয়।
বিদিতার কাজলে আঁকা চোখ দুটো মাহমুদের খুব প্রিয়। শেষবেলায় এমন বিচ্ছিরি চোখ সে দেখাতে চায় না। তাই সে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে আনে হাত-আয়না। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে আবার তাতে কাজল আঁকে। কপালের ঠিক মাঝখানে সাঁটা লাল টিপটার অবস্থান ঠিক করে নেয় বিদিতা। ঠোঁটযুগলে ঘষে নেয় আরেকপ্রস্ত গোলাপি লিপগøস। ডেটিংয়ের সময় মাহমুদ প্রায়ই বিদিতিকে বলে, ‘তোমার ঈষৎ গোলাপি ঠোঁটে কী যেন মধুমাখা।’ এমন প্রশংসায় বিদিতার গালের রং বদলে যায়। লজ্জারাঙা লাল আভা তার গালে গালে ছড়িয়ে যায়। আজও কি এমন হবে? এমন করে কি আজও মাহমুদ বলবে? টাওয়ারটার উত্তর পাশেই লেক। সেই লেকের জলে ভাসতে থাকা অজস্র অতিথি পাখির ঝাঁক। সেই ঝাঁকের দিকে আনমনে তাকিয়ে সে ভাবে।
মাহমুদ প্রায়ই বিদিতার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তাই সে মাহমুদকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী চাই তোমার?’ মাহমুদ তখন স্মিত হেসে বলে, ‘তেমন কিছু চাই না আমার। এমন একজোড়া চোখ হলেই চলবে।’ মাহমুদের এমন আলাপে বিদিতা ভাষা হারিয়ে ফেলে। এমন আরও অনেক অনেক আনন্দ-বেদনা, মান-অভিমানের কাব্য করে চলতে থাকা সম্পর্ক-ট্রেনটা হুট করে থেমে যাবে কে ভাবত? বিদিতা কি মাহমুদের হাত ধরে পালাতে পারত না? তবে কেন সে পালাচ্ছে না? পরিবার, বাবা-মায়ের সম্ভ্রমের কাছে নিজের ব্যক্তিসুখ কি এতই তুচ্ছ? বিদিতার এত সাহস হয় না। সে তার ব্যক্তিগত সুখ বিসর্জন দিতে রাজি।
মাহমুদও তাকে আটকায় না। বরং তার বিরহে ভরা উদাস কণ্ঠ, ‘যাও, তোমার যেখানে যাওয়ার। আমি তোমায় বাধা দেব না।’ সম্পর্কের বয়স তিন বছর হলেও পরিচয়, চেনাজানার বয়স তো বছর দশেকের কম হবে না। বিদিতা তো আগেই জানত- মাহমুদ এমন উদাস-অভিমানী। বিদিতার নিখাদ প্রেম ও বন্ধুত্ব কি তার সমস্ত উদাসীনতা ভাঙাতে পারে না? মাহমুদ কেন সমস্ত পথ আটকে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বলে না, ‘বিদিতা, তুমি শুধু একান্তই আমার?’
আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো মানুষের ঢলে মুক্তমঞ্চের তল্লাট সয়লাব। অজস্র মানুষের ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসা মাহমুদকে দূর থেকেই শনাক্ত করতে পারে বিদিতা। পরনের উজ্জ্বল কমলা রংয়ের টি-শার্টে আঁকা মুক্ত পায়রার রেখাগুলো সাদা প্রিন্টের মধ্যেই আটকে আছে। মুদ্রিত পায়রাদের দল বাতাসে আর উড়তে পারছে না। আজ উড়বে বোধ হয়- বিধ্বস্ত বিদিতার মন দার্শনিক হয়।
মেলার মতো ভিড়ের মধ্যে বসার কোনো জায়গা মেলে না তাদের। অগত্যা আরেক যুগলের সঙ্গে বেঞ্চি ভাগাভাগি করতে হয়। হটপট থেকে বের করে আনা সদ্য রান্না করা নুডলস থেকে এখনো ধোঁয়া উঠছে, মসলার ঘ্রাণ আশপাশের মানুষকে ভালো করেই সুড়সুড়ি দিচ্ছে। টনক নড়াতে পারছে কেবল মাহমুদের জিভ বা তার ইন্দ্রিয়কেই। এতকাল যে সুস্বাদু নুডলসে মাহমুদ রসনাবিলাস করে এসেছে, সেই নুডলস আজ কেন এত বিস্বাদের! মাহমুদ ভেবে পায় না।
মাহমুদ দেখে- বিদিতার অনামিকায় রিংটা বেশ ঝিকমিক করে ওঠে। মাহমুদ আলতো করে সেই রিংটাতে ছোঁয়। কী ভেবে আবার হাতটাকে ফিরিয়ে আনে। বিরহে, বেদনায় বিদিতার চোখ বিস্ফোরিত হওয়ার জোগাড়। তবু সে কাঁদে না। কেন কাঁদে না- তার কারণ সে নিজেও জানে না। মাহমুদের আচমকাই কান্না পায়। সে খুব নীরবে কেঁদে যায়।
বিদিতার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নেয় সে- এই শহরে আর এক মুহূর্তও নয়। তাই সে ঢাকায় বাসা নেয়। যে শহরে এত এত স্মৃতির বিমূর্ত মূর্তি আঁকা, সে শহর মাহমুদের জন্য বেদনার বিরানভূমি হতে পারে। এমন আশঙ্কাতেই সে শহর ছেড়ে পালানোর প্ল্যান করে।
পুরুষদের কাঁদতে নেই জেনেই মাহমুদ শামুকের মতো গুটিয়ে নেয় নিজেকে। সন্ধ্যায় উড়ে আসে অনেক জ¦ালাধরা পোকা। এসবের একটি চোখে পড়লে আর রক্ষে নেই। তীব্র জ¦ালা হয় চোখে। এমনই পোকাপড়া চোখ কচলানোর মতো করে দু’হাতের পিঠ দিয়ে ঢলতে থাকে চোখ। বিদিতা আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখে। নিজেকে সংবরণ করতে পারছে না বিদিতা নিজেও। বর্ষার স্রোতে পাড়ভাঙা ঢেউয়ের মতোই ভাঙছে কেবল বুকের ভেতর। ধসে যাওয়া বুকের ভেতরকার চাপাকান্না মুহূর্তেই সশব্দে ফেটে বেরুলে বিদিতা মাহমুদকে জড়িয়ে ধরে। তখন বিদিতার মনে হয়, আয়োজন করে সব হলেও অন্তত বিচ্ছেদ পর্বটা আয়োজন করে হয় না। হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে দুজনই। ঠিক এই মুহূর্তে এসে বিদিতা মত পাল্টায়। সব সময় পুরুষরা সাহসী হবে- এমন তো কথা নেই। দোষ কী মেয়েরা এগিয়ে এলে? সহসাই বিদিতার চোখে খেলে সম্ভাবনার ঝিলিক।
‘কাল তুমি ঢাকা যাচ্ছো না? টিকেট কয়টা কেটেছো?’ জানতে চায় বিদিতা। ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে মাহমুদ, ‘একটা। কেন? টিকেট দিয়ে কী করবে তুমি?’ বিদিতা সেই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। মাহমুদকে উল্টো প্রশ্ন করে, ‘আরেকটা টিকেট কাটতে পারবে না তুমি?’
মাহমুদ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। খানিকটা নীরব থেকে তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, কাটতে পারব তো! কিন্তু কেন?’ তাহলেই হলো বলে বিদিতা আর কোনো কথা বলে না।
প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে মাহমুদের হাতটা ধরে। হাতে হাত রেখে সে ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে থাকে। পৌরসভার ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলে ওঠে মাথার উপর, তার উপরে ঝুলছে এক আধখানা চাঁদ।

জমাতুল ইসলাম পরাগ
নগুয়া, হোসেনপুর রোড, কিশোরগঞ্জ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়