‘মুগ্ধ নয়নে’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন

আগের সংবাদ

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ : বাংলাদেশে তুরস্ককে আরো বিনিয়োগের আহ্বান

পরের সংবাদ

অর্থনীতির সাত চ্যালেঞ্জ : বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ > ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন > খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ > মূল্যস্ফীতি > বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ > কর্মসংস্থান > দেশীয় শিল্পে সংকট

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাবকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে যেতে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল দেশ। এ লক্ষ্য নিয়ে ২০২২ সাল শুরু করলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়। এ সংঘাতের প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে, বাংলাদেশ সরকার সা¤প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বাধ্য হয় যা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় বলেও অভিহিত করা যায়। বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর ২০২৩। এমন পরিস্থিতিতে নতুন বছরে বাংলাদেশকে আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এর বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনের উত্তাপ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনিশ্চয়তা ও বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তবে দ্রুততার সঙ্গে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা গেলে দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, শিক্ষা কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনা এবং করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের মোকাবিলা নতুন বছরের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
জানা গেছে, বিদ্যমান বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিবেশের কারণে নতুন বছরে দেশে অর্থনীতিতে কঠিন চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে। পাশাপাশি টাকার মান আরো কম ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এতে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে ভোগান্তি বাড়বে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগের গতি হবে মন্থর। বাড়বে খাদ্য সংকট। ফলে স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সক্ষমতা হারাবে অনেক মানুষ। এক কথায় বলা যায়, নতুন বছরে অর্থনীতিতে সাতটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন-

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বাড়বে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তি, মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়া, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বড় ধাক্কা সামাল দিতে হবে, বিনিয়োগ কমে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়া, আমদানি কমায় দেশীয় শিল্পে সংকট আরো বাড়ার নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি স্থানীয় পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী বছরে বাংলাদেশকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর বাইরে নতুন করে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ দেখা দেবে। যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনিশ্চয়তা ও বাধার সৃষ্টি করবে। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, চ্যালেঞ্জ হঠাৎ করে আসে না। অর্থনীতিতে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বহিঃখাত মোকাবিলা করা। বহিঃখাতে আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম, রেমিট্যান্সেও স্থিরতা নেই। বৈদেশিক ঋণ বাস্তবায়নের হারও কম, কারণ আমরা সঠিক সময়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে পারি না। এসবের প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দেশের ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য। নি¤œ আয়ের লোকের সংখ্যা বাড়ছে। তৃতীয়ত, এলডিসি থেকে ২০২৬ সালে আমরা উত্তোরণ হবো। এজন্য আমরা কিছুটা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ব। সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন।
তিনি বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সেটা আরো ঘনীভূত হবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য প্রতিবন্ধী। রাজনৈতিক অঙ্গনে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করা, বহিঃখাতে পরিস্থিতির উন্নতি আনতে পারলে অন্যান্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সহজ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী বছরে বাংলাদেশকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আর আন্তর্জাতিক বহুজাতিক সংস্থা- জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও), বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস বলছে, আগামী বছর বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ আরো বাড়বে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তি, মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়া, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বড় ধাক্কা সামাল দিতে হবে। এর সঙ্গে বিনিয়োগ কমে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়া, আমদানি কমায় দেশীয় শিল্পে সংকট আরো বাড়ার নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে দেশ সবচেয়ে বড় সংকটে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, বৈশ্বিক ও দেশে বিদ্যমান প্রতিকূল পরিবেশের কারণেই মূলত টাকার মান আরো কম ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। এতে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা কমে ভোগান্তি বাড়িয়ে দেবে। কমে যাবে জীবনযাত্রার মান। বাধ্য হয়ে খরচ কমাতে হবে পুষ্টি ও বিনোদন খাতে। শিক্ষায়ও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগের গতি হবে মন্থর। ফলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার কারণে মানুষের আয় কমে যাবে। বাড়বে খাদ্যের দাম। ফলে স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সক্ষমতা হারাবে অনেক মানুষ।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, অদূর ভবিষ্যতের সঙ্কটগুলো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি আর ডলারের সংকট। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে খাদ্য ও জ¦ালানি নিরাপত্তা। এগুলো মোকাবিলা করার জন্য রিজার্ভের পর্যাপ্ততা রক্ষা করাও বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করবে মূল্যস্ফীতি কোন দিকে যাবে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে কি ঘটছে? বর্তমানে কমোডিটি প্রাইস উচ্চ পর্যায়ে আছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা না হলে আর বেশি ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ বড় বড় ক্রেতা দেশগুলো, যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চায়নার মতো দেশগুলোর অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি দুর্বল হবে এবং ইউরোপের ক্ষেত্রে মন্দার মধ্যে থাকবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা দুর্বল হয়ে যাবে। সুতরাং কমোডিটি প্রাইস কমার সম্ভাবনা বেশি। তবে ভরসা করা যাবে না। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে এটা স্থির নয়। যেমন- তেলের দাম কমতে কমতে ৮০ ডলারে নেমে এসে আবার ওঠা শুরু করল। তাই অনিশ্চয়তা কাটেনি।
তিনি বলেন, ডলারের মূল্য ইদানীং আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুটা কমেছে। আগামীতে আরো কমার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে ভরসা করা যাবে না। তাই দেখতে হবে আন্তর্জাতিক বাজারে কমোডিটি প্রাইস এবং ডলারের মূল্য কোনদিকে যাবে- তার উপরে নির্ভর করবে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি কোনদিকে যাবে। অভ্যন্তরীণভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের পলিসি কেমন তাও দেখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে ডলারের সংকট কেমন হবে তা নির্ভর করছে সরকার চাহিদা কমানোর জন্য কি ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন এবং যোগান বাড়াতে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতি। মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে ডলারের চাহিদা কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে নেয়া পদক্ষেপ রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে ডলারের আরো ক্ষতি হয়েছে। এ জায়গা থেকে সরে না আসতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। এজন্য কৃষি উপাদানগুলোর যোগান সময়মতো থাকতে হবে। যেমন- বোরো চাষে বিদ্যুৎ, ডিজেল, সার লাগে। ডলার সংকটের কারণে এখানে যদি কোনো ধরনের টান পড়ে তাহলে বোরোর উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্য সংকট দেখা দেবে। পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে সামাজিক সহায়তা বাড়াতে হবে।
দেখা গেছে, বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে অর্থনীতিতে চাপ বেড়ে যায়। আমদানি ব্যয় বাড়লে রিজার্ভ কমে যায়। এতে টাকার মান কমে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে। বাড়ে মূল্যস্ফীতির হার। এছাড়াও আমদানি পণ্যের মাধ্যমেও দেশে মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়ে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে বিশ্বের ১০৪টি দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডবল ডিজিটের ওপরে। এর মধ্যে চারটি দেশের ১০০ ভাগের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে ওই সব দেশেও মূল্যস্ফীতির হার বেশি। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকে। ওই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। আগে ছিল ১ শতাংশের কম। এর পরেই ভারত থেকে বেশি আমদানি হয়। ওই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ব্রাজিলের মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৭ শতাংশ. যুক্তরাজ্যের ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, কানাডার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৭ দশমিক ১ শতাংশ। এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে। আগামী বছর ওইসব দেশে মূল্যস্ফীতির হার আরো বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এতে বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
গত ১৫ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আগামী বছর কৃষি উৎপাদন কমতে পারে। এতে কৃষি পণ্যের সরবরাহ কমে এর দাম বাড়তে পারে। ফলে অনেক দেশকে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্বল্প আয়ের মানুষ ইতোমধ্যে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দায় তাদের আয়ে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য কিনতে পারছে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়