প্রিন্সের অভিযোগ : বেছে বেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে

আগের সংবাদ

অর্থনীতির সাত চ্যালেঞ্জ : বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ > ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন > খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ > মূল্যস্ফীতি > বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ > কর্মসংস্থান > দেশীয় শিল্পে সংকট

পরের সংবাদ

রোদন ভরা দিন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রেখা চৌধুরী একজন সমাজসেবী। তিনি মূলত অনাথ শিশুদের নিয়ে কাজ করেন। অনাথ আশ্রমে লাখ লাখ টাকা দান করে তিনি মোটামুটি সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অবসরে রেখা চৌধুরী ফেসবুকে সময় কাটান। সময়ের পরিক্রমায় জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া এমন অনেক বান্ধবী আছে, যাদের তিনি ফেসবুকে আবার নতুন করে পেয়েছেন। একসময়ের আপন মানুষগুলো ভার্চুয়াল জগতে হয়ে উঠেছে রেখা চৌধুরীর আরো বেশি আপন।
রাতে ফেসবুক ওপেন করেই রেখা চৌধুরী দেখতে পান তার স্কুল জীবনের বান্ধবী সাজেদা বেগম এক যুবকের ছবি শেয়ার দিয়েছেন। হান্নান হোসেন নামে সেই যুবকের পাশে একজন বয়স্ক মানুষকে দেখে রেখা চৌধুরী চমকে ওঠেন। এ কাকে দেখছেন! এ তো স্বয়ং তোফায়েল। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। হান্নান হোসেন ছবির ক্যাপশনে লিখেছে, ‘ক্যান্সারে আক্রান্ত আমার বাবাকে সাহায্য করুন।’
রেখা চৌধুরী হান্নান হোসেনের প্রোফাইলে ঢোকেন। বেশ কয়েকটি পোস্ট পড়ে নিশ্চিত হলেন এই হান্নান হোসেন হচ্ছে তোফায়েলের একমাত্র পুত্র, যে কিনা ক্যান্সার আক্রান্ত বাবার সাহায্য চেয়ে ফেসবুকে বেশ কয়েকটি পোস্ট দিয়েছে। রুগ্ণ তোফায়েলের বেশ কয়েকটি ছবিও ভাসছে হান্নান হোসেনের টাইমলাইনে।
তোফায়েলের ছবির দিকে তাকিয়ে ১৯৭১ সালের স্মৃতিতে ফিরে গেলেন রেখা চৌধুরী। দেশ তখন উত্তাল। হানাদাররা হানা দিয়েছে এ দেশে। এ দেশ দখল করতে চায়। তোফায়েল বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চাইলে প্রথমে নারাজ থাকেন রেখা চৌধুরী। কারণ রণক্ষেত্রে যদি তোফায়েল শহীদ হন, তবে যে সেই কষ্ট মানতে পারবেন না তিনি। তোফায়েলকে তিনি এতটাই ভালোবেসেছেন, তাকে হারানোর কথা ভাবতে পারতেন না। কিন্তু তোফায়েলের কাছে তখন প্রিয়তমা রেখার চেয়ে দেশের মান বাঁচানোই ছিল মুখ্য। মুক্তিযুদ্ধে যেতে তার দৃঢ় সংকল্প দেখে রেখাও দ্বিমত করেননি আর।
তারপর ৯ মাসের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয় দেশ বাঁচাতে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। মুক্তির আনন্দ নিয়ে গ্রামে ফিরে এসে তোফায়েল জানতে পারেন তার প্রেয়সী রেখাকে পাকিস্তানি হায়েনারা তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি ক্যাম্পে, যেখানে দিনের পর দিন ধর্ষিত হন রেখা। তারপর কোনো এক ভোরে পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ফিরে আসেন তিনি।
রেখার ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা মেনে নিতে পারেন না তোফায়েল। একজন ধর্ষিতাকে বিয়ে করলে মানসম্মান থাকবে না- এই ভেবে রেখার জীবন থেকে সরে এসে বিয়ে করেন আলেয়াকে। এদিকে তোফায়েলের শোকে রেখা যখন অতল আঁধারে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তার জীবনের প্রদীপ জ¦ালাতে আসেন আজিম চৌধুরী। সবকিছু জেনেশুনে তিনি রেখাকে বিয়ে করতে রাজি হন। বিয়ের পরপরই আজিম চৌধুরী রেখাকে নিয়ে শহরে চলে আসেন। স্বামীর নামের সঙ্গে মিল রেখে ‘চৌধুরী’ টাইটেল যুক্ত করে গ্রামের সেই রেখা হয়ে ওঠেন রেখা চৌধুরী।
দাম্পত্য জীবনের অনেক বছর পার হলেও মা হতে পারেননি রেখা চৌধুরী। চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছেন, রেখা চৌধুরী জীবনে কোনোদিন মা হতে পারবেন না। কঠিন এই বাস্তবতা নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না আজিম চৌধুরীর।
মৃত্যুর আগে আজিম চৌধুরী তার অগাধ বিষয় সম্পত্তি সব রেখা চৌধুরীর নামে লিখে দেন। প্রাচুর্যে বাস করা রেখা চৌধুরী দিন দিন হয়ে ওঠেন মানবিক। সমাজের অবহেলিত বাচ্চাদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেন অকাতরে। বিশেষ করে অনাথ বাচ্চাদের ব্যাপারে তিনি বেশ উদার।
পুরাতন স্মৃতির অনুভব থেকে ফিরে আসেন রেখা চৌধুরী। ফেসবুক মারফত জানলেন তার অতীতের হারানো মানুষটির আজ ক্যান্সার। হান্নানের টাইমলাইন থেকে ফিরে আসতে পারছেন না রেখা চৌধুরী। কাঁপা কাঁপা আঙুলে তিনি হান্নানের টাইমলাইনের নিচে নামছেন। বাবার চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়ে হান্নানের অসংখ্য পোস্ট রেখা চৌধুরীকে যতই আন্দোলিত করছে, তিনি ততই চোখের জলে ভেসে যাচ্ছেন। ছবিতে রুগ্ণ তোফায়েলের ছবি দেখে নিজের বুকের ভেতরটি তোলপাড় করছে কেবল। এই মানুষটি একদিন তাকে ধর্ষিতা বলে অপবাদ দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তবুও আজ এতটা বছর পর মানুষটিকে আচমকা ভার্চুয়াল জগতে দেখে রেখা চৌধুরীর এমন লাগছে কেন? কেন তিনি বিষাদ মাখা স্মৃতির অতলে এভাবে তলিয়ে যাচ্ছেন? মানুষটিকে একদিন মন-প্রাণ সব উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছিলেন বলে! মোবাইলটা টি-টেবিলে রেখে বারান্দায় চলে আসেন রেখা চৌধুরী। তোফায়েলকে খুব মনে পড়ছে। হুহু করে কাঁদছেন তিনি। অদূরের লেবু তলায় স্বামী আজিম চৌধুরীর কবরে জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে রেখা চৌধুরীর বুকটা যেন আরো ভাঙতে লাগল। তোফায়েলের মতো আজিম চৌধুরীও আজ রেখা চৌধুরীর জীবন থেকে হারিয়ে গেছেন। চারদিকে যেন কেবল হারানোর হাহাকার!
মোবাইল হাতে নিয়ে আবার হান্নানের টাইমলাইনে প্রবেশ করেন রেখা চৌধুরী। তিনি সিদ্ধান্ত নেন তোফায়েলের চিকিৎসায় সাহায্য করবেন। ১৯৭১ সালে তোফায়েল নই বা করল তাকে মূল্যায়ন। তিনি আজ সেই তোফায়েলের দুর্দিনে তার পাশে থেকে প্রমাণ করবেন এত অবহেলা পাওয়ার পরও তিনি মানুষটিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
টাইমলাইন ঘেঁটে হান্নানের ফোন নম্বর বের করে কল দিলেন।
– হান্নান বলছো?
– জি ম্যাডাম।
– ফেসবুকে তোমার বাবার সাহায্যের পোস্ট দেখে কল করেছি। উনি এখন কেমন আছেন?
– ভালো নেই। চিকিৎসার জন্য আরো পাঁচ লাখ টাকা দরকার।
– তুমি আমাকে একটি ব্যাংকের একাউন্ট নম্বর দাও। আমি পাঁচ লাখ টাকা কাল পাঠাব।
– ম্যাডাম, অনেক অনেক কৃতজ্ঞ থাকব ম্যাডাম। কে আপনি এই মহামানবী?
রেখা চৌধুরী কোনো জবাব দিতে পারছেন না। তার বলতে ইচ্ছে করছে- ‘আমি মহামানবী নই। আমি একাত্তরের এক টুকরো সাদা কাগজ, যে কাগজে পাকিস্তানি হায়েনারা কলঙ্কের কালি মেখে দিয়েছে বলে তোমার বাবা আমাকে অবজ্ঞায় ছুড়ে ফেলেছে।’
রেখা চৌধুরীকে নীরব থাকতে দেখে ওপার থেকে হান্নানের প্রশ্ন- ‘ম্যাডাম, কে আপনি? কথা বলুন।’ রেখা চৌধুরীর মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। পরিস্থিতি কখনো কখনো মানুষকে বোবা বানিয়ে দেয়।
জোবায়ের রাজু
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়