জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি : ডা. এস এ মালেকের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি

আগের সংবাদ

পল্টন ছেড়ে গোলাপবাগে বিএনপি : বিকাল থেকেই সমাবেশস্থলে নেতাকর্মীদের অবস্থান, রাজধানীজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা

পরের সংবাদ

জন্মদিন > একজন শিক্ষকের প্রতিরূপ : সৈয়দ আকরম হোসেন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:৪০ পূর্বাহ্ণ

সৈয়দ আকরম হোসেনকে আমরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম এমএ শেষ বর্ষে। তাকে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে শ্রেণিকক্ষে পাওয়ার আগেই আমরা তার ক্লাসের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছিলাম। তরুণ শিক্ষকরাও পাঠদানকালে প্রসঙ্গক্রমে তার কথা বলতেন। এমনিতেই তার সুদর্শন চেহারা, বিভাগের করিডোরে দৃঢ় পদক্ষেপে চলাফেরা আমাদের মধ্যে ভয় ও ভক্তিভাবের সঞ্চার করত। আমরা যখন তাকে শিক্ষক হিসেবে পাই, তখন তার বয়স পঞ্চাশের কোটায় হলেও পৌরুষে, ব্যক্তিত্বে, আধিপত্যে তিনি ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
সৈয়দ আকরম হোসেন আমাদের আধুনিক কথাসাহিত্য পড়াতেন। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’জন, বিভূতি ও মানিক এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস তার কোর্সভুক্ত ছিল। আমরা আগেই জানতাম, তিনি প্রায়ই অপরাহ্নে পাঠদান করে থাকেন; দুপুর আড়াইটা বা ৩টায় শুরু হয়ে বেশ কিছুটা সময় নিয়েই তার ক্লাস চলে; শীত-গ্রীষ্মে তার এ রুটিনের পরিবর্তন হয়েছে কমই। চূড়ান্ত পর্বের আগের ক্লাসগুলোতে কেউ ঘুমিয়ে পড়লে তরুণ শিক্ষকদের অনেকেই সতর্ক করে দিয়ে বলতেন, সামনে বুঝবে যখন আকরম স্যারের ক্লাস পাবে। কারণ ক্লাসে তার পাঠদান হয়ে থাকে দুপুরে খাওয়ার পরে তন্দ্রার সময়ে। সত্যিই আমরা এই সত্য টের পেয়েছিলাম, তার প্রথম ক্লাসেই। তবে এটি সত্যি, তার ক্লাসে জ্ঞানপিপাসু ছাত্রদের ঘুমানো সম্ভব ছিল না, কারণ তার বক্তব্যের নতুনত্ব, উচ্চারণে শুদ্ধতা ও বাক্য প্রক্ষেপণের ধরন ছিল উপভোগ্য। তবু তিনি প্রথম ক্লাসেই কিছু সতর্কতা জারি করেছিলেন; এমনকি মাথাব্যথা হলে কিংবা ঘুম পেলে ক্লাসে আসার আগে একটি প্যারাসিটামল খেয়ে আসতে বলেছিলেন। তাছাড়া ছাত্ররা বুঝে নিয়েছিলেন, তার ক্লাস ফাঁকি দেয়ার কিংবা না পড়ে পাস করার জো নেই। তিনি যা পড়াতেন, ছাত্রদেরও তা উপলব্ধি করতে সহায়তা ও বাধ্য করতেন। প্রথম ক্লাসে আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত অবতারণা করেছিলেন; এবং বলেছিলেন, তিনি যে গ্রন্থগুলো পড়াবেন, সেগুলো প্রত্যেককে পাঠ করতে হবে, তিনি মাঝে-মাঝে তার পরীক্ষা নেবেন। মূলগ্রন্থ পাঠ না করে তার ক্লাসে বৈতরণী পারের সুযোগ ছিল না। ফলে তার কোর্স নেয়ার আগে শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে ভাবতে হতো। যারা একটু ফাঁকি দিয়ে পাস করতে চাইতেন, তারা তার কোর্স এড়িয়ে চলতেন। তবে এটাও ঠিক, তার কোর্স শিক্ষার্থীদের শ্রেণি বোঝার ক্ষেত্র সূচক হিসেবে কাজ করত।
আকরম স্যারের ক্লাসে আমি প্রথম এমন কিছু জানলাম, যা কেবল গ্রন্থপাঠের মাধ্যমে জানা সম্ভব ছিল না। ‘লালসালু’র কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ কিংবা ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের মুহাম্মদ মুস্তফা কিংবা তবারক ভূঁইয়া যে কেবল কাহিনির প্রয়োজনে এসেছে এমন নয়; কিংবা গল্পের রস আস্বাদন বা আনন্দ তৈরিতে লেখকের মুন্সিয়ানা এর প্রধান পরিচয় নয়। উপন্যাসের চরিত্র যে কেবল চরিত্র নির্মাণ নয়, কিংবা তাদের ভালো-মন্দ যে কেবল তাদের বিচ্ছিন্ন চারিত্রিক বা কর্ম-প্রণোদনার যথেচ্ছ ফল নয়। তার পাঠদানের মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারলাম, ‘অস্তিত্ববাদ’ বলে একটি দার্শনিক মতবাদ আছে এবং সাহিত্যে তা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে; বিশেষ করে জ্যাঁ পল সার্ত্রে, আল বেয়ার কাম্যুসহ অনেক ফরাসি সাহিত্যিক-দার্শনিক এই তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এই অস্তিত্ব কেবল ব্যক্তির ব্যাপার নয়, সমষ্টিরও ব্যাপার; কারণ কেবল ব্যক্তির অস্তিত্ব রক্ষিত হলে, সমষ্টির অস্তিত্ব ক্ষুণ্নও হতে পারে, আর সমষ্টির অস্তিত্ব ক্ষুণ্ন হলে ব্যক্তির পক্ষে এককভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়; আর এটি জীবনের টিকে থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। ওয়ালীউল্লাহ তার তিনটি উপন্যাসের মাধ্যমে এই তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যে প্রথম আমদানি ও যথার্থ ব্যবহার করেছেন। এ ক্ষেত্রে তার চেয়ে মুন্সিয়ানা আর কেউ দেখাতে পারেননি। এমনকি ‘লালসালু’র মজিদ চরিত্রও যে বেঁচে থাকার তাগিদে নানা ফন্দি-ফিকির করেছে; অস্তিত্বের সংকটের কারণেই সে মোদাচ্ছের পীরের মাজার আবিষ্কার; তার কাছে মনে হয়েছিল তার বেঁচে থাকার অধিকার আল্লাহ’র দুনিয়ায় আছে। কারণ ঔপনিবেশিক আমলের অপ্রায়োগিক শিক্ষাব্যবস্থার ফলে এ ধরনের ব্যবসায় নিয়োজিত হওয়া ছাড়া ভদ্রভাবে জীবনযাপনে তার উপায় ছিল না। কিন্তু প্রাথমিক অস্তিত্ব রক্ষার পরে মানুষ তার অস্তিত্বকে আরো শক্তিশালী করতে চায়, আর এর জন্য তাকে অন্যের শ্রমকে শোষণ করতে হয়, মিথ্যা ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। মজিদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল; যখন মানুষের ভক্তিভাবের উপার্জন দ্বারা তার গায়ে-গতরে জৌলুস ফিরে এলো, তখন সে গ্রামের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে, এমনকি তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের দাবিদার হয়ে উঠতে চেষ্টা করতে লাগল। বেঁচে থাকা ও ক্ষমতার লড়াইয়ের যে কানাগলি মজিদ বেছে নিয়েছিল, তা সুস্ত সমাজের অস্তিত্বের পক্ষে শুভকর নয়। কিন্তু এই উপন্যাসে লেখক ইঙ্গিত রাখতে ভোলেননি, ক্ষমতা যত দুর্ভেদ্য হোক না কেন তাকে চ্যালেঞ্জ করা অসম্ভব নয়। মজিদের বালিকা বধূ জমিলা জীবন দিয়ে তার ক্ষমতার মূলে আঘাত করেছে।
সৈয়দ আকরম হোসেনের পাঠদানের মাধ্যমেই আমি তরুণ লেখক হিসেবে বুঝতে শিখেছিলাম, লেখা কেবল পাঠকের আনন্দ তৈরির জন্য নয়; গল্প-উপন্যাসের কাজ কেবল পাঠকের মনে তরল চাহিদা পূরণ নয়, কিংবা লেখকের জনপ্রিয়তাও লেখার শিল্পবিচারের মাপকাঠি নয়। ততদিন আমরা যাদের লেখক বলে জেনেছিলাম, তার শিক্ষার ফলে ততদিনে ভালোমন্দের মধ্যে একটি পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষমতা অর্জিত হলো। এমনকি নিজের লেখালেখি সম্পর্কেও জনপ্রিয়তার পথকে পরিহার করার সিদ্ধান্ত মনে মনে গ্রহণ করেছিলাম। জনপ্রিয় লেখক হওয়ার চেয়ে দায়িত্বশীল লেখক হওয়া যে গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে পেরেছিলাম। সেদিক থেকে তিনি কেবল আমার ছাত্রজীবনে শিক্ষক নন, আমার লেখক-জীবনেও তার অবদান আছে। ওয়ালীউল্লাহর তিনটি উপন্যাস আর অস্তিত্ববাদ নিয়ে তার ক্লাসগুলো আমার কাছে কেবল সাহিত্যের ক্লাস হয়েই থাকেনি; এটি দর্শন, সমাজ ও রাজনৈতিক পাঠ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ‘চাঁদের অমাবশ্যা’র যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর যে যন্ত্রণা; জ্যোৎস্নালোকে বাঁশবনে দেখে-ফেলা একটি খুনের ঘটনা নিয়ে তার যে মানসিক দ্ব›দ্ব; একদিকে চাকরি হারানোর ভয়, জীবন ধারণের সংকট, অন্যদিকে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ না জানালে মানসিকভাবে তার বেঁচে থাকা আর অর্থবহ হবে না। তার আশ্রয়দাতা দাদাসাহেবের ভাই দরবেশ বলে পরিচিত আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধে তাকে সত্য প্রকাশের জন্য দাঁড়াতে হবে। এমন এক সংকটের মাঝে মাস্টার মশাই কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তার তুমুল দ্ব›দ্ব এ উপন্যাসে প্রকটিত। শারীরিক অস্তিত্ব রক্ষিত হলেই তো মানসিক অস্তিত্বের প্রশ্ন, কিন্তু মানসিক অস্তিত্ব বিঘিœত হলে মানবজীবন ধারণের তো কোনো অর্থ হয় না। আরেফ আলী শেষ পর্যন্ত মানুষ হিসেবেই জয়ী হয়েছিলেন, চাকরি হারানো ও বেকারত্বের ভয়ে তার সত্য প্রকাশ থেমে যায়নি। সে ঠিকই তার চাকরিদাতাদের বলাৎকার ও হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, পুলিশের কাছে সত্য ফাঁস করে দিয়ে ভারমুক্ত হয়েছিল।
ঠিক একই অবস্থা কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও। সেখানকার ছোট হাকিম মুহাম্মদ মুস্তফা নিজে একা-একা বেঁচে থাকতে চেয়েছিল, নিজে নিজে অনেকদূর এগিয়েও গিয়েছিল; কিন্তু‘ শেষ পর্যন্ত একা মানুষ আত্মহননের মাধ্যমে তার মুক্তির উপায় খুঁজে পেয়েছিল। এসব কথা বিবৃত হয়েছিল জাহাজের সারেং তবারক ভূঁইয়ার মাধ্যমে; অনেক ঘাটে সে নোঙর ফেলেছিল, তার সামষ্টিক বাঁচতে চাওয়ার আকাক্সক্ষা কুমুরডাঙ্গাবাসীকে অদৃশ্য ভয় থেকে মুক্তি দিয়েছিল। যারা অভিশপ্ত কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছিল, তারা যখন জানল কুমুরডাঙ্গার চেয়ে খুব ভালো কোনো গ্রাম নেই। আর এ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, স্বয়ং তবারক ভূঁইয়া; সারেঙ হিসেবে তার ভৌগোলিক ও বাস্তব জ্ঞানের ব্যাপারে গ্রামবাসীর আস্থা ছিল। আর এই ভালোত্বের প্রতি আস্থা গ্রামবাসীকে আবার কাছাকাছি আনতে সহায়তা করেছিল। যে রীতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এই উপন্যাসের শৈলীনির্মাণ করেছেন, তাকে বলে চৈতন্যপ্রবাহ রীতি, ইংরেজিতে যাকে স্ট্রিম অব কনসার্সনেস বলে; উপন্যাসের এসব প্রকরণের প্রথম পাঠ আমরা আকরম স্যারের কাছে নিয়েছিলাম। আমরা শিখেছিলাম, আমাদের নিজেদের ভালোত্ব আবিষ্কার করতে হবে, প্রকাশ করতে হবে এবং কাছাকাছি বসবাস করতে হবে; কেবল অপ্রমাণযোগ্য অদৃশ্যভয়ের ওপর মানবজীবন ছেড়ে দেয়া যাবে না। উপন্যাস রচনার অন্তর্ধারায় লেখকের যে এ ধরনের চেতনা কাজ করে, সৈয়দ আকরম হোসেন আমাদের সচেতন করে তুলেছিলেন। এসব ব্যাখ্যা উপন্যাসের মধ্যে লেখা থাকে না; একজন শিক্ষককে তা ধরিয়ে দিতে হয়; অন্তত জীবনের প্রথম পর্যায়ে, যা সৈয়দ আকরম হোসেন আমাদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা এও বুঝেছিলাম, তার ক্লাসগুলো একেবারে প্রথম পাঠগ্রহিতাদের জন্য সুখকর নয়। একই ভাবে তিনি বিভূতিভূষণ ও মানিক পড়িয়েছিলেন আমাদের। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ সর্বাধিক পরিচিত হলেও ‘অপরাজিত’, ‘আরণ্যক’ ও ‘ইছামতী’ উপন্যাসে তিনি জোর দিয়েছিলেন; এখন বুঝতে পারি এটাই গুরুবিদ্যা। এখনো ‘আরণ্যক’ পড়তে গেলে মায়ারকুণ্ডী, সরস্বতীকুণ্ডী, বুমাইবুরুপাহাড়, লবটুলিয়ার যুগলপ্রসাদ, মহিষের দেবতা টাঁড়বারো, আদিবাসী রাজকুমারী ভানুমতি- এ রকম অসংখ্য চরিত্র ও স্থান স্যারের সঙ্গ ছাড়ে না। তেমনি ‘ইছামতী’ উপন্যাসের ভবানীবাড়–জ্যে, রামকানাই কবিরাজ, তিলু-বিলু ও নীলু চরিত্র অমর হয়ে আমাদের জীবনের মধ্যেই বাস করছে; আর এসবই তার অবদান। যদিও অনেকে স্যারকেই বিভূতিভূষণের অপুর অপূর্ব হিসেবে কল্পনা করতেন। মানিকের ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ও ‘চিহ্ন’ উপন্যাস তিনি আমাদের হাতে-কলমে পড়িয়েছিলেন। মার্কসবাদী কিছু পাঠ, সংগ্রামশীলতার ইঙ্গিতও তার বক্তব্যে থাকত। এখনো ভাবি, মানিকের অন্য উপন্যাসগুলো যা-ই হোক না কেন, ‘চিহ্ন’ উপন্যাসটি তিনি না পড়ালে আমার কাছে এর গূঢ়ার্থ অজানাই থেকে যেত। তার পাঠের মাধ্যমে আমার কাছে এসব মহান লেখকের মনোজগৎ একের পর এক উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল; এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে পরবর্তীকালেও চিন্তার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। যদিও আমি তার মতো নির্মেদ, দৃঢ়, তথ্যবহুল ও প্রাতিষ্ঠানিক গদ্য রচনা রপ্ত করতে পারিনি; কিংবা চেষ্টাও করিনি। আমার গদ্য এলানো, বর্ণনাধর্মী, ডিটেইলস; এমনকি অনেক সময় ব্যাকরণের নিয়মরীতি মেনে চলার পক্ষেও শোভন নয়; তবু পাঠকের কিছু প্রশ্রয় পাওয়ার কারণ হয়তো আমার শিক্ষকের শিক্ষা তার অন্তর্ধারায় জাগরুক রয়েছে।
পুরো বছর ধরে তিনি একটিও ক্লাস কামাই না করে আমাদের পাঠদান করেছিলেন, তার পাঠদানে পুনরপি ছিল বলে মনে হয় না; প্রতি ক্লাসে তিনি নতুন বিষয় উপস্থাপন করতে পারতেন। ছাত্রজীবনের দুই যুগের বেশি সময় অতিক্রম করার পরও সে সব এখনো স্পষ্ট মনে আছে। প্রতিটি কথাই তিন মেপে বলতেন, হয়তো তার পঠনপাঠন, শিক্ষাদীক্ষা ও সমাজ সচেতনতা তাকে সে পথে নিয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকের ক্লাসে তিনি আমাদের বলেছিলেন, আরও গোটা তিনেক ক্লাস নেবেন। আমি এমনিতে তার ক্লাস শেষ হওয়ার ভয়ে ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এই তিনটা ক্লাস আর কিছুতেই মিস করব না। আগেও অবশ্য বিশেষ অসুবিধা ছাড়া তার ক্লাসে অনুপস্থিত থাকিনি। কিন্তু এখনো আমার মনে খেদ রয়ে গেছে, স্যার এর পরে মাত্র একটি ক্লাস নিয়েছিলেন; তার সম্ভাবিত শেষ দুটো ক্লাস নেননি; যদিও তিনি এর আগে ক্লাস বাদ দেননি। আমি জানি না, এটি ইচ্ছাকৃত ছিল কিনা; তিনি কি আমাদের একটি অসমাপ্তির বেদনা দিয়েছিলেন; কিংবা শেষ না করে চিরদিনের শিক্ষক হয়ে থাকতে চেয়েছেন; এখনো আমি স্বপ্নের মধ্যে ভাবি আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়নি; হন্তদন্ত হয়ে তার অসমাপ্ত ক্লাস করার জন্য ছুটছি।..
কেবল শিক্ষক হিসেবে নয়, সাহিত্যের সমালোচক হিসেবেও তিনি প্রথম শ্রেণির। তিনি কালের একজন শীর্ষস্থানীয় রবীন্দ্র-গবেষক হিসেবে খ্যাত। একবার শঙ্খ ঘোষ বাংলা একাডেমিতে আমাদের তরুণ লেখক প্রকল্পে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্র-গবেষণার হাল-হকিকত জানতে চাইলে তিনি জানালেন, তার বিবেচনায় দুই বাংলায় সেরা রবীন্দ্র-গবেষক হলেন সৈয়দ আকরম হোসেন। এ কথা জেনে কার না আনন্দ হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার অভিসন্দর্ভ ‘রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে : চেতনালোক ও শিল্পরূপ’ আমি আগেই পড়েছিলাম। কিন্তু সে সময় বইটি গুরুত্ব দেয়ার মতো বয়স ও অভিজ্ঞতা ছিল না। পরে আবারও পড়েছি; এবং পড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি সৈয়দ আকরম হোসেনের নিজস্ব ভাষাশৈলী আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছে। আমার মনে হয়েছে, তার রবীন্দ্রগবেষণার জন্য এ ধরনের বাক্যগঠনের প্রয়োজন ছিল। একটি বাক্যের সিনট্যাক্স অক্ষুণ্ন রেখে দরকারি ও বেশি তথ্য দিতে তিনি পারঙ্গম। আর এটি সম্ভব হয়েছে তার পঠন-পাঠনের বিস্তৃতি ও রূপদক্ষ ভাষাশিল্পী হওয়ার ফলে। তিনি যদিও রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে গবেষণা করেছেন; কিন্তু এই গ্রন্থটি সামগ্রিক রবীন্দ্রনাথকে জানার জন্যও সহায়ক। বাংলাদেশের কথাসাহিত্য ও ছোটগল্প নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। যদিও তিনি বহুলপ্রজ নন, কিন্তু যেখানে স্পর্শ করেছেন, সেখানেই তার নতুন পর্যবেক্ষণ ধরা পড়েছে। আমাদের দেশে রবীন্দ্র ও নজরুল গবেষক বলে দুই ধরনের সাহিত্য গবেষণার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। সৈয়দ আকরম হোসেনকেও অনেকেই রবীন্দ্র-গবেষক বলে থাকেন; হয়তো রবীন্দ্রনাথের ওপরে তার লেখালেখির পরিমাণ বেশি; কিন্তু‘ নজরুল নিয়ে তিনি যে যৎসামান্য কাজ করেছেন, তার জুড়ি মেলা ভার। বিশেষ করে ‘চক্রবাক’-এর যে ব্যাখ্যা তিনি হাজির করেছেন, ভাষায় বক্তব্যে তা নজরুল-প্রতিভা উন্মোচনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। নজরুল-সাহিত্য ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্ভাগ্য, খুব বেশি প্রতিভাবান সমালোচক এগিয়ে আসেননি। নজরুল-প্রতিভার ঝলকে হয়তো সাধারণ লোক মুগ্ধ হন; কিন্তু নজরুল-প্রতিভার ব্যাপ্তি তাদের পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ নয়।
সৈয়দ আকরম হোসেন এখনো আমার গুরুপদ থেকে বিচ্যুত নন। আগে তাকে দেখলে যেমন ছাত্রত্বের অনুভূতি হতো, এখনো তা-ই হয়। স্যারের দেখা পাওয়ার জন্য আমি সতত উন্মুখ হয়ে থাকি, পাই না। আমাদেরও বয়স বাড়ছে, জীবনের অনেক কিছুর প্রতি নিষ্পৃহ হয়ে উঠছি। কিন্তু‘ স্যারের ভালোবাসা পাওয়ার প্রতি আগ্রহ এখনো আগের মতো আছে। এমনকি তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, স্যার আপনার অনেক ছাত্র, কিন্তু আমার শিক্ষক খুব বেশি নেই। শুভ জন্মদিন স্যার!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়