জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি : ডা. এস এ মালেকের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি

আগের সংবাদ

পল্টন ছেড়ে গোলাপবাগে বিএনপি : বিকাল থেকেই সমাবেশস্থলে নেতাকর্মীদের অবস্থান, রাজধানীজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা

পরের সংবাদ

গল্প > সমর্পণ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:৪০ পূর্বাহ্ণ

এ বাসায় সাইফুলের প্রায় ছ’মাস হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পেয়েছিল, তবে বিরোধীদলীয় ছাত্ররাজনীতি করার কারণে, সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের নব্য পান্ডারা তাকে হল থেকে বের করে দিয়েছে। কিছুদিন আগেই দেশে সরকার পতন হয়েছে, গঠিত হয়েছে নতুন সরকার। মধ্যবামপন্থি দল এবারের নির্বাচনে গোহারা হেরে গেছে, ক্ষমতায় চলে এসেছে মধ্যডানপন্থি দল। তাদের সাথে আবার জোটবদ্ধ হয়ে আছে উগ্র ডানপন্থি দলের কিছু সদস্যও। সাইফুলরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে, কখন মধ্যবামপন্থিরা ক্ষমতায় ছিল। স্বাভাবিকভাবেই হলে সিট পাওয়ার জন্য সাইফুলকে মাঝে মাঝে তাদের মিটিং-মিছিলে যেতে হতো। ছ’মাস যেতে না যেতেই ক্ষমতার পালাবদল হয়ে আজ মধ্যডানপন্থিরা ক্ষমতায়। যার ফলশ্রæতিতে সাইফুলকে তার হলের সিট হারাতে হয়েছে।
মধ্যবিত্তের সন্তান, পিতা মাসের শুরুতে গুনে গুনে দুই হাজার পাঁচশ টাকা দেন। সেই টাকায় হলে থেকেই মাস চালানো দায়। হলের সিট চলে গেছে, জানতে পারলে বিরাট ক্যাচাল হয়ে যাবে। মামারা চলে আসবেন, দফায় দফায় পারিবারিক মিটিং হবে। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। একেকজন একেক বিশেষজ্ঞ মতামত দেবেন। ‘অমুকের ছেলে তমুক তো দিব্যি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে থেকে পড়ালেখা করছে! টিউশনি করে মাসে মাসে উল্টা বাড়িতে টেকা পাঠায়। তুমার সমস্যাডা কিতা?’ ‘তুমারে রাজনীতি করবার কইছে কেডা? বালামত লেহাপড়া করবা, পাস কইরা বড় চাকরি করবা, তুমার রাজনীতি করনের দরহারডা কিতা?’ ইত্যাদি নানা প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে জীবন জেরবার হয়ে যাবে। আরো আছে! দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক পিয়ন, ছোট মামার স্কুল জীবনের বন্ধু। তিনি লাফিয়ে উঠবেন, বিষয়টার শেষ দেখে নেয়ার জন্য। কাজেই সাইফুল বেশি ঝামেলায় না গিয়ে, হল থেকে বিতাড়িতের খবরটি বাসার লোকজনের কাছে গোপন রেখেছে। কিন্তু ঝামেলা বেধেছে অন্যখানে, মাসে মাসে আটশ টাকা বাসা ভাড়ার হিসাবটা কোনো মাসেই মিলছে না। বাসা না বলে ঘর বলাই ভালো। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পেছনে একটা গ্রাম আছে, সেখানে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরাই কিছু বাড়ি-ঘর করেছে। সাইফুলের বাড়ির মালিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের পিয়ন। বাড়িতে একটি সেমি-পাকা দোচালা বাড়ি, সেটিতে মালিক মন্তাজ মিয়া পরিবারসহ থাকেন। আরেকটি টিনশেড দোচালা বাড়ি রয়েছে, সেখানে পাশাপাশি দুটি ঘর, যার একটিতে সাইফুল থাকে, অন্যটি খালি। সামনে একটা টানা বারান্দা আছে, বারান্দার ওপর টিনের চাল।
খরচ সামলাতে সে গোল্ডলিফ থেকে নেভিতে নেমেছে। একটা টিউশনিও জুটিয়েছে, সেটি আবার ঢাকায়। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যেতে পারে না। দুপুরের পর ক্লাস থাকে না, কলা ভবন এলাকাটা নীরব হয়ে যায়। সেই ফাঁকে সাইফুল চুপিচুপি গ্রাম থেকে বেরিয়ে ক্ষমতাসীনদের নজর এড়িয়ে প্রান্তিক গেটে গিয়ে মহাসড়কের অপর প্রান্তে দুরুদুরু বুকে চোরের মতো ঢাকার বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। অবশ্য সব দিন কপাল প্রসন্ন থাকে না, ক্ষমতাসীনদের চোখে পড়ে গেলে চড়-থাপ্পড় নিদেনপক্ষে মৌখিক ফাঁপড় তো খেতেই হয়। পাবলিক বাসে ঢাকা গিয়ে ছাত্র পড়িয়ে আবার ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা। তা হোক মাস শেষে হাজারখানেক টাকা টেকে। সব মিলিয়ে বাড়তি খরচটুকু কোনোভাবে সামাল দেয়া যাচ্ছিল।
এর মধ্যে একদিন ছাত্র পড়িয়ে ঢাকা থেকে ফিরছে, প্রবল বৃষ্টি সব ভাসিয়ে নিচ্ছে, বিদ্যুৎ চলে গেছে। কাক ভেজা হয়ে দৌড়ে বাড়ির বারান্দায় উঠে সাইফুল হাঁ হয়ে গেল। কারণ বারান্দায় পায়চারি করছে একটি সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ে। অন্ধকারে তেমন বোঝা না গেলেও, মেয়েটি সাদা স্কার্ট পরে আছে এবং মেয়েটি যে রূপবতি তাতে কোনো সন্দেহ রইল না। সাইফুলকে দেখে সে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। সাইফুলের হতভম্ব দৃষ্টিটাকে সে বরং উপভোগ করছিল। সাইফুলকে আরো ভড়কে দেয়ার জন্য সে একান্ত পরিচিতের ভঙ্গিতে হেসে জিজ্ঞেস করল- ‘ভালো আছেন?’
সাইফুল প্রথমে ঘরের চাবি খুঁজে পাচ্ছিল না, এখন আবার সে চাবি তালায় ঢুকছে না। সে প্রাণপণে চাবি তালায় ঢুকাবার চেষ্টা করে যেতে থাকল। তার হাত কাঁপছে। মেয়েটি তার এই কাঁপাকাঁপি বুঝে ফেললে বেইজ্জতির সীমা থাকবে না। এমন সময় মেয়েটি বলল- ‘আপনার হাত ভিজা তো! দেন চাবিটা আমারে দেন।’
সাইফুল বিনা বাক্য ব্যয়ে চাবিটা মেয়েটিকে দিলে সে দরজা খুলে দিল।
ঘরে পা দেয়া মাত্র বিদ্যুৎ চলে এলো। সাধারণত সাইফুলের কপাল এত ভালো হয় না। সবসময় দেখা যায়, সে ঘরে ঢুকলে বিদ্যুৎ চলে যায়, খেতে বসা মাত্র বিদ্যুৎ চলে যায়। বিদ্যুৎ চলে যাওয়া মাত্র তেলাপোকা ওড়াউড়ি শুরু করে। কিন্তু সেদিন সে ঘরে ঢোকা মাত্র বিদ্যুৎ চলে এলো। আলোয় দেখা গেল মেয়েটি সাদা একটি স্কার্ট পরে আছে, ওপরে একটি সাদা টপ এবং অন্ধকারে যতটা ধারণা করা গিয়েছিল, তার থেকেও অনেক রূপবতী। জানা গেল মেয়েটির নাম ফারজানা, সে পাশের কক্ষের ভাড়াটিয়া। ঘরে ঢুকে সাইফুল নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, মেয়েটির কথা মাথায় রইল না।
ফারজানা ঘরটি ভাড়া নিয়েছিল, কারণ সে তার আগের চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছিল। পাশের জেলাটি তৈরি পোশাক শিল্পের বিরাট এক অঞ্চল, সেখানেই এক কারখানায় সে কাজ করত। প্রথমে ঢুকেছিল শ্রমিক হিসেবে, পরবর্তীতে সে একটি লাইনের সেলাই কাজ তদারক করার দায়িত্ব পেয়েছিল। সুপারভাইজার মোবারক তাকে বিশেষ স্নেহ করত। সেই স্নেহের কারণেই তার ওই পদোন্নতি হয়েছিল। কাজ শেষে মোবারকের সাথে নাইট শো সিনেমা দেখা, টুকটাক বিড়ি-সিগারেটে টান সবই চলত। সময় যত এগোতে লাগল মোবারক তত সাহসী হচ্ছিল। এক পর্যায়ে তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বোর্ডবাজারে ঘর ভাড়া করে থাকতে লাগল। ফারজানার কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। কারণ সে মোবারককে ভলোবেসেছিল। এরই মধ্যে বিড়ি-সিগারেটের গণ্ডি পেরিয়ে মোবারক ফারজানাকে ইয়াবা ধরিয়ে ফেলেছিল। টাকার দরকার বাড়তে থাকল। মোবারক ফারজানার জন্য নতুন কাজের প্রস্তাব নিয়ে এলো। কাজ বেশি কিছু না, বিদেশ থেকে যেসব বায়ার আসে, তারা সারা দিন পরিশ্রম শেষে একটু রিলাক্স হতে চায়। এই তাদের সাথে ফাইভ স্টারে বসে মদের টেবিলে একটু সঙ্গ দেয়া। রাত শেষের অনেক আগেই মোবারক তাকে গাড়ি করে নিয়ে আসবে। মোটা টাকার ব্যবস্থা ছিল দুজনের জন্যই। মোবারকের দুটা টাকা হলে তো ফারজানারই লাভ! নিজের লাভটা তো বেকুবেও বোঝে! কাজেই ফারজানা নিজের লাভটা বুঝেছিল। শুরু হয়ে গিয়েছিল ফারজানার নতুন চাকরি।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাজ করে যে টাকা সে অর্জন করত তার বেশির ভাগ তার আর মোবারকের ইয়াবার খরচেই চলে যেত। বাকিটা যেত পোশাক-আশাক আর প্রসাধনে। শত হলেও ফাইভ স্টারে তো প্রতিদিন এক পোশাকে যাওয়া যায় না! মোবারক ফুলে-ফেঁপে কুমির হচ্ছিল। ফারজানা বুঝত, বুঝলেও তার কিছু করার ছিল না। টাকার যে বড় দরকার! কাজেই ব্যবস্থাটা সে মেনে নিয়েছিল।
কিন্তু বিধি বাম! মোবারকের ওপরের বস তানভির সাহেব বিষয়টা টের পেয়ে গিয়েছিলেন। না, তিনি যে যুধিষ্ঠির তা নন। তিনিও আরেক মোবারক। একান্ত বাধ্যগত একটি সুন্দরী নারী, যে চটুল কথা বলতে পারে, মাতাল হয়ে নাচতে পারে, নাচতে নাচতে বুকে ঢলে পড়তে পারে, তাকে কব্জায় না নেয়ার মতো বোকা তো তানভির সাহেব ছিলেন না। কাজেই কয়েকটি ঘটনা খুব দ্রুত ঘটল। মোবারকের চাকরি গেল, তার বিরুদ্ধে ঝুট চুরির মামলা হলো এবং মোবারক পালিয়ে গেল। সে পালিয়ে যাওয়ার পর ফারজানার রাতের কাজগুলো কমতে লাগল। জানা গেল, তিন মাসের ঘর ভাড়া বাকি রেখে মোবারক পালিয়েছে। নেশার টাকা জোগাড় করা একরকম দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল। এর মধ্যে তানভির সাহেবের কাছ থেকে কাজের প্রস্তাব এলো। কাজ আর আগের মতো নেই, তাকে আরো একটু সাহসী হতে বলা হলো! ফারজানা কোনো মতামত দেয়ার অবস্থানে ছিল না, কাজেই সে সাহসী হলো। কিন্তু কোনো কিছুই স্থায়ী হলো না। একসময় তানভির সাহেবও মোবারক হয়ে গেলেন, আরো তানভির সাহেবরা এলেন। তাদের আবদার বাড়তেই থাকল। একটা সময় এলো, সাহেবরা আর ফারজানাকে কোথাও যেতে দিতে চান না। তাতেও ফারজানা রাজি ছিল। কিন্তু সাহেব ছিলেন প্রায় জনা দশেক। কেউ কারো চেয়ে কম ক্ষমতাবান নন, কাজেই ফারজানার জীবন সংশয় হলো। এর মাঝে অন্য সাহেবের সাথে ফাইভ স্টারে যাওয়ার অপরাধে এক রাতে বেদম পিটুনি খেয়েছিল এক সাহেবের হাতে। কেবল জানটা ছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বাঁচতে হলে তাকে পালাতে হবে। নাহলে সাহেবরা তাকে বাঁচতে দেবে না। কাজেই সে পালিয়ে এসেছে।
এভাবে পাশাপাশি কক্ষে ফারজানা আর সাইফুল থাকছিল। ফারজানার সারা দিন কোনো কাজ থাকত না। কিছুদিন সে নীরবে পালিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে লক্ষ্য করেছিল ছেলেটি সকাল সকাল বের হয়ে যায়, সারা দিন খবর নেই। রাত এগারোটার দিকে ফেরে। ফেরার পর গভীর রাত পর্যন্ত বাচ্চাদের মতো জোরে জোরে পড়ে। মাঝে মাঝে পড়ার শব্দ থেমে যায়, কম্পিউটারের কিবোর্ডের শব্দ কানে আসে। কখনো কখনো ছেলেটি বিড়বিড় করে হাবিজাবি কথা বলে। বিড়বিড় করলেও গভীর রাতে প্রায় গ্রামের পাশাপাশি ঘর থেকে ফারজানা প্রায় প্রতিটি কথাই বুঝতে পারে। যে রাতে ছেলেটি বিড়বিড় করে, সে বিড়বিড় সমাপ্ত হয় ফুঁপিয়ে কান্নায়। ফারজানা এটুকু বুঝতে পেরেছিল, ছেলেটি কোনো ভুল করে ফেলেছে। সে তার ভুল শোধরাতে চায়, কিন্তু পারছে না।
এই রুটিনে জীবন চলছিল। একটা সময় চলে এলো, ফারজানার খুউব জানতে ইচ্ছা হতো ছেলেটি কেন শেষ রাতে কাঁদে? পরক্ষণেই আবার ভাবত ‘মরুক গে! নিজে বাঁচি না নিজের জ¦ালায়!’ কিন্তু এক রাতে সে আর পারল না। ছেলেটি বিড়বিড় শুরু করেছে এমন সময় সে বলল- ‘সাইফুল ভাই! আপনের কাছে সিগেরেট আছে?’
– ‘আছে! কেন?’
– ‘আমারে একটা দিবেন? কালকে দিয়া দিমু। আমার সিগেরেট শ্যাষ।’
– ‘দিবো কীভাবে?’
– ‘চালের ফাঁক দেয়া মিল্লা মারেন।’
দুটি ঘর বাঁশের বেড়া দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। চালের দিকের অংশটি ফাঁকা। সাইফুল সেই ফাঁকা দিয়ে একটি সিগারেট ছুড়ে দিলে ফারজানা বলেছিল- ‘কালকে দিয়া দিমু নে।’ সাইফুর বলেছিল- ‘দিতে হবে না।’ সেই থেকে শুরু। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই তারা গভীর রাতে দু’ঘর থেকে কথাবার্তা শুরু করত। যেমন হঠাৎ কথা শুরু হতো তেমন হঠাৎই শেষ হয়ে যেত। দিনের বেলা দেখা হলে তারা দুজনেই এমন ভাব করত যেন কেউ কাউকে চেনেই না।
আগেই তো বলেছি, সাইফুলের সময়টা বেশ খারাপ যাচ্ছিল। টাকার সমস্যা, সে সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে দিনের বেশির ভাগটাই চলে যাচ্ছে। চোরের মতো পালিয়ে পালিয়ে ক্লাসে যেতে হয়। সব মিলিয়ে ক্লাসে সে পিছিয়ে পড়ছিল। এর মাঝে একদিন সে ধরা পড়ে গেল মধ্যডানপন্থি ছাত্র সংগঠনের পান্ডাদের হাতে। বেশি না! হালকা চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি ইত্যাদি। তারা বেশ হিসাব করে পিটিয়েছিল। কাজেই হাসপাতালে যেতে হয়নি, আবার পায়ে হেঁটেও ঘরে ফিরতে পারেনি। সেদিন সে ঘরে ফিরেছিল বিকাল তিনটায়। ফারজানা বারান্দায় রান্নার কাজ করছিল, এমন সময় কয়েকজন ছেলেমেয়ে কাঁধে করে সাইফুলকে নিয়ে এলো। দুজন ছেলে এবং তিনজন মেয়ে ছিল। সাইফুল হাঁটতে পারছিল না, খোঁড়াচ্ছিল। নাক-মুখ বিভিন্ন জায়গায় ফুলে কালসিটে পড়ে গেছে। ফারজানার দৌড়ে ছুটে যাওয়ার একটা ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংবরণ করেছিল। মনে মনে বলেছিল- ‘আমার কী!’
ঘরে ঢুকে গেলেও পাশের ঘরে ছেলেমেয়েদের উত্তেজিত কথাবার্তা তার কানে আসছিল। সে জানতে পেরেছিল, ছেলেটি ছাত্ররাজনীতি করে। প্রতিপক্ষের ছেলেরা তাকে পিটিয়েছে। একটি মেয়ে খুবই উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছিল, অন্য একটি মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। মেয়েটির কান্নার শব্দে ফারজানা মনে কোনো দয়া তৈরি হচ্ছিল না, তার পরিবর্তে হচ্ছিল ক্রোধ। ক্রোধের বিষয়টি টের পেয়ে গিয়ে সে নিজেই নিজের কাছে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছিল না। তার কেবল মনে হতে থাকল ‘সাইফুলের জন্য এই মেয়ে কেন কাঁদবে? কাঁদার জন্য তুই আর লোক পাস না!’ সারাটা বিকাল ‘সাইফুলের জন্য এই মেয়ে কেন কাঁদবে?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াল। এক পর্যায়ে নিজের কাছে ধরা পড়ে গেল। নিজেকে নিয়ে এক অজানা আতঙ্ক তাকে বিবশ করে ফেলল, কাজেই সে সারাটা বিকাল বিছানায় উপুড় হয়ে হাপুস নয়নে কাঁদল। সন্ধ্যায় সে তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তানভির সাহেবরা তো তাকে সাহসী বানিয়েইছেন। আজ সে তার সাহস নিজের জন্য কাজে লাগাবে।
সাইফুলের বন্ধুরা চলে গিয়েছিল সন্ধ্যার আগেই। মন্তাজ মিয়ার পরিবার রাত নয়টার মধ্যেই ঘুমিয়ে যায়। মন্তাজ মিয়ার ঘরের শেষ বাতিটা নিভে যেতেই ফারজানা বলল- ‘সাইফুল ভাই, ব্যথা কি খুব বেশি।’
– ‘না। এখন ঠিক আছি। ঠিক হয়ে যাবে।’
– ‘আমি চলে আসি?’
– ‘চলে আসি মানে?’
– ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
– ‘কষ্ট তো হবেই, পিটুনি খেয়েছি, কষ্ট হবে না!’
– ‘সেজন্য না। ওই মেয়েটি কাঁদছিল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি শুধু আপনার হাত ধরে বসে থাকব। আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে।’
সাইফুল কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এমন সময় দরজায় শব্দ হলো। বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর দরজা খোলাই ছিল। দরজায় ফারজানা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ফোলা, তাতে নিবেদন। পৃথিবীর কোনো পুরুষকে যা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা দেয়া হয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়