জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি : ডা. এস এ মালেকের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি

আগের সংবাদ

পল্টন ছেড়ে গোলাপবাগে বিএনপি : বিকাল থেকেই সমাবেশস্থলে নেতাকর্মীদের অবস্থান, রাজধানীজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা

পরের সংবাদ

আন্ধারমানিক : স্বপ্নবান এক মানুষের গল্প

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আন্ধারমানিক! আঁধারে যে মানিক প্রজ্জ্বলিত কিংবা যে মানিক আঁধারে ঢাকা পড়ে আছে। শব্দটির দুভাবেই অর্থ করা যায়। স্বপ্নবাজ এ ছেলেটির নাম হাসান পারভেজ। এক চিলতে হাসির আড়ালে চাপা পড়ে তার সমস্ত যাতনা, আক্ষেপ। দিন বদলের খোয়াব লালন করেন নিজের চিন্তা, কর্মে, দর্শনে। তাই বিলিয়ে দিয়েছেন আন্ধারমানিকের মাঝে। মূলত আন্ধারমানিক একটি নদী। এর পাড়ে ছোট্ট বসত ঘর হাসানের।
কেউ চেনেন দিনমজুর হিসেবে। আবার কেউ বলেন স্বভাব কবি। কিন্তু এসব পরিচিতির বাইরেও হাসান পারভেজের আরো অনেক পরিচয় আছে। তিনি একাধারে সংবাদপত্রের সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশক। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় উপকূলবর্তী আন্ধারমানিক নদীর তীরের ছোট্ট গ্রাম পশ্চিম সোনাতলা। আঁধারে মানিক হয়ে হাসান প্রকাশ করে চলেছেন আন্ধারমানিক পত্রিকার একের পর এক সংখ্যা।
আজন্ম সঙ্গী তার দারিদ্র্য। এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল ১৯৯৬ সালে। অর্থাভাবে পরীক্ষায় বসা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরীক্ষায় বসেন পারভেজ, উত্তীর্ণ হন সসম্মানে। এরপর এইচএসসির রেজাল্টে দেখান চমক। বর্তমানে কলাপাড়া মোজাহার উদ্দীন বিশ্বাস কলেজে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি প্রথম পর্বে পড়াশোনা করছেন হাসান। একই সঙ্গে চলছে পত্রিকার কাজও।
জুলাই ২০১৯, খুব সম্ভবত। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসি পরীক্ষার পরিদর্শক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় কলাপারা মোজাহার উদ্দীন বিশ্বাস কলেজে। যথা সময়ে পৌঁছি সেখানে। কলেজের একজন শিক্ষক হামিদুজ্জামান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সাবেক ছাত্র তিনি। বেশ রসিক, আমুদে মানুষ। আমার স্কুল কলেজ পড়াশোনা, পেশা অনেক ব্যাপারে গল্প হয় তার সঙ্গে। এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, সাংবাদিকতার মতো পেশা ছেড়ে সরকারি চাকরিতে কেন? উত্তর আমিও জানি না। তবে ২০০৫ এ রাজধানীর শাহবাগে এবং ২০১৩ তে মতিঝিল শাপলা চত্বরে পরপর দুবার ভয়ংকর হামলার শিকার হয়ে মাসখানিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। এরপর পরিবারের চাপ, মানসিক বোঝাপড়া আর চরম দুর্দিনে অপ্রত্যাশিতভাবে অনেকের অসহযোগিতা আমাকে হতাশ করে। বিকল্প পেশা খুঁজতে বাধ্য হই আমি। তাই বলে, লেখালেখি কিন্তু ছাড়িনি আমি। তখন হামিদ সাহেব বললেন, আমাদের ছাত্র হাসানকে নিয়ে লিখতে পারেন আপনি। ও একজন সাংবাদিক। তখন একজন ফোন দিয়ে হাসানকে আসতে বললেন কলেজে। কিন্তু হাসান নদীর ওপারে ইট ভাটায় মজুরের কাজ করতে গেছে সকালে- খোঁজ নিয়ে জানানো হলো। একজন সাংবাদিক দিনমজুরের কাজ করেন! অদ্ভুত তো! আগ্রহ বাড়ে আমার। অধ্যক্ষ মো. শাহ আলম স্যার ২০০৩ থেকে এই কলেজে দায়িত্বরত। তিনি জানান, হাসান বিএ একুশতম ব্যাচের ছাত্র। তার আইডি ২১০২৩৫১৩০১০। হাসানের কৌশল, যৌবন এবং যাতনার সঙ্গে পরিচিত তিনি। পুরো গল্পটি শোনালেন স্যার।
শিক্ষার অভাব, নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থার এ নিভৃত পল্লীতে হাসান পারভেজের আন্ধারমানিক পত্রিকা যেন অন্ধকারের আলো। অভাবের তাড়নায় কিনতে পারেনি একটি প্রিন্টার বা কম্পিউটার এমন কী ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল। তবু থেমে নেই হাসান। হাসান পারভেজের মতে, কাজে বাধা তো থাকবেই। তাই বলে বসে থাকলে তো হবে না। কমিউনিটি এই পত্রিকা একদিন আলোর মুখ দেখবেই। হত্যা, খুন, ধর্ষণের মতো নেতিবাচক কোনো খবর থাকে না পত্রিকায়। থাকে ইতিবাচক, ভালো খবর। কারো সফলতার, কারো প্রাপ্তির কারো বা রয়েছে সুখ-দুঃখের গল্প। সেই গল্পগুলোকে হাসান নিপুণ শিল্পীর মতো তুলে ধরেন তার হাতের লেখা এ পত্রিকায়। দারিদ্র্যের সঙ্গে আরো একটি বিষয় শৈশব থেকেই সঙ্গী তার। সেটা; লেখালিখির ঝোঁক।
শাহ আলম স্যারের কাছ থেকে হাসানের মোবাইল নম্বর নেয়ার পর গত তিন বছরে কয়েকবার ফোনে কথা হয় আমার। হাসানের কথায়, কলমই তার প্রাণের আরশ। ‘বাবুরা’ তাই কাজে রাখেন না তাকে। কিন্তু তাতে একদিক থেকে সুবিধাই হয়েছে হাসানের। স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
দুর্যোগপ্রবণ গ্রামটি। প্রকৃতির সঙ্গে লড়তে হয় নিয়মিত। দুঃখ জরা, অভাব, অভুক্ত প্রতিদিনের চিত্র এখানকার। দুর্গম, তাই শহর থেকে এখানে আসে না কোন পত্রিকা। যাদের কথা কেউ শোনে না, তাদের কথা হাসান কান পেতে শোনেন। লেখেন। একদিন সে ভাবেই তিনি লিখেছিলেন, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী রুবিনার কথা। রুবিনার মানসিক প্রতিবন্ধী মাকে শিকল দিয়ে বেঁধে বৃদ্ধা ‘নানি’ যেতেন খাবার খুঁজতে। পাহারায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত ছোট্ট রুবিনা। জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতা অবলম্বনে হাসান আন্ধারমানিক পত্রিকায় লেখেন, রুবিনাকে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, তৈয়ব আলীর ছোট্ট বাড়ি হোসেনপুরে যাও’। প্রথমে পত্রিকা পড়ে পরবর্তীতে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায় হাসানের এই কবিতা। ছড়িয়ে পড়ে নাম। রুবিনারও ভাগ্য ফেরে। গণমাধ্যমে তার কষ্টের কথা ছড়িয়ে পড়তেই মেলে আর্থিক সহায়তা। এ ভাবেই একের পর এক মানুষের ভাগ্য বদলে চলেছেন পারভেজ। তারই মতো আরো জনা পনেরো ‘সাংবাদিক’ জুটেছে তার। দৈনন্দিন ইটভাটা, ধান তোলা কিংবা মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে তারা ছুটে যান প্রান্তিক মানুষের কাছে। খুঁজে আনেন বয়ান। তারপর গোটা পত্রিকাটি লেখা হয় নিজ হাতে। প্রতি মাসে একাধিক সংখ্যা বের হয় আন্ধারমানিকের। পত্রিকা বিক্রি করে যে আয় তাতে কলম, আঠা, কাগজের দামও ওঠে না। সংসার চলা তো দূরে থাক। পাগল মানুষটাকে কে বুঝাবে এসব- জানালেন হাসানের স্ত্রী।
‘দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে, লিখি কথা। আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা।’ শিশুকালে দেয়ালের ওপর কয়লার আঁচড় কেটে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এভাবেই নিজের সৃজনশীল প্রতিভার প্রকাশ করেছিলেন। কবি সুকান্তের মতো অনেক কবি-সাহিত্যিক-লেখকের লেখার সূচনা হয়েছিল এ দেয়াল পত্রিকা থেকেই। অর্থাৎ এ দেয়ালিকা থেকেই জন্ম নেয় আগামী দিনের সম্ভাবনা। হাসানেরও তাই হয়েছে। তাঁর হাতে লেখা কবিতা, কোন পত্রিকা-ই ছাপাতো না। আন্ধারমানিক নামে কমিউনিটি পত্রিকা প্রকাশের এটিও একটি কারণ।
এই উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মুদ্রণযন্ত্রে ছাপানো রংবেরঙের নানান পত্রিকার ভিড়ে নিভৃত পল্লীতে বসে আপন মনে দেয়াল পত্রিকার মতোই হাতে লিখে প্রকাশ করে যাচ্ছেন ভিন্নধর্মী এ পত্রিকা ‘আন্ধারমানিক’। যিনি স্বীকৃতি, প্রাপ্তি বা প্রচার কোনো কিছুরই মুখাপেক্ষী নন। মানুষের কথা বলতে বলতে নিজের বা দুই সন্তান সংসার নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না? যশ, খ্যাতি কী সত্যিই তাকে টানে না? প্রশ্ন শুনে ৪২ বছরের হাসান লজ্জা পান। নি¤œ স্বরে বলেন, নিজের কথা নিজের পত্রিকায় লিখা ঠিক নয়। তবে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে চাই। আমি বললাম, চমৎকার। আপনার মতো মানুষই বাউবির স্তম্ভ। মূল ভিত্তি। যাদের শিক্ষা গ্রহণে সব পথ বন্ধ হয়ে যায়, তাদের পাশেই থাকি আমরা। স্বল্প খরচ আর বিনামূল্যে বই আমরা দিয়ে থাকি। ইউটিউব, এসডি কার্ড, অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষা দেয় বাউবি। প্রবাসে থাকা বাঙালি রেমিট্যান্স যোদ্ধা যারা আপনার মতো সুযোগ বঞ্চিত তাদের জন্যও বাউবি বহির্বাংলাদেশে স্টাডি সেন্টার খুলেছে। ধনী দরিদ্র, বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, কৃষক, শ্রমিক, মজুর, বগুড়ার শারীরিক প্রতিবন্ধী নুরজাহান বেগম, শেরপুরের ৬৯ বছরের বৃদ্ধ আবুল কালাম কিংবা শিক্ষক, ডাক্তার, সচিব, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্টাফ ফটোগ্রাফার এমনকি বাংলার গর্ব নারী ফুটবলার সাবিনাও আমাদের শিক্ষার্থী। সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ বাউবি দিচ্ছে। ফোনের ওপাশ থেকে হাসান আমার কথা শুনে উৎফুল্ল ও উজ্জীবিত হন।
পরিবার নিয়ে যে এক কামরার ঘরে হাসান থাকেন, সেটিও তার নিজের নয়। যে দিন মালিক উচ্ছেদ করে দেবেন, সে দিনই চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। তবু সরকারের ঘর দিতে চাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে হাসান জানিয়েছিলেন, তার তো তবু মাথার ওপর ছাদ আছে। বরং তাদের ঘর দেয়া হোক যাদের সেটুকুও নেই। কলাপাড়ার ইউএনও তার উত্তরে বাহবা দিয়েছিলেন সেদিন। বলেছিলেন, আপনি অনন্য দৃষ্টান্ত হাসান সাহেব। আত্মপ্রচারের লোভ নেই, থাকার মধ্যে আছে একটি স্বপ্ন। তিনি থাকুন বা না থাকুন তার পত্রিকা যেন থাকে। খুন খারাবি জালিয়াতি নয় বরং হাসি মাখা মুখ আর সংগ্রামে সফল মানুষের লেখক হয়ে। অনাহার ক্লিষ্ট, জীর্ণ ভাতে মরাদের কবি হয়ে। দারিদ্র্যের নির্মমতায় চাপা পড়ে গিয়েছে যাদের মুখ, তাদের মুখপত্র হয়ে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়