ঢাকা কলেজে কমিটির দাবি : ছাত্রলীগ সভাপতির গাড়ি আটকে দিল বিক্ষুব্ধ নেতারা

আগের সংবাদ

প্রতিটি ব্যাংকেই টাকা আছে > ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী : বিএনপি-জামায়াত যেন ক্ষমতায় না আসতে পারে

পরের সংবাদ

বিএনপির নতুন ইউটোপিয়া : আসমানি রংধনু জাতি গঠনের কল্পনা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কিছুদিন থেকে বিএনপি এবং গণতন্ত্র মঞ্চে ওঠা কিছু নামসর্বস্ব নেতার মুখ থেকে রাষ্ট্র মেরামত, গণতন্ত্র মেরামত ইত্যাদি চমকপ্রদ কথা উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছিল। কথাগুলো এককালের বিপ্লবীদের নানা বিপ্লবী তত্ত্বের মতোই ফানুস ওড়ানো, রং ছড়ানো এবং তরুণদের সম্বিৎ কেড়ে নেয়ার মতোই মনে হতে পারে। তবে যারা এখন এ কথাগুলো বলছেন, তাদের অনেকেই এককালে নানা বিপ্লবী তত্ত্ব আওড়িয়েছিলেন না বুঝে, কম বুঝেই। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং আর্থসামাজিক বিকাশের কোনো রাজনীতিতেই তাদের সচেতন বা নিবিড় অংশগ্রহণ ছিল না। রাষ্ট্র, সমাজ এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নের প্রয়োজনীয় রাজনীতি বাদ দিয়ে তারা তখন বিপ্লবের পঙ্খিরাজে আকাশ বিচরণ করেছিলেন। তাদের এই বিচরণের নেপথ্যে কাদের ফুয়েল কাজ করেছিল, জানি না। তবে ওই পঙ্খিরাজ বিপ্লবীদের আকাশ কাঁপানো বিপ্লবী তত্ত্বে সমাজের অপেক্ষাকৃত মেধাবী, আবেগতাড়িত তরুণরা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের পিছু নিয়েছিল। পরিণতি কারোই সুখকর হয়নি। স্বপ্নবাজ পঙ্খিরাজ বিপ্লবী তত্ত্ববিদরা একসময় আকাশ থেকে ডানা ভেঙে ভূপৃষ্ঠ হলেন, তবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে। তাদের বিপ্লবী আওয়াজ অনেক আগেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। পথ হারিয়ে কেউ বা চলে গেছে ডানে, বামে, এখানে-সেখানে, যেখানে কিছু একটা অবলম্বন করে থাকা যায়। তাদের এই পরিণতি আমাদের নিকট অতীতে দেখা। এরাই একসময় সামরিক শাসকদের রংধনু চাকার গাড়িতে চেপে বসেছিলেন। তখন ‘ইসলামী মূল্যবোধ’, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’, ‘খালকাটা বিপ্লব’ ইত্যাদি নতুন তত্ত্বের নতুন ব্যাখ্যায় রাজনীতিতে নিজেদের পা ফেলার জায়গা করে নিল, সমাজ বিপ্লব উবে গেল। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য, মৈত্রী এবং ন্যায়বিচার বইয়ের পাতায় চাপা পড়ে থাকল। এরাই একসময় ক্ষমতায় আসীন হয়ে দেশটাকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার সব আয়োজনের সমর্থন জানাল। রাষ্ট্রক্ষমতায় স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে অংশীদার করে নিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান কেটে তছনছ করে দিল। ২৩ বছরের স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জয়ধ্বনি জয় বাংলা ভুলিয়ে দিয়ে রাজনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসনসহ সর্বত্র জিন্দাবাদ স্থাপিত করল। ইতিহাসের অর্জন সবই বিসর্জন দিয়ে দেয়া হলো। ২০০১ ও ২০০৬ সালে দেশকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা ও দেশের গণতন্ত্রের বাহকদের উৎখাত করতে জঙ্গিদের ব্যবহার করা হয়েছিল। এরপর ২০০৯ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা, ’৭৫ এর ঘাতকদের রক্ষা করার চেষ্টা, শিক্ষানীতি, নারী নীতির বিরোধিতা এবং দেশে বারবার অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা, আরব বসন্তের আদলে জঙ্গি, হেফাজতিদের নিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা, নির্বাচন ভণ্ডুল করা ইত্যাদি উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর কিছুদিন চুপসে গিয়েছিল। আবার স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে নতুনভাবে মেরুকরণ ঘটতে শুরু করে। দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তথাকথিত এসব সাবেক ‘বিপ্লবী শক্তি’ যুগপৎভাবে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর আয়োজনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা করতে থাকে। চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা, ল²ীপুর, ফেনী, নড়াইলসহ দেশের অনেক জায়গায় সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে যারা জাতিগত অবিশ্বাস আরো তীব্রতর করেছে, তারা এখন আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসমানি রংধনু জাতিতত্ত্বের এক আওয়াজ মানুষের সম্মুখে হাজির করতে যাচ্ছে।
১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সেই ‘রংধনু জাতির’ রঙের আগমনী বার্তার কথা শোনানো হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি কত রংবেরঙের হতে পারে, তার হয়তো এটি সর্বশেষ নমুনা। রংধনু জাতির তত্ত্ব নির্মাণে এরই মধ্যে বিএনপির কিছু নেতা যে মেধাচর্চা করেছেন, সেটি তাদের মেধার ফসল প্রণীত প্রস্তাবনা ৭ দলীয় মঞ্চের নেতাদের বিলি করা হয়েছে। এছাড়া ওই সব অতীতহারা ঘরানার কিছু ‘তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবী’ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দেখছেন। এর পরই রংধনু জাতির আগমনী বার্তা ১০ ডিসেম্বরে ঢাকার সমাবেশ থেকে শোনানো হবে জানানো হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, “আওয়ামী লীগ পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি অর্গানকে তারা ধ্বংস করেছে। একটি রাষ্ট্র যেসব অর্গানের ওপর ভিত্তি করে চলে, সেগুলোকে তারা মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমাদের এ ‘রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার’ রূপরেখা।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি একজন শিক্ষক নেতা এই উদ্যোগকে সমর্থন করে বলেছেন, ‘জনগণের সব প্রত্যাশাকে থোড়াই কেয়ার করে সরকার রাষ্ট্রের সব কাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ধ্বংস করেছে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা, কেড়ে নিয়েছে জনগণের ভোটের অধিকার। সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, বৈষম্য ও বিভাজনের রাজনীতি। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক জাতি গঠনের উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। এটি বাস্তবায়িত হলে দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হবে।’
ইকবাল মাহমুদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বক্তব্য পড়ে মনে হচ্ছে, তারা দেশের গণতন্ত্রহীনতা, বাকস্বাধীনতাহীনতা, ভোটাধিকারহীনতা, রাষ্ট্র কাঠামো ধ্বংস করা, রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গকে ধ্বংস করা ইত্যাদি বর্তমান সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের অপকর্ম ছাড়া আর কিছু নয়। এর আগে দেশের অবস্থা কি ছিল তা তারা বলেননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়েছিল, তখন হত্যা-ক্যুর মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা যারা দখল করেছিল, সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে দীর্ঘদিন যে ব্যবস্থাটি জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল- সেটিকে কোন রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায়? টুকু সাহেব এবং বিএনপিপন্থি শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী জনগণকে তাদের রাষ্ট্র-রাজনৈতিক জ্ঞান দিয়ে মানুষকে যদি দীক্ষা দিতেন, তাহলে আমরা হয়তো জ্ঞানতাপসদের পরশ পেতে পারতাম! মাথা তুলে দাঁড়ানোর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটাকে ১৯৭৫ সালে যারা সামরিক শাসন জারি করে তছনছ করে দিল, তারা রাষ্ট্রের অঙ্গের কোনো প্রাণশক্তি আধারে অবশিষ্ট রেখেছিলেন কিনা, সেই প্রশ্ন তো করা যায়। কোন গণতন্ত্র, কোন ভোটাধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, সে রাষ্ট্রের মালিকানা আজ জনগণের হাতে নেই বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা কী ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টের পর প্রতিষ্ঠিত সামরিক শাসন আমলে কিংবা ১৯৯১-৯৫ অথবা ২০০১-০৬ বিএনপি ও জোটের শাসনামলে এক বিন্দুও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? বরং তখন এসব কিছুকে কীভাবে তছনছ করা হয়েছিল, রাজনীতিকে কীভাবে রাজনীতিবিদদের জন্য ডিফিকাল্ট করা হয়েছিল, তা তো সবারই জানা কথা। যে রাষ্ট্র নির্মাণের শুরুতেই সামরিক শাসনের বেহাতে চলে গিয়েছিল, যে রাষ্ট্রের শাসনে বিএনপি-জামায়াতের একটি সময়কাল ছিল, তাদের হাতে জনগণের ভোট, সাম্য, ন্যায়বিচার তখন কার্পেটের তলে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন বিপ্লবীদের মতো রাষ্ট্র, সমাজ, জনগণ এবং তাদের অধিকার নিয়ে যে মায়াকান্না জুড়ে দিয়েছে, তা রাজনৈতিকভাবে বিএনপির আদর্শ ও চরিত্রের সঙ্গে যে সংগতিপূর্ণ নয়; একইভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কোনো নতুন কৌশল ছাড়া আর কিছু হতে পারে না, সেটি বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। বিএনপি বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যেমন কোনো ত্যাগ স্বীকারের অধিকারী মানুষের দল নয়, অধিকন্তু যারা এই রাষ্ট্রের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছিল তাদের হত্যা, রাজনীতি থেকে বিতাড়ন এবং একটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিরোধী চিন্তার নানা সামাজিক স্বার্থবাদী, সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সংগঠনে আবির্ভূত হয়েছিল। রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে আগত নয়, বরং আদর্শবাদী রাজনীতিবিরোধী নানা অপশক্তিকে একত্রিত করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রকে বদলে ফেলার ক্ষেত্রে বিএনপি রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন, দেশি এবং বিদেশি নানা শক্তিকে ব্যবহার করেছে। ফলে প্রকৃত আদর্শের ধারক রাজনীতিবিদ দেশে তৈরি হতে পারেনি। তারপরও যারা ন্যূনতম আদর্শে রাষ্ট্রটিকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করে গড়ে তোলার পক্ষে হাল ধরেছে, তাদের বিপক্ষে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রথমে কাজে লাগিয়েছে। এখন তথাকথিত নাগরিক সমাজের কিছু সুবিধাবাদী জনবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রনির্মাণ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আশ্রয় প্রার্থনা করছে। এদের রাষ্ট্র গড়ার কল্পনা শক্তিরই কোনো অতীত রেকর্ড পাওয়া যাবে না। রাতারাতি কেউ সেই নির্মাণযজ্ঞের কথা ভাবতেও পারে না। রাষ্ট্র তাদের কাছে হয়তো তামাশা বা খেলনার বিষয় হতে পারে। কিন্তু‘ সভ্য জগতে আধুনিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিবর্তন, রাজনীতির পথ পরিক্রমার এক জটিল কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পরিচালিত বিষয়। আকাশ থেকে এটি নাজিলও হতে পারে না। রাতারাতিও এর নির্মাণ কেউ করতে পারে না। এর জন্য দুটি পূর্বশর্ত অত্যাবশ্যকীয়। এক. জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা ও দুই. রাজনৈতিক নেতৃত্বের সৃজনশীল ভূমিকা। শুধু রাজনৈতিক সৃজনশীল আদর্শবাদী নেতৃত্বই পারে জনগণকে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে একটি কল্যাণবাদী আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হতে। যাদের অতীত সুবিধাবাদী রাজনীতি, রাষ্ট্রভাঙার নানা ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ, রোমান্টিক আর বিভ্রান্তবাদী চিন্তাচেতনায় ভরপুর, তাদের কাছ থেকে কোনোদিনই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কল্পনা করা যেতে পারে না। রাষ্ট্র নির্মিত হয় তার অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক শক্তিসমূহের সমন্বয় ঘটিয়ে, কোনো আসমানি রংধনু তত্ত্ব দিয়ে রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন যারা দেখান, তারা ইউটোপীয় (বাস্তবে যা নেই) কল্পনাকেও হার মানাতে পারেন। ইউটোপীয়রা একসময় অনেক কিছু স্বপ্ন দেখিয়েছিল কিন্তু কোনো স্বপ্নই ধরা দেয়নি। বাস্তবে রাষ্ট্রব্যবস্থা ইউটোপীয় দিয়ে কোনো কালেই আশা করতে পারে না। যারা করেন, তারা মেধা ও আদর্শে যোগ্যতা রাখেন না বলেই প্রতারণার খেলা খেলেন। রাজনীতির এই খেলা এদেশে বহু লোকই অতীতে খেলেছে, এখনো খেলছে। অতীতে অনেক তরুণ এতে গা ভাসিয়েছিল, নিজেদের জীবনও ধ্বংস করে দিয়েছিল। অথচ ওই সব মেধাবী তরুণ সুস্থ ধারার রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা, প্রশাসন, কর্মজীবন ইত্যাদির মাধ্যমে দেশকে আরো অনেক কিছু দিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু হ্যামিলনের বংশীবাদকদের সুরে বিমোহিত হয়ে তারা বিপ্লবের নদীতে আত্মহননের শিকারে পরিণত হলেন। এখন দিন বদলে গেছে। তরুণরা অনেক কিছু হাতের মুঠোয় যাচাই করে নিতে পারছে। সুতরাং আসমানি রংধনু জাতির ডাক তাদের কতটা টানতে পারবে, সেটি নিয়ে সন্দেহ করা যেতেই পারে।
বিএনপি ২৭ দফার একটি কর্মসূচির নাম দিয়েছে রংধনু জাতি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে মূল ভিত্তি রেখেই প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক জাতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবে বিএনপি। বাংলাদেশি জাতি যেমন কোনো জাতিতত্ত্বের সংজ্ঞায় কোনো জাতিরূপে আবির্ভূত হতে পারেনি, আকাশের রংধনু ছড়িয়েও কোনো জাতি তৈরি করা যাবে না। জাতি তৈরি হয় হাজার বছরের ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে। বিএনপি বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভেঙে বাংলাদেশি নামকরণ করার চেষ্টা করেছে। সেটি ছিল একটি কৃত্রিম সংজ্ঞা। রংধনু তার চাইতেও আরো বড় কৃত্রিম। এই কর্মসূচিতে ২৭টি দফা যুক্ত করা হয়েছে। তাতে ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’, ‘জাতীয় সমঝোতা কমিশন’, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, ‘দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’, ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন’ সংশোধন, সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, ‘জুডিশিয়াল কমিশন’, ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’, ‘মিডিয়া কমিশন’, ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’, কালাকানুন বাতিল, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন, আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন, জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-ক্যারিকুলামকে প্রাধান্য, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা, মূল্যসূচক ভিত্তিক ন্যায্যমজুরি, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ইত্যাদি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজন একটি দীর্ঘ রাজনীতির পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ দল, নেতৃত্ব এবং জনসমর্থন, যা শুধু অসাম্প্রদায়িক কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই আশা করা যেতে পারে। বিএনপি কখনোই অসাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করেনি, শুধু সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করেছে। নেতাকর্মীদেরও সেভাবে তৈরি করেছে। জোট করেছে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে। বিএনপির গঠনতন্ত্রেও নেই উদারবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিশ্রæতি। মুক্তিযোদ্ধাদের বিএনপি কখনো প্রণোদনা দেয়নি বরং রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এবং ক্ষমতায়ন করেছে। সুতরাং এমন অতীত নিয়ে আসমানি রংধনু জাতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে গেলে বিএনপির ভেতর থেকেই আগে নিজে তছনছ হবে, পরে দেশটাকেও আরো বিপদেই ফেলবে। বড়জোর এসব প্রতিশ্রæতি শুধুই কিছু মানুষকে আকৃষ্ট করার হতে পারে। কিন্তু ৫০ বছরে বাংলাদেশ যেভাবে বিএনপি এবং অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর অপরাজনীতির শিকার হয়েছে, তার ফলে ১৯৭২ এর সংবিধানের মূল আদর্শগুলো বাস্তবায়ন করাই এখনো মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে অসাম্প্রদায়িক উদারবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য। যত প্রতিশ্রæতি, তত ফাঁকি দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। আকাশের সাত রং নামিয়ে নতুন কোনো জাতি গঠনের কল্পনা কতটা আজগুবি, তা অচিরেই হয়তো আমরা দেখতে পাব।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়