ঢাকা কলেজে কমিটির দাবি : ছাত্রলীগ সভাপতির গাড়ি আটকে দিল বিক্ষুব্ধ নেতারা

আগের সংবাদ

প্রতিটি ব্যাংকেই টাকা আছে > ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী : বিএনপি-জামায়াত যেন ক্ষমতায় না আসতে পারে

পরের সংবাদ

গুজবে ভাসছে ব্যাংকিং খাত : আমানতে ঘাটতি নেই, গুজবে কান না দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক > কিছু গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : আমানত গচ্ছিত রাখার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান ব্যাংক। এখনো মানুষ টাকা, গহনার মতো মূল্যবান জিনিসপত্র ব্যাংকে জমা রাখা নিরাপদ মনে করেন। মানুষের মধ্যে ব্যাংকে টাকা রাখার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বর্তমানে মোট তালিকাভুক্ত ৬১ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু গ্রাহকের বিশ্বাসে হঠাৎ করে যেন ছন্দপতন ঘটেছে। সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংকের শত শত কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির খবর প্রকাশ পাওয়ায় ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে, ব্যাংকে টাকা নেই বা থাকবে না- এমন গুজবে আতঙ্কে ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। এদিকে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাত নিয়ে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশিরাও। নিতান্তই ঋণের টাকার কিস্তি শোধ ও পরিবারের খরচের প্রয়োজন ছাড়া দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন না অনেকে। তবে সরকারের অভিযোগ, ব্যাংক নিয়ে একটি মহল পরিকল্পিত গুজব ছড়াচ্ছে। ব্যাংকে টাকার কোনো সংকট নেই। গুজবে কান না দিতে গ্রাহকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশের ব্যাংকারদের ফোন করে জিজ্ঞেস করছেন, তারা দেশে টাকা পাঠাবেন কিনা। আবার দেশেই থাকেন এমন অনেকে জানতে চাচ্ছেন, ‘ব্যাংকে এখন টাকা রাখা কতটা নিরাপদ। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে না তো!’ এমন গুজবে কান না দিতে গ্রাহকদের পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকে জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে। গুজব বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি এবং স্থানীয় ব্যাংক-কর্মকর্তাদের আশ্বাসে এখনো ব্যাংক-ব্যবস্থায় আস্থা রাখছেন গ্রাহকরা। তবে কিছু আমানতকারী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে

জানিয়েছেন, ‘ব্যাংকে টাকা নেই বা থাকবে না’- এমন গুজব চাউর হতেই আতঙ্কে ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা নেই, এটা বলার পর সত্যিকারের একটা প্রভাব পড়েছিল। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা মানুষ তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে বাধা দেয়নি। এখন সবাই টের পেয়েছে, আরে! এটা তো ভুল করেছি। এখন সবাই টাকা ফেরত দিতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন, এখন কিন্তু সবাই আবার ফেরত দিচ্ছে।’ কেউ কেউ ব্যাংক থেকে টাকা তুললেও পরে তারা আবার জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তাও।
রাজধানীর মতিঝিলের কয়েকটি ব্যাংকের শাখায় গতকাল সোমবার সরজমিন দেখা গেছে, অন্যান্য দিনের মতোই গ্রাহকরা প্রয়োজন অনুযায়ী টাকা তুলছেন, জমা দিচ্ছেন। কারো মধ্যে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা যায়নি। মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখায় কথা হয় জুবায়ের ফয়সাল নামের এক গ্রাহকের সঙ্গে। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সুযোগসন্ধানীরা এসব গুজব ছড়াচ্ছে বলে আমার মনে হয়। তিনি বলেন, ফেসবুকে এমন গুজব আমিও দেখেছি। প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে ব্যাংকে রাখা টাকা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরে শুনতে পেলাম, এসব গুজব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট আমানত ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা, যা আগের মাসের চেয়ে ১১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা বেশি। বর্তমানে মোট তারল্যের পরিমাণ ৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকট নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক ভোরের কাগজকে বলেন, এ ধরনের গুজবকে সবাই মিলে প্রতিহত করতে হবে। তা না হলে চক্রান্তকারীরা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে। তিনি বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রভাব দেশেও পড়েছে। সুতরাং কিছুটা ক্রাইসিস থাকবে। তবে ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকট নেই। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে সুযোগসন্ধানী চক্র ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তিনি আরো বলেন, মানুষ যাতে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারে বিশ্বাস না করে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে কোনো ব্যাংকে যদি তারল্য বা অন্য কোনো সংকট দেখা দেয় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকট সমাধানে সহায়তা দেবে বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে টাকা পাওয়া যাবে না- এমন কথা সত্যি নয়। তিনি বলেন, তবে যদি কোনো ব্যাংক কোনো অপকর্মে লিপ্ত হয়, তাহলে সেই ব্যাংকের গ্রাহকের উচিত টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে রাখা। ড. মনসুর বলেন, বর্তমানে আতঙ্ক হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে- বিভিন্ন ব্যাংকে যে দুর্নীতি হচ্ছে, সেজন্য আতঙ্কটা ছড়িয়ে পড়েছে। এমন আতঙ্ক থেকে বের হতে হলে ব্যাংকে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উচিত খারাপ ব্যাংকগুলো থেকে বেরিয়ে এসে ভালো ব্যাংকে যুক্ত থাকা।
এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, এসব কারণে ব্যাংক খাতে একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে ব্যাংকে আমানতকারীদের টাকা নিরাপদে আছে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী সেলিম আর এফ হোসেইন বলেন, দেশের কিছু ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট রয়েছে। কিন্তু তারল্যের সংকট নেই। সংকট তৈরি হওয়ারও আশঙ্কাও নেই। কিছু দুষ্টু লোক ব্যাংকের তারল্য নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। তাতে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। স্বাধীনতার পর কোনো ব্যাংক গায়েব হয়ে যায়নি। দুই-একটি ব্যাংকে সংকট তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে তার সমাধান হয়েছে। ভবিষ্যতেও সংকট তৈরি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংকটের সময় একটি মহল সুযোগ বুঝে নানা গুজব ছড়ায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ভুল করেছে। তারা প্রকাশ করেছে, ১০টি ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। এর ফলে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে গেছে। এটা সাধারণত ব্যাংকগুলোই জানে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক নতুন ঋণ দিচ্ছে না। এমনিতেই এই কটি ঘটনায় আস্থায় কিছুটা চিড় ধরেছে। তার মধ্যে আবার রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের বিষয়ে বলা হচ্ছে, তাদের ঋণখেলাপি অনেক বেশি। লোকজন হয়তো কিছু টাকা তুলে ফেলেছে। কেউ কেউ হয়তো সঞ্চয় ভেঙেছে।
ডলার সংকট কেটে যাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে গত বৃহস্পতিবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনবিষয়ক জাতীয় সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, দেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের পরিমাণ আমদানির তুলনায় বেশি হওয়ায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে কোনো বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্তে দেখা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে দেশে অস্বাভাবিক আমদানির পরিমাণ ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর আমদানিকৃত পণ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর ৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি কমেছে, যা স্বাভাবিক। তদন্তে আমরা দেখেছি, কিছু পণ্য ২০ থেকে ২০০ শতাংশ ওভার ইনভয়েসিং দিয়ে আমদানি করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যাচাইয়ের কারণে আমদানির পরিমাণ কমে গেছে।
গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ লিখিত দেন, খতিয়ে দেখব। গত বুধবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে এক আলোচনায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, দেশের একটা ব্যাংকও দেউলিয়া হয়নি, ভবিষ্যতেও কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়