স্থায়ী কমিটি : স্টেডিয়ামে নারীদের খেলার পরিবেশ নিশ্চিতের সুপারিশ

আগের সংবাদ

দফায় দফায় বাড়ছে ওষুধের দাম : দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ক্যাবের, দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ রোগে ভুগে মারা যাবে

পরের সংবাদ

ভাওয়াইয়া গানের পরানের বন্ধুরা : নবীন-প্রবীণের সেতুবন্ধন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘ভাওয়াইয়া গান বাংলা লোকসংগীত তথা বাংলা সংগীতের একটি বিশিষ্ট ধারা। এই গান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর জেলা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার জেলা এবং আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত প্রাণের সংগীত’। বর্ণিত অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ হলেও এই গানের অতলান্ত জাদুকরী সুরে মুগ্ধ হয়েছে সারা পৃথিবী। চিরায়ত বাংলার সহজ-সরল অবলা নরনারীর হৃদয়মথিত আকুতি, তাদের প্রেমবিরহ, ব্যথাবেদনা এবং সংসারের নানা খুটিনাটি এই গানের প্রধান বিষয়। ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই…’ এর সুর কানে এলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কৃষিপ্রধান বাংলার অবলা বিরহিনী নারীর কষ্টক্লিষ্ট করুণ মুখচ্ছবি। পরানের বন্ধু বা পতিধনের জন্য নারীর অন্তরের অনন্ত হাহাকার, হৃদয়পোড়া আকুতি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় মনোহর সুরের মূর্ছনায়। একই সঙ্গে ভাওয়াইয়া গানে জীবন্ত রূপ নিয়ে যেন আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয় আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতি তথা বাংলার মাঠ, নদনদী, ঘরবাড়ি, গাছপালা, পাখপাখালি, গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল, গরুর গাড়ি, কাঁচামাটির সড়ক, আকাশ, বাতাস আরও কত কী। বাংলার মাটি ও মানুষের নিবিড় সোঁদা গন্ধ উদাস ও আকুল করে আমাদের ভাওয়াইয়া গানের সুরে। এই সুর আমাদের প্রাণ ও আত্মায় মিশে যায়। বাংলার উত্তরজনপদের নারী ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় গানের সুরে। ভাওয়াইয়া গান আমাদের হৃদয়কে পোড়ায়, প্রাণকে নাড়া দেয় গভীর অনুরণনে। এই গান আমাদের আত্মার খোরাক জোগালেও এর গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও কলাকৌশলী, সংগঠক, সংগ্রাহক ও গবেষকদের সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। আশরাফুজ্জামান বাবু বাংলাদেশ ও ভারতের এসব রতœদের চিনিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন ‘ভাওয়াইয়া গানের পরানের বন্ধুরা’ গ্রন্থের মাধ্যমে। কোথায় আব্বাসউদ্দীন আহমদ, সুরেন্দ্রনাথ রায় বসুনীয়া, প্যারীমোহন দাস, শ্যামাপদ বর্মন, কেশবচন্দ্র বর্মন, টেপু মিয়া, হেমলতা বোস, আশালতা রায়, মকবুল আলী, হরলাল রায়, ধনেশ্বর রায়, শমশের আলী প্রধান? তারা তো প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছেন নতুন প্রজন্মের কাছে। অথচ ভাওয়াইয়া গানের পত্তন করেছিলেন এই গুণী ব্যক্তিদের মতো আরও অনেক গুণীজন। একমাত্র আব্বাসউদ্দীন ছাড়া অন্যদের নিয়ে গবেষণাও হয়েছে খুবই কম। আশরাফুজ্জামান বাবু এদের জীবন ও কর্মের ওপর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে লিখেছেন এই বইটি। নিশ্চয় এটি খুব পরিশ্রমসাধ্য কাজ। নেটদুনিয়া তথ্যের ভাণ্ডার হলেও এদের সবার সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য খুব কমই পাওয়া যায়। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগ শিল্পী ও কলাকৌশলী এবং সংগ্রাহকদের তথ্য ইন্টারনেটে নেই। তাদের নিয়ে কোনো গবেষণাও হয়নি। ফলে তারা আস্তে আস্তে বিস্মৃত হতে চলেছেন। আশরাফুজ্জামান বাবু তাদের আমাদের সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করেছেন।
আশরাফুজ্জামান বাবু ছড়াকার, সংবাদকর্মী, নাট্যকার, পাশাপাশি আরও অনেক কাজ করেন তিনি। তার বাড়ি রংপুর জেলায় বদরগঞ্জের শাহাপুরে। ভাওয়াইয়া গানের প্রতি রয়েছে তার গভীর টান। ‘ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগ্রাহক, সংগঠক ও গবেষকদের জীবনভিত্তিক অসংখ্য’ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন বাবু। রয়েছে নিজের একটি ইউটিউব চ্যানেল। সেখানে তিনি বাংলা গান ও ডকুমেন্টারি প্রচার করেন। আর মগ্ন থাকেন লেখালেখি বা সাহিত্যসাধনায়। ২০২২ সালের একুশে বইমেলায় ‘বাবুই’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার আলোচ্য এই বই ‘ভাওয়াইয়া গানের পরানের বন্ধুরা’ (প্রথম খণ্ড)।
‘ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সংগ্রাহক, সংগঠক ও গবেষকদের জীবন’ ও কর্ম সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন বাবু এই গ্রন্থে। উপমহাদেশের বিখ্যাত লোকশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ (১৯০১-১৯৫৯) থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের নিবেদিত-প্রাণ ভাওয়াইয়া কর্মী পর্যন্ত শতাধিক জনের জীবন ও কর্ম তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন এ বইয়ে।
কাজের ব্যাপারে আশরাফুজ্জামান সব সময় নিষ্ঠাবান। আত্মমগ্নতার সবটুকুই তিনি ঢেলে দেন কাজে। এ কাজের জন্য তাকে ঘুরতে হয়েছে বিভিন্নজনের দ্বারে দ্বারে। যাকে বলে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। উত্তরবঙ্গের সন্তান হিসেবে হয়তো দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি এই কাজটি করেছেন। তিনি শুধু ভাওয়াইয়া গানের পূর্বসুরিদের সম্পর্কেই তথ্য সংগ্রহ করেননি, নতুন প্রজন্মের শিল্পী ও কলাকৌশলী, সংগঠক, সংগ্রাহক ও গবেষকদেরও তিনি তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে। ফলে প্রবীণ ও নবীনের সেতুবন্ধন তৈরি করেছে বইটি। পূর্বসুরিদের কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে তারা ভাওয়াইয়া গানকে পৌঁছে দিচ্ছেন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের সংগীত পিপাসুদের কাছে। তবে বইটিতে ভাওয়াইয়া গানের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রবন্ধ থাকলে ভালো হতো বোধ করি। যেমন ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, ভাওয়াইয়া গানের কথা ও সুর, ভাওয়াইয়া গানে নরনারীর প্রেমবিরহ বা বিচ্ছেদবেদনা, ভাওয়াইয়া গানে গ্রামবাংলার রূপবৈচিত্র্য, প্রধান কিছু ভাওয়াইয়া গান, ইত্যাদি। আমার পরামর্শ যুক্তিসঙ্গত মনে হলে পরবর্তী মুদ্রণে তা যুক্ত হতে পারে।

ভাওয়াইয়া গানের পরানের বন্ধুরা (প্রথম খণ্ড), বাবুই, পুরানা পল্টন, ঢাকা। প্রকাশক : মো. আবদুল কাদের, প্রচ্ছদ : আলমগীর জুয়েল, প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০২২। মূল্য : ৩০০ টাকা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়